ঢাকা, রবিবার, ৭ পৌষ ১৪৩১, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

মুক্তমত

স্বাধীনতার উজ্জ্বল নক্ষত্র: বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিব

চেমন আরা তৈয়ব, অতিথি লেখক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২০১২ ঘণ্টা, আগস্ট ৭, ২০২১
স্বাধীনতার উজ্জ্বল নক্ষত্র: বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিব

বাংলা ও বাঙালির প্রিয় স্বাধীনতা অর্জনের পেছনে যে মহীয়সী নারী কখনও পর্দার অন্তরালে, কখনও বাড়ির আঙ্গিনায় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী ও জনগণের সাথে মিলেমিশে অসীম ভূমিকা রেখেছেন, তিনি আর কেউ নন- আমাদের সবার শ্রদ্ধেয় বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিব, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সহধর্মিনী।

১৯৩০ সালের ৮ই আগস্ট গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ার শেখ পরিবারে ফুল হয়ে মায়ের কোলে যে হাসি ফুটেছিল- নাম তার ‘রেণু’।

ছোট্ট রেণু ৩ বছর বয়সে পিতা শেখ জহুরুল হক এবং ৫ বছর বয়সে মাতা হোসনে আরা বেগমকে হারান। এক ভাই দুই বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন ছোট। ৫ বছর বয়সে পিতৃ-মাতৃহীন রেণুকে ঘরে তুলে নেন শেখ মুজিবুর রহমানের মা বেগম সায়রা খাতুন। তিনিই তাঁকে নিজের ছেলেমেয়েদের সঙ্গে শিক্ষা-দীক্ষায় বড় করে তোলেন। ১৯৪১ সালে মাত্র ১১ বছর বয়সে বঙ্গবন্ধুর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন তিনি।  

বঙ্গবন্ধু কারাগারে থাকাকালীন সময়ে দলের সংকটে বঙ্গমাতার গঠনমূলক পরামর্শ ও সমস্যা সমাধানের ভূমিকা অনস্বীকার্য। তাঁর এ অসামান্য অবদান আগামী প্রজন্মের কাছে তুলে ধরা সকলের নৈতিক দায়িত্ব।

তিনি ছিলেন ২ কন্যা ও ৩ পুত্র সন্তানের জননী। আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনা এবং শেখ রেহানা তাঁর যোগ্য উত্তরসূরি। বঙ্গমাতা ছিলেন ধৈর্য্যশীল, শান্ত, বুদ্ধিমতি, ধর্মপরায়ণ ও অমায়িক। পারিবারিক দায়িত্ব পালনে ছিলেন একনিষ্ঠ। শ্বশুর-শাশুড়ির সেবা, আত্মীয়স্বজনের খোঁজখবর নেয়া, দেখাশোনা করা, ছেলেমেয়েদের মানুষ করে গড়ে তোলা- সবকিছুতে ছিলেন নিখুঁত পারদর্শী। এসবের পাশাপাশি সকল কাজে বঙ্গবন্ধুকে সাহস যুগিয়েছেন প্রতিনিয়ত। জাতির পিতার অবর্তমানে পরিবার ও রাজনীতি দুটোই সমানভাবে সামলেছেন। স্বামীর জন্য খাবার সাথে নিয়ে ছেলেমেয়েসহ জেলখানায় বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছেন। দলের নেতাকর্মীদের সহযোগিতায় এগিয়ে এসেছেন, মামলার খোঁজখবর নিয়েছেন। বঙ্গবন্ধুর কারাবাসকালে যখন অসহায় বাঙালি অত্যাচারে-শোষণে অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়েছে, তখনই হাল ধরেছেন বঙ্গমাতা।

আমাদের জাতীয় ইতিহাসের এই মহীয়সী নারী বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিব শৈশবে বঙ্গবন্ধুর সাথে একই পরিমন্ডলে বড় হয়েছেন। তাই দু’জনের মৌলিক মিল, চরিত্রগত ঐক্য ছিল অসাধারণ। এ দু’জনের জীবন-সাধনা ও দর্শনের যে অপূর্ব মিল, তা দেখে মনে হয় তাঁরা যেন বাঙালি জাতির জীবনে এক জোড়া স্বর্গীয় দূত।  

পৃথিবীর ইতিহাসে সহযোদ্ধা হিসেবে বিভিন্ন রাজনীতিকের স্ত্রীর ভূমিকা স্বীকৃত। হুদাইবিয়ার সন্ধির পূর্বে মহানবী হযরত মুহম্মদ (সঃ) উম্মুল মোমেনিন বিবি সালমা (রাঃ) এর সাথে পরামর্শ করেছিলেন বলে ঐতিহাসিক বর্ণনা আছে। ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ রেসকোর্স ময়দানে ১৯ মিনিটের সেই কালজয়ী ঐতিহাসিক ভাষণের পূর্বে বঙ্গবন্ধুও বঙ্গমাতার সাথে পরামর্শ করেছিলেন। ৬ মার্চ, ১৯৭১ সারারাত বঙ্গবন্ধু বিচলিত, অস্থির ছিলেন তিনি কী বলবেন তাঁর জনগণকে, তা নিয়ে। বেগম মুজিব বলেছিলেন, “তুমি যা বিশ্বাস কর, তা-ই বলবে”। বঙ্গমাতার পরামর্শকে মাথায় রেখেই রেসকোর্স ময়দানের সেই ভাষণ দেন বঙ্গবন্ধু আর তার সাথেই রচিত হয় বাঙালি জাতির এক অনবদ্য ইতিহাস।

বঙ্গবন্ধুর পাশাপাশি বঙ্গমাতাও হৃদয়ে পোষণ করেছিলেন একটি স্বপ্ন- দারিদ্র্যমুক্ত, স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ। বাঙালি জাতির পরম সৌভাগ্য যে বঙ্গবন্ধুর জীবনসঙ্গিনী ছিলেন মানবিক মর্যাদাসম্পন্ন, সংগ্রামী ও প্রতিবাদী এক সাহসী যোদ্ধা; যিনি আন্দোলনরত জনগণকে শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে শক্তি, সাহস ও উদ্দীপনা যুগিয়েছিলেন। সেই আত্মমর্যাদাসম্পন্ন, আত্মপ্রত্যয়ী, অতুলনীয় ব্যক্তিত্বের অধিকারি একজন বীরযোদ্ধা আমাদের বঙ্গমাতা।  

স্বামী শেখ মুজিব সম্পর্কে বঙ্গমাতার মনোভাব ফুটে উঠে বঙ্গবন্ধুকে তাঁর লেখা চিঠিতে- “আপনি শুধু আমার স্বামী হওয়ার জন্য জন্ম নেননি, দেশের কাজ করার জন্যও জন্ম নিয়েছেন। দেশের কাজই আপনার সবচাইতে বড় কাজ। আপনি নিশ্চিন্ত মনে আপনার কাজে যান, আমার জন্য চিন্তা করবেন না। আল্লাহর উপর আমার ভার ছেড়ে দিন”। জাতির পিতার অগাধ বিশ্বাস ছিল বঙ্গমাতার উপর। স্ত্রীর প্রতি মনোভাবের পরিচয় পাই বঙ্গবন্ধুর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে- “রেণু খুব কষ্ট করতো কিন্তু কিছুই বলতো না, নিজে কষ্ট করে আমার জন্য টাকা পয়সা যোগাড় করে রাখতো- যাতে আমার কষ্ট না হয়”। বাঙালির স্বাধীনতার পক্ষের শক্তিকে বলিষ্ঠ ও দৃঢ় করে তোলার জন্য এভাবেই সকলের আড়ালে কাজ করে গিয়েছিলেন বঙ্গমাতা, হয়ে উঠেছিলেন মানবিক চেতনার এক অনবদ্য প্রতীক।

সভ্যতার অগ্রযাত্রার মিছিলে যখন এই পৃথিবী ধাবমান, তখন বাঙালিদের পিছিয়ে রেখেছিল পশ্চিমারা। সেই পিছিয়ে পড়া বাঙালিদের এগিয়ে যেতে যে আলোর মশাল হাতে জ্বালিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু, তার পিছনে অবিচল প্রেরণা দিয়েছিলেন বঙ্গমাতা। বঙ্গবন্ধুর মত বঙ্গমাতাও বাঙালিদের বুঝিয়েছিলেন, এদেশের দারিদ্র্য, হাহাকার, ব্যর্থতা, জীর্ণতা আমাদের ভূষণ নয়। অত্যাচারে, নির্যাতনে, নিপীড়নে আমরা আর জর্জরিত হতে চাই না। বঙ্গমাতার দৃঢ়তা ও উৎসাহে পরবর্তী সময়ে বাঙালি চিত্তরঞ্জন দাসের কবিতাকে মনে ধারণ করেছিল-
“মোছ আঁখি, মনে কর এ বিশ্বসংসার,
কাঁদিবার নহে শুধু বিশাল প্রাঙ্গণ
রাবণের চিতাসম যদিও আমার,
জ্বালিছে জ্বলুক প্রাণ, কেন গো ক্রন্দন?”

বঙ্গমাতার ছিল অপরাজেয় আত্মশক্তি, অসীম সাহস ও বাংলার জনগণের প্রতি অগাধ বিশ্বাস। জাতির পিতা ও বঙ্গমাতার প্রথম সন্তান মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মুখে শুনি- “আমি তাঁর বড় মেয়ে, আমার সঙ্গে মায়ের বয়সের তফাৎ খুব বেশি ছিল না। তাঁর মা নেই, বাবা নেই, কেউ নেই। বড় মেয়ে হিসেবে আমিই ছিলাম মা, আমিই বাবা, আমিই বন্ধু। কাজেই ঘটনাগুলো আমি যতটা জানতাম আর কেউ জানত না। আমি বুঝতে পারতাম। ভাইবোন ছোট ছোট, তারা বুঝতে পারত না। ” নিজের দেখা মাকে তিনি তুলে ধরেছেন এভাবে- “কখনও অভাব কথাটা মায়ের কাছ থেকে শুনিনি। এমনও দিন গেছে, বাজার করতে পারেননি। আমাদের কিন্তু কোনদিন বলেন নি, আমার টাকা নেই, বাজার করতে পারলাম না। চাল-ডাল দিয়ে খিচুড়ি রান্না করেছেন; আচার দিয়ে বলেছেন, ‘প্রতিদিন ভাত ভালো লাগে নাকি? আজকে গরিব খিচুড়ি খাব, এটা খেতে খুব মজা’। আমাদের সেভাবে খাবার দিয়েছেন। একজন মানুষ তাঁর চরিত্র দৃঢ় থাকলে যে কোন অবস্থা মোকাবেলা করার মত ক্ষমতা ধারণ করতে পারেন। প্রতিটি পদে তিনি সংগঠনকে, আওয়ামী লীগকে শক্তিশালী করেছেন, তবে প্রকাশ্যে আসতেন না। ”

কি বিচিত্র এ ভূমি! যেখানে স্মরণের আবরণে মরণকে চাপা দেওয়া আবার মরণকে অতিক্রম করে স্মরণের ডালা সাজানো। যে মাসে কুসুমিত ইস্পাত বঙ্গমাতা এবং তাঁর বড় ছেলে শেখ কামালের জন্ম, সে মাস এখন বাঙালি জাতির জীবনে শোকের মাস রূপে ফিরে আসে প্রতি বছর। এই শোকের জন্ম ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট। সময় রাতের শেষপ্রহর, ফজরের আযান হচ্ছে মসজিদে মসজিদে, ঠিক তখনই বিশ্বাসঘাতকদের প্রাণঘাতী বন্দুকের মুখোমুখি হয়েছিলেন বঙ্গমাতা। বাংলা ও বাঙালির মুজিবকে তিনি কখনও একান্ত নিজের করে রাখেননি। কারণ তিনি জানতেন মুজিব মানে স্বাধীন বাংলাদেশ।  

১৯৭৫ এর ১৫ই আগস্ট। স্বাধীন বাংলাদেশকে রক্তাক্ত করে ঘাতকের দল মাটিতে মিশিয়ে দিল বঙ্গবন্ধু, বঙ্গমাতা, কামাল, জামাল ও শিশু রাসেলসহ পুরো পরিবারটিকে।  

স্বাধীনতার জন্য বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাঙালি জাতির আন্দোলন-সংগ্রামের যে গৌরবজনক বীরত্বগাথা, তার বিপরীতে সেই ভয়ঙ্কর রাতে ইতিহাস রুপ নিয়েছিল নৃশংসতার, ভয়াবহতার। যে মহান নেতার নেতৃত্বে পৃথিবীর মানচিত্রে অভ্যুদয় ঘটে বাংলাদেশ নামক নতুন রাষ্ট্রের, ১৫ আগস্টের কালরাতে বিশ্বাসঘাতকরা স্বাধীনতার সেই মহান স্থপতি ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের রক্তেই ভেজালো সোনার দেশের মাটি। কি দুর্ভাগ্য আমাদের!

কিন্তু বঙ্গবন্ধু তো অমর, তিনি কখনো মরেন না। অমর বঙ্গমাতা ও সে রাতে নিহত সকল শহীদ। রবীন্দ্রনাথের ভাষায়-
“এনেছিলে সাথে করে মৃত্যুহীন প্রাণ,
মরণে তাহাই তুমি করে গেলে দান”

সময়ের পথ বেয়ে টুঙ্গিপাড়ার শেখ মুজিবুর রহমান হয়ে উঠেছিলেন বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা, বঙ্গবন্ধু, জাতির পিতা সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি। তাঁর এই দীর্ঘ পথপরিক্রমা ও সকল অর্জনের পিছনে রয়েছে বঙ্গমাতার অসামান্য অবদান। ছিল তাঁর পরিচর্যা, শুশ্রুষা, ভালোবাসা, নির্দেশনা-যা বঙ্গবন্ধুর আত্মবিশ্বাসকে সুদৃঢ় করে তুলেছিল।  

বঙ্গবন্ধুর পাশে বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন নেছার নামটি যদি লেখা না হয়, তাহলে স্বাধীন বাংলার এবং স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস লেখা হবে না। দূরদর্শী, ধৈর্য্যশীল, অসাধারণ স্মৃতিশক্তির অধিকারী, অনিন্দনীয় বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিবের তুলনা তিনি নিজেই; যিনি বঙ্গবন্ধুর জীবন্ত ডায়রী, আমাদের বঙ্গমাতা। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর ডাকে মুক্তিযুদ্ধের বিনিময়ে অর্জিত বাংলাদেশে বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিব বিনম্র শ্রদ্ধা ও ভালবাসায় উজ্জ্বল নক্ষত্র হয়ে থাকবেন চিরকাল। তাঁর প্রতি অতল শ্রদ্ধা।

লেখক: চেয়ারম্যান, জাতীয় মহিলা সংস্থা ও সাবেক সংসদ সদস্য

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।