সকাল ১০.৩০ মিনিট। স্থান: বাংলাদেশের সরকারী অভিজাত এলাকা।
-আজকের পেপার পড়েছ ?
-জ্বি স্যার
-ব্যাটা সাংবাদিকরা কি লিখেছে? এদের নিয়ে আর পারা যায় না। এরা দেশের কোনও উন্নতি দেখে না। খালি সমালোচনা করে। আরে দুই পয়সার সাংবাদিক, এত বুঝস ক্যান ! চোখের ইশারা করলেই তো গুম হয়ে যাবি।
‘গুম’ বাংলাদেশে এখন খুবই চেনা একটি শব্দ। বাংলাদেশের মানুষের কাছে এক শব্দ বেশিদিন জনপ্রিয় থাকে না। তাই বর্তমান সরকারের সময় আগের সরকারের ‘ক্রসফায়ার’ শব্দটির বদলে ‘গুম’ শব্দটি চালু হয়েছে। আর এরই মধ্যে ‘গুম’ বহুল প্রচারিত শব্দ হিসাবে সবার কাছে স্থান করে নিয়েছে। এই উন্নতি ও সাংবাদিকদের চোখে পড়ে না। মোমিনুর আজকের খবর বলো।
-স্যার, একটা হট নিউজ আছে। মোমিনুর দুশ্চিন্তায় পড়ে গেল। খবরটি কি হাসিখুশি মুখে বলবে, না মুখ শুকনো করে বলবে, সে বুঝে উঠতে পারছে না। হঠাৎ তার মাথায় একটা সমাধান চলে আসে। মোমিনুর গম্ভীর মুখে দাঁতগুলো মেলে দিয়ে বলে, স্যার সীমান্তে এক বাংলাদেশি যুবককে বি এস এফ নগ্ন করে নির্যাতন করেছে। কথাটা বলেই স্যারের মুখের দিকে তাকিয়ে তার রি-অ্যাকশন বোঝার চেষ্টা করল। মুহূর্তেই মোমিনুরের মুখে হাসি ফুটে উঠল। মনে মনে ভাবল, ভাগ্যিস দাঁতগুলো বের করে রেখেছিলাম।
- ঐ যুবককে বিএস এফ কিভাবে পেল ?
-স্যার গরু আনতে গিয়েছিল
-গরু তো অনেকেই আনে, ওকে ধরলো কেন?
-স্যার, ঘুষ দেয় নাই।
-তাহলে তো ঠিকই আছে। এই ঘটনা পাবলিক জানলো কিভাবে ?
-স্যার, আবার হারামজাদা সাংবাদিক । কে যেন আবার ইউটিউব নামে একটি ওয়েবসাইটে ঐ ভিডিও আপলোড করে দিয়েছে। স্যার ঘটনা হল, সেন্সর বোর্ডের অনুমতি নেয় নাই। সাথে ১৮+ ও লিখে নাই। সেন্সর বোর্ডের অনুমতি ছাড়া ন্যাংটা ছবি আপলোড করেছে, একটা মামলা দিয়ে দেব নাকি?
-হুমম। ভিডিওতে কি দেখা গেছে?
-স্যার, অনেকগুলো লোক গরু নিয়ে আসছে। কিছুক্ষণ পরে দেখা গেল, একজনকে ধরে বি এস এফ নগ্ন করে হলিউডের হরর মুভির মত বিভিন্ন স্টাইলে মাইর দিচ্ছে।
-ভালই করেছে। মাইরের সময় নগ্ন না করলে মাইর ঠিকমত শরীরে লাগে না। আবার মাইরের দাগগুলো ও দেখা যায় না। দাগ না দেখা গেলে, মাইর দিয়ে আরাম পাওয়া যায় না।
-জ্বি স্যার, একদম ঠিক বলেছেন, এমন মাইর দিছে, সারাজীবন দাগ দেখা যাবে।
-বাইরে এত লোকজন কারা? সাংবাদিকরা এসেছে নাকি?
- জ্বি স্যার । আপনার মতামত জানতে চায়।
-বিদায় করে দাও। বলে দাও, বিকালে আমার মিটিং আছে তার পরে বলব।
- ওকে স্যার । স্যার একটা কথা, অনেক সুশীল সমাজের লোকজন বলছে, সীমান্তে বি জি বি কে শক্তিশালী করতে। মানুষের অবাধ প্রবেশ নিয়ন্ত্রণ করতে।
-হা হা । এই সুশীল সমাজকে নিয়ে হয়েছে আরেক জ্বালা । আরে তাই যদি করা হয়, তাহলে দেশে ফেনসিডিল, অস্ত্র কোথা থেকে আসবে ? কোন একজন আন-স্মার্ট, এনালগ-বাংলাদেশি গরু চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়েছে, তার জন্য কি সীমান্তে এসব বন্ধ করে দিতে হবে নাকি ? দোষ তো সবই ঐ বাংলাদেশির, আরে এখন ডিজিটাল যুগ। এই যুগে কি কেউ গরু আনতে ওপারে যায়। যাবি ফেনসিডিল আনতে, দেখবি বি এস এফ জামাই আদর করে তোকে বাংলাদেশে পৌঁছে দেবে।
-স্যার, প্লেনে করে এগুলো আনা যায় না ?
-তুমি একটা বেকুব।
-জ্বি স্যার!
-তোমার মনে নেই, কিছুদিন আগে এক হোমরাচোমরা ১ লাগেজ টাকিলা এনেছিল। এয়ারপোর্টে সেটা নিয়ে কত কেলেঙ্কারি । আর বর্ডারের আশেপাশে ভারতে ফেনসিডিলের যতগুলো কারখানা হয়েছে, তার কি হবে । ভারত ছাড়া কি আমাদের একদিনও চলে ? কিছু বাংলাদেশি শুধু শুধু ভারতের বিরোধিতা করে । আরে আমাকে দেখো, বিলেতে ছিলাম । চলে এসেছি এই দেশ শাসন করবো বলে । বিলেতে সব কিছুই ভাল কিন্তু কেউ কাউকে পাত্তা দেয় না। আমি যে এত বড় নেতা, সেটা সবাই বুঝতে চায় না। কিন্তু এই দেশের মত এত আরাম নাই। কাজ না করে শুধু এই দেশেই ইনকাম করা যায়, বিলেতে সেটা করা যায় না। কিন্তু এখানে ও আর ভাল লাগছে না। এত ছোট একটা দেশের মন্ত্রী, বলতে লজ্জা লাগে। আচ্ছা মোমিনুর, সচিবলায় থেকে কতগুলো ফাইল এসেছে ?
-স্যার আর ও একটি কেবিনেট কিনা লাগবে । সবগুলো কেবিনেট ফাইলে পরিপূর্ণ।
-ও কে । সচিবকে ফোন করে বলে দাও । আর বলে দিও, কোন ফাইলে সাইন নিতে হলে ৩০ দিন আগে পাঠাতে হবে। কোন ফাইলের উপরে যেন ইমারজেন্সি না লেখে । ‘ইমারজেন্সি’ শব্দটি আমার পছন্দ নয়। ১/১১ এর সরকার ইমারজেন্সির নামে রাজনৈতিক নেতাদের সাথে যা করেছে, তাতে ইমারজেন্সি শব্দটি বাংলাদেশে ব্যান্ড করে দেয়া উচিৎ ।
-জ্বি স্যার। স্যার আমার একটা কথা ছিল।
-বল। স্যার আপনি অনেক দায়িত্বহীন কাজ করলে ও দায়িত্বহীন উক্তির জন্য কোন পুরস্কার পাননি। আপনাদের মন্ত্রিসভার কেউ না কেউ এই পুরস্কারটা নিয়ে যায়। যেমন, “কম খান; আইন শৃঙ্খলা ১০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে ভাল, স্টুপিড, রাবিশ, ইত্যাদি। এইবার আপনার সুযোগ। এমন কিছু বলবেন যাতে প্রাইজটা কেউ নিতে না পারে ।
-তাইতো । স্যার চিন্তায় পড়ে গেলেন । এই ব্যাপারে আর কেউ কি কোনও মন্তব্য করেছে ?
- জ্বি স্যার। বরাবরের মতই মাননীয় পুলিশমন্ত্রী প্রতিযোগিতায় এগিয়ে আছেন।
-উনি কি বলেছেন?
- স্যার এর মধ্যে আর একটা ঘটনা ঘটেছে। বি জি বির সদস্যরা ভারতীয় চোরাকারবারিদের দিকে গুলি ছুড়েছে। আর তাই, বি এস এফ একজন বি জি বি সদস্যকে ধরে নিয়ে গেছে।
-যাবেই তো । বি জি বি সদস্যদের মাথায় কি এখনও কোনও বুদ্ধি হল না !! কোন সাহসে ভারতের নাগরিককে গুলি করে ! তো, আমাদের মন্ত্রী কি বলেছেন ?
-উনি বলেছেন যে, বি জি বি সদস্য নাকি নিজেই বি এস এফ এর কাছে আশ্রয় নেয়ার জন্য গিয়েছেন ।
- উনি তো ভাল কথাই বলেছেন। এই কথায় এবার প্রাইজ পাবেন না।
-স্যার, সকাল পর্যন্ত উনি তাই প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ছিলেন না। তবে এখন উনি বেশ ভাল অবস্থানে আছেন।
-কেন?
-কিছুক্ষণ আগে ঐ বি জি বি সদস্যকে বি এস এফ ফেরত দিয়েছে। কিন্তু কয়েকটা দাঁত ছাড়া, আর সারা শরীরে নির্যাতনের চিহ্ন। মানুষ বলতেছে, শত্রুর কাছে আশ্রয় নিলেও নাকি, শত্রু আঘাত করে না, আর ভারত তো আমাদের বন্ধু !
- স্যার আবার চিন্তায় পড়লেন । পুরস্কারটা এবার আমাকে পেতেই হবে। আর কেউ কি প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আছে ?
-আছে। আমাদের টাকা-মন্ত্রী। কিন্তু উনি মনে হয় পাবেন না। উনি বলেছেন আমাদের অর্থনীতি খুব ভাল। কিন্তু আইনশৃঙ্খলা নিয়ে পাবলিক এই রকম বাণী অনেক শুনেছে ।
-হুমম । কিন্তু বাংলাদেশিদের সবকিছু বেশিদিন মনে থাকে না। ৫ বছর পর সব ভুলে যায়। তাই ভাবছি মাঝখানের ৫ বছর আবার বিলেতে ছুটি কাটিয়ে আসবো। ব্লগ আর ফেসবুকের অবস্থা কি?
- স্যার, ব্লগের অবস্থা ভাল না। পোলাপাইন সব লেখক হয়ে গিয়েছে । আর আপনি যেদিন ব্লগকে পর্ণোগ্রাফি বললেন, তারপর থেকে সবাই হুমড়ি খেয়ে ব্লগে ঢুকতেছে । তারা ভারতীয় পণ্য বর্জন করার জন্য আন্দোলন করতেছে। তবে খুশির খবর হল, আমি তাদের পণ্যের লিস্ট দেখেছি। ফেনসিডিলের নাম ঐ লিস্টে নাই।
-তাও ভাল। আমাদের বুদ্ধিজীবী কলামিস্টদের খবর কি ? উনারা কি করতেছেন?
-স্যার, আমাদের এক বিলেতি কলামিস্ট মেজর জিয়াউল হককে মেজর জিয়া বলে লিখে বি এন পিকে ঘায়েল করার চেষ্টায় ব্যস্ত আছেন। কেউ কেউ টিপাই মুখ নিয়ে লিখে পাবলিকের অসংখ্য প্রতিবাদের মুখে ল্যাপটপকে স্যাভলনে ভিজিয়েছেন। আর বাকিরা দুই বছর পর কি করবেন এই চিন্তায় আছেন।
-ফেসবুকের কি অবস্থা ?
-স্যার, আরিফ জেবতিক নামে একজন লিখেছে “কহিলাম, ` জানেন নাকি ফেসবুকে রব উঠেছে-ভারতীয় পণ্য বর্জন করো। ` প্রভু চিন্তিত মুখে বলিলেন, `বাকিগুলো না হয় পারিবে, কিন্তু সৈয়দ আশরাফরে বর্জন করিবে কীভাবে, উনি তো আবার এই দেশের মন্ত্রীও। `”
খারাপ খবর হল, এই লেখায় প্রায় ৫০০ জন লাইক দিছে ।
-ওর নামে রুল জারি হয় নাই?
-না স্যার। এর দুইটা কারণ। ১/ এখানে হায়াত-মউত নিয়ে কিছু বলা হয় নাই, হায়াত-মউত না থাকলে রুল জারি হয় না। ২/ উনি মনে হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নন। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের প্রতি তৃতীয় শ্রেণী প্রাপ্তদের বিশেষ এক ধরনের ক্ষোভ থাকে।
-মানহানি মামলা হয় নাই ?
-না স্যার, তাহলে লোক জানাজানি হবে, তাতে আপনার আর মানহানি হবে।
-হুমম। একটা কাজ কর। ওর নামে ২০০ মানহানির মামলা কর। বলো, প্রভুর মানহানি হয়েছে। সরকার প্রভুর মান নিয়ে খুব চিন্তিত।
- ও কে স্যার।
বিকেল হল। স্যারের মাথায় শুধু চিন্তা কিভাবে প্রাইজটা পাওয়া যায়। এবার প্রাইজটা পেতেই হবে। স্যারের মিটিং শেষ হল। সাংবাদিকরা স্যারের কথা শোনার জন্য অপেক্ষা করছেন। স্যারকে খুবই চিন্তিত মনে হচ্ছে। মোমিনুর শুধু প্রভুকে স্মরণ করছে। সাংবাদিকের প্রশ্ন, একজন বাংলাদেশিকে বি এস এফ এর এমন নির্যাতনের ঘটনায় আপনার মন্তব্য কি ? স্যারের সামনে অনেক ক্যামেরা, মাইক্রোফোন। সবাই চুপ। স্যার এখনই বলা শুরু করবেন। স্যার বলে উঠলেন, “এই সব ব্যাপার নিয়ে আমরা চিন্তিত নই ............”। বি এস এফ এদেশকে ন্যাংটা করে নির্যাতন করলেও আমরা চিন্তিত নই...। সাথে সাথেই মোমিনুর অতি আনন্দে জ্ঞান হারাল। এইবার স্যারের প্রাইজ কেউ নিতে পারবে না। স্যারের মুখে হিমালয় জয়ের হাসি। বি এস এফ নতুন কোন বাংলাদেশির অপেক্ষায়!
বিঃ দ্রঃ এই লেখার প্রতিটি চরিত্র কাল্পনিক। কারো সাথে কোন প্রকার মিল পেলে তা নিতান্তই কাকতালীয়- লেখক ।
বাংলাদেশ সময় ১৪৫৫ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ০৭, ২০১২