ঢাকা, শুক্রবার, ১৭ কার্তিক ১৪৩১, ০১ নভেম্বর ২০২৪, ২৮ রবিউস সানি ১৪৪৬

মুক্তমত

সীমিত-সর্বাত্মক লকডাউন, জনগণের দুর্ভোগ

তপন চক্রবর্তী, ডেপুটি এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮০০ ঘণ্টা, জুন ২৭, ২০২১
সীমিত-সর্বাত্মক লকডাউন, জনগণের দুর্ভোগ

দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার পর গত ১৫ জুন সশরীরে অ্যাকাডেমিক পরীক্ষা গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেয় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় (চবি)। এরপর বিভিন্ন বিভাগ পরীক্ষার রুটিনও প্রকাশ করে।

কিন্তু পরীক্ষাগুলো শুরু না হতেই সোমবার (২৮ জুন) থেকে দেশজুড়ে লকডাউন ঘোষণা করা হয়। ফলে শনিবার (২৬ জুন) বিকেলে অনির্দিষ্টকালের জন্য সব পরীক্ষা স্থগিত করা হয়।

ঘটনার এখানেই শেষ নয়। শনিবার রাতে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ জরুরি বৈঠকে সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে ৩০ জুন লকডাউনের আগ পর্যন্ত পরীক্ষা চালিযে যাওয়ার ঘোষণা দেয়। পরীক্ষা একবার হবে, আরেকবার হবে না- ঘন ঘন সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের ফলে বেকায়দায় পড়েছেন শিক্ষার্থীরা। যদিও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা বাস্তবায়ন ও সরকারের সঙ্গে সমন্বয় করতেই এই সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করা হয়েছে বলে জানান বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ড. রবিউল হাসান ভূঁইয়া।

তবে প্রশাসনের বারবার সিদ্ধান্ত পরিবর্তনকে ‘দূরদর্শিতার অভাব’ বলে মনে করছেন হয়রানির শিকার শিক্ষার্থীরা। পরীক্ষা স্থগিত হওয়ার ঘোষণায় তারা কেউ দুর্ভোগ মাড়িয়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিয়েছেন, আবার কেউ মাঝপথ থেকে শহরে ফিরছেন।

লকডাউন নিয়ে আগের সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসেছে সরকার। শনিবার (২৬ জুন) রাতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সভাপতিত্বে ভার্চ্যুয়াল সভায় সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, সোমবার (২৮ জুন) থেকে বুধবার (৩০ জুন) পর্যন্ত সীমিত পরিসরে লকডাউন বাস্তবায়ন করা হবে। এরপর ১ জুলাই থেকে ৭ জুলাই পর্যন্ত ৭ দিন পূর্ণাঙ্গ লকডাউনে থাকবে পুরো দেশ। বৈঠকে মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলামসহ সরকারের শীর্ষ কর্মকর্তারা অংশ নেন। বৈঠক শেষে সরকারের প্রধান তথ্য কর্মকর্তা সুরথ কুমার সরকার লকডাউন নিয়ে সরকারের নতুন সিদ্ধান্তের কথা জানান।  

সরকারি সূত্র বলছে, আর্থিক বছর শেষ হওয়ার মুহূর্তকে বিবেচনা করে সরকার ৩০ জুন পর্যন্ত আর্থিক প্রতিষ্ঠানসহ হিসাব সংশ্লিষ্ট অফিস খোলা রাখতে চায়। সেজন্য পূর্ণাঙ্গ বা কঠোর লকডাউন পেছানো হয়। এর আগে জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন বলেছেন, জুন ক্লোজিংয়ের কারণে কিছু অফিস খোলা রাখা হবে। তবে শেষ পর্যন্ত সীমিত পরিসরে ৩ দিন লকডাউন বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত এসেছে।

এর আগে সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় কোভিড-১ সংক্রান্ত জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটি  এক বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছিল, বর্তমান পরিস্থিতিতে রোগের বিস্তার নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়া ও জনগণের জীবনের ক্ষতি রোধ করার জন্য সারাদেশে কমপক্ষে ১৪ দিন সম্পূর্ণ ‘শাটডাউন’ দেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে। সেই সুপারিশ বিবেচনায় নিয়ে সোমবার থেকেই কঠোর লকডাউনের ঘোষণা দেওয়া হয় গত শুক্রবার।

এই লকডাউনের খবর প্রকাশিত হওয়ার পর থেকে ক্রেতাদের চাপ বেড়ে যায়  কাঁচাবাজারগুলোতে। পাশাপাশি ডিপার্টমেন্টাল সুপার শপ এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দোকানগুলোতেও ক্রেতাদের ভিড় দেখা যায়। হঠাৎ বেড়ে যায় নিত্যপণ্যের দাম। বিক্রেতারা বলছেন, লকডাউনের ঘোষণা আসায় পণ্য কেনার চাহিদা বেড়ে গেছে। আর সাধারণ ক্রেতারা বলছেন, লকডাউনের ঘোষণা আসায় পরে বাজারে পণ্য পাওয়া যাবে না অথবা পণ্যের দাম আরও বাড়তে পারে এই আশংকা থেকেই বাজার করতে আসছেন তারা।  

শুধু বাজার নয়, সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকগুলোতেও বেড়েছে গ্রাহকের ভিড়। পাশাপাশি সপ্তাহব্যাপী লকডাউন ঘোষণায় বাড়ি ফেরা শুরু করেছে সাধারণ মানুষ। শহর ছেড়ে গ্রামে যাচ্ছেন তারা। এ কারণে উপজেলাগামী বাসে প্রচুর ভিড় লক্ষ্য করা গেছে। মানা হচ্ছে না শারীরিক দূরত্বও। অভ্যন্তরীণ রুটের বিমানে টিকিটের দামও বেড়ে গেছে মুহূর্তেই। টিকিট কেটে অনেকে যাত্রা বাতিলও করছেন।  

এই হ য ব র ল অবস্থার জন্য প্রশাসনের একশ্রেণির কর্তাদের সিদ্ধান্তহীনতাকে দূষছেন সাধারণ মানুষ। দেশের গত ৫০ বছরের ইতিহাস পুঁজিবাদী উন্নতির এবং আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থার শক্তি বৃদ্ধির ইতিহাস। এখন এরা ক্ষমতাধর, বেপরোয়া- তা বুঝতে কারও অসুবিধা হয় না।  

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রাজনৈতিক জীবনে পাকিস্তানি আমলাতান্ত্রিক কূটকৌশলের বিরোধিতা করেছেন। বঙ্গবন্ধু জানতেন, সেই আমলাতন্ত্র থেকে বাংলার মানুষকে মুক্ত করতে না পারলে, নিজেদের দূরত্ব ঘুচবে না। বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে না। তাই তিনি সেই আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থা ভাঙতে চেয়েছিলেন।

তিনি সরকারি কর্মকর্তাদের আমলাতান্ত্রিক মনোভাব পরিত্যাগ করে মানুষকে তাদের প্রভু হিসেবে স্বীকার করে নিতে আহ্বান জানিয়েছিলেন। টাঙ্গাইলে এক জনসভায় তিনি বলেছিলেন, ‘আমি চাই বাংলার মাটি থেকে সব রকম দৌরাত্ম্য ও সরকারি কর্মকর্তাদের দুর্নীতির অবসান হোক। চট্টগ্রামে এক সুধী সমাবেশে তিনি বলেছিলেন, ‘আমলা নয় মানুষ তৈরি করুন’। এসব কিছুই ছিল মানুষকে নিয়ে প্রশাসনকে গণমুখি করার চেষ্টা। কিন্তু তাঁকে হত্যা করে সেই স্বপ্ন পূরণ হতে দেয়নি কুলাঙ্গাররা।  

বঙ্গবন্ধু জনগণের মধ্য থেকেই বেছে নিয়ে যোগ্যদের প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ পদে বসিয়েছিলেন। প্ল্যানিং কমিশন গঠন করেছিলেন, যেখানে ছিল না আমলা। ১৯৭২ সালে জাতীয়করণ করা  শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো পরিচালনার জন্য দায়িত্ব দেন ব্যবসায়ীদের।  

বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন পূরণে তাঁর কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশকে একটি আধুনিক রাষ্ট্রে রূপ দিতে নিরলস প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন। আমলাতন্ত্রের মূল দর্শন পরিবর্তন করে স্বাধীন বাংলাদেশে একটি জনমুখী আমলাতন্ত্র তৈরি করতে কাজ করছেন তিনি। তারপরও কারও কারও বাধায় সেই প্রচেষ্টায় আসে আঘাত। পরিণামে সমালোচনার জন্ম নেয়, ক্ষুব্ধ হয় জনগণ।

বাংলাদেশ সময়: ১৭৪৬ ঘণ্টা, জুন ২৭, ২০২১

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।