ঢাকা, শুক্রবার, ১৬ কার্তিক ১৪৩১, ০১ নভেম্বর ২০২৪, ২৮ রবিউস সানি ১৪৪৬

মুক্তমত

বাজেট বিশ্লেষণ ২০২১-২২

জোরদার হবে ‘মেড ইন বাংলাদেশ’ ভিশন

নিয়াজ মোর্শেদ এলিট, অতিথি লেখক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৯৩২ ঘণ্টা, জুন ৮, ২০২১
জোরদার হবে ‘মেড ইন বাংলাদেশ’ ভিশন

প্রস্তাবিত বাজেটকে নানা জনে নানানভাবে ব্যাখ্যা করছেন। পক্ষে-বিপক্ষে বহুবিধ মত আছে।

আমার বিবেচনায় এটি হল– ‘মেড ইন বাংলাদেশ’ ভিশনকে বিশ্বব্যাপী প্রতিষ্ঠা করার বাজেট।

আমাদের মতো আর্থিক কাঠামোর দেশে এখনই সবার সব চাওয়া পূরণ করা কোনো অর্থমন্ত্রীর পক্ষে সম্ভব নয়; এর আগেও সম্ভব হয়নি। আশা করি সামনের দিনে হবে। এমন দিন নিশ্চয়ই সমাগত, যেখানে দাবি জানানোর আগেই অর্থমন্ত্রীরা সেসব চাওয়ার দিকে নজর দিতে পারবেন। অন্তর থেকে আমি এটা বিশ্বাস করি। আমরা যারা এটা বিশ্বাস করি– তারা এটাও বিশ্বাস করি যে ‘মেড ইন বাংলাদেশ’ এজেন্ডার মাধ্যমেই আমাদের সেই নিকট ভবিষ্যৎকে বাস্তবতায় নিয়ে আসার মন্ত্র নিহিত রয়েছে।

এই প্রেক্ষাপট থেকে আসন্ন ২০২১-২২ অর্থ বছরের জন্যে যে বাজেট প্রস্তাব করা হয়েছে সেখানে করপোরেট কর কমানোর দাবি ছিল ব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকে। আমাদের দাবিতে সাড়া দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী অ হ ম মুস্তফা কামাল। অধিকাংশ ক্ষেত্রে তিনি করপোরেট কর কমানোর প্রস্তাব করেছেন এবং কয়েকটি ক্ষেত্রে আগের মতোই রাখাতে চাইছেন। একমাত্র ব্যতিক্রম মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিস খাত।

কোনো কোনো ক্ষেত্রে তো আড়াই শতাংশ থেকে সাড়ে সাত শতাংশ পয়েন্ট পর্যন্ত করপোরেট কর কমানোর কথা বলেছেন অর্থমন্ত্রী। একক ব্যক্তি মালিকানাধীন কোম্পানি এখন যেখানে সাড়ে ৩২ শতাংশ করপোরেট কর দিচ্ছে, সামনের অর্থ বছরে সেটি ২৫ শতাংশে নামানোর কথা বলা হয়েছে। আর পুঁজিবাজারে নিবন্ধিত কোম্পানির করপোরেট কর ২৫ শতাংশ থেকে সাড়ে ২২ শতাংশে এবং পুঁজিবাজারে নিবন্ধিত নয় এমন কোম্পানির করপোরেট কর সাড়ে ৩২ শতাংশ থেকে ৩০ শতাংশে নামানোর প্রস্তাব রেখেছেন তিনি।

মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিস খাতটিকে এক পাশে রেখে আমি করপোটের কর কমানোর এসব প্রস্তাবকে সর্বান্তকরণে সমর্থন করছি। কারণ এগুলো দেশের উন্নতির সোপান তৈরি করবে। সামনের দিনে বাংলাদেশকে নিজ পায়ে দ্রুত লয়ে এগিয়ে চলার শক্তি জোগাবে। তারপরেও করপোরেট করের জায়গা থেকে আমি ছোটখাটো একটা ধাক্কা খেয়েছি বলতে হবে কারণ এখানের এখন বিদ্যমান কর সাড়ে ৩২ শতাংশ থেকে ৪০ শতাংশে উন্নীত করার প্রস্তাব করা হয়েছে। সামগ্রিকভাবে আর্থিক অন্তর্ভূক্তি নিশ্চিত করা এবং দেশকে ক্যাশলেস সমাজের দিকে নিয়ে যাওয়ার জন্যে মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসকেও উৎসাহ দিতে হবে। আমি আশা করবো, অর্থমন্ত্রী এই খাতটির কথাও গুরুত্ব দিয়ে আরেকবার ভাববেন। ডিজিটালাইজেশনের ক্ষেত্রে এমএফএস খাতের অবদানের কথা ভাববেন।

‘মেড ইন বাংলাদেশ’ প্রতিষ্ঠার জন্যে সামনের বাজেটগুলোতে ধাপে ধাপে করপোরেট কর আরো কমানো হবে বলেও অর্থমন্ত্রী ইঙ্গিত দিয়েছেন। আমরা অর্থমন্ত্রীর ওপর আস্থা রাখছি। কারণ ২০২০-২১ অর্থ বছরের বাজেটেও তিনি করপোরেট কর কমানোর ঘোষণা দিয়েছিলেন এবং কথা রেখেছেন। আমরা বিশ্বাস করি, আগামীর জন্যে তার দেওয়া ইঙ্গিত দেশকে আরো শিল্পমুখী করতে ব্যবসায়ীদের উদ্যোগী করবে। দেশে বিশাল কর্মসংস্থানের ক্ষেত্র তৈরি হবেও হবে তাতে।

একই সঙ্গে এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে দেশের টাকা দেশে থাকবে এবং দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীরা আরও বেশি বিনিয়োগ করার আগ্রহ পাবেন। আঞ্চলিক বাণিজ্যিক বিষয়ের দিকে তাকিয়ে হলেও করপোরেট কর কমানো জরুরি ছিল। দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে বেশি করপোরেট কর যে বাংলাদেশেই ছিল!

আমার বিবেচনায়, করপোরেট কর কমানো বা উদ্যোক্তা-ব্যবসায়ীদের খানিকটা সুবিধাজনক অবস্থান সৃষ্টি করে দেওয়ার মাধ্যমে দেশের বেসরকারি খাতকে উৎসাহ দেওয়া হয়েছে যা আসলে সামগ্রিক অর্থনীতিতে বাড়তি উজ্জীবনী শক্তির জোগান হিসেবে কাজ করবে।

অর্থমন্ত্রী আগামী অর্থ বছরে ৭ দশমিক ২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জনের যে লক্ষ্যমাত্রা প্রস্তাবিত বাজেটে রেখেছেন শত প্রতিকূলতার মধ্যেও সেটি অর্জনে ‘মেড ইন বাংলাদেশ’ রাখবে বড় ভূমিকা। কারণ হ্রাসকৃত করপোরেট কর এখানে কাজ করবে সামনের দিকে চলার জ্বালানি হয়ে।

অনেকেই বলছেন, করপোরেট কর কমানোর কারণে রাজস্ব আহরণের লক্ষ্য অর্জনও কঠিন হতে পারে। আমি তেমনটা মনে করি না। কারণ নতুন বিনিয়োগের ফলে বরং নতুন নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে, মানুষের ক্রয় ক্ষমতা বাড়বে, তখন অনেক ক্ষেত্রেই সরকার প্রত্যাশার চেয়েও বেশি কর পাবে। তাতে করে লক্ষ্য অর্জন সহজ হবে, বাজেট বাস্তবায়নও হবে সহজ। এখন প্রয়োজন শুধু চাকাটিকে সচল করে সামনের দিকে এগিয়ে নেওয়া।

২০০৮ সালেও যারা বলেছিলেন বাংলাদেশে ডিজিটাল সেবা চালু অসম্ভব হবে– তারা কি একবার খেয়াল করে দেখবেনে যে ‘ডিজিটাল’ কি ম্যাজিকের মতো কাজ করেছে। গোটা দেশের মানুষের জীবন-যাত্রার ধরণই বদলে গেছে এই একটি শব্দের ঝঙ্কারে। সকল সমালোচনা সয়ে তখন প্রয়োজন ছিল শুধু কাজ করে যাওয়া এবং সেটা করার কারণেই ডিজিটাল সেবার চাকা সচল হয়ে এখন দ্রুতগতিতে সেটি ঘুরছে। করপোরেট করের বেলাতেও কথাটা একইভাবে প্রযোজ্য। চক্রটা একবার ঘুরতে শুরু করলে তারপর শুধু সামনের দিকে এগিয়ে চলা।

আমার বিবেচনায় বাজেটের আরেকটি ইতিবাচক দিক হল অগ্রিম মূল্য সংযোজন কর কমানোর প্রস্তাব। এটিও ব্যবসাবান্ধব একটি সিদ্ধান্ত। ১০ শতাংশ কর দিয়ে কালোটাকা সাদা করার সুযোগ না দেওয়ার প্রস্তাব এবারের বাজেটে নেই। এটিও ইতিবাচক বিবেচনা। কারণ যারা আইন মেনে কর দেন, তাদের আরও বেশি কর দিতে হবে আর যারা কর দেয় না, তারা বহু বছর পর সামান্য কর দিয়ে সব কিছু সফেদ সাদা করে ফেলবে এটা অনুচিত। এটি রোধ করা জরুরি ছিল।

স্থানীয় উদ্যোক্তাদের জন্যে খুবই ইতিবাচক আরেকটি বিষয়ে আমার চোখ আটকে গেছে। আমি খেয়াল করেছি, প্রস্তাবিত বাজেটে দেশীয় পণ্য উৎপাদনকারী অটোমোবাইল শিল্পে ২০ বছর, হোম অ্যাপ্লায়েন্স এবং কৃষি প্রক্রিয়াকরণ শিল্পসহ হালকা প্রকৌশল খাতে যন্ত্রাংশ উৎপাদনে ১০ বছর কর অব্যাহতি প্রদানের প্রস্তাব আনা হয়েছে। এগুলো দেশীয় শিল্প ও বেসরকারি খাতগুলো আরও ভালো করার উৎসাহ দেবে বলে আমি বিশ্বাস করি। ইতিমধ্যেই দেশের নিজস্ব কিছু ব্র্যান্ড গড়ে উঠেছে, সরকারের এসব নীতি সহায়তার কারণে সামনে আরও অনেক ব্র্যান্ডের জন্ম এই মাটিতে হবে, যেগুলো হয়তো বিশ্ব দরবারেও রাজত্ব করবে, এ আমার বিশ্বাস।

তবে একই সঙ্গে আমি সরকারের কাছে অনুরোধ রাখবো যাতে তথ্য প্রযুক্তি, স্বাস্থ্য ও শিক্ষা– বিশেষ করে কর্মমুখী শিক্ষায় আরো খানিকটা গুরুত্ব দেওয়া হয়। সেটি হলে আগামীর উন্নত বাংলাদেশ গড়ার ক্ষেত্রে নিশ্চিয়ই আমরা দ্রুত পদক্ষেপে সামনে এগিয়ে যেতে পারবো।

লেখক: প্রেসিডেন্ট জুনিয়র চেম্বার ইন্টারন্যাশনাল (জেসিআই) বাংলাদেশ

বাংলাদেশ সময়: ১৯৩০ ঘণ্টা, জুন ০৮, ২০২১
নিউজ ডেস্ক

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।