ঢাকা, সোমবার, ৮ পৌষ ১৪৩১, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

মুক্তমত

আমার কিশোরমনের সেলিব্রেটি টিংকু ভাই

আজাদ তালুকদার, অতিথি লেখক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২২৫৪ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ৯, ২০১২
আমার কিশোরমনের সেলিব্রেটি টিংকু ভাই

স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন তখন তুঙ্গে। আন্দোলনের স্ফুলিঙ্গ ছড়িয়ে পড়ে শহর-বন্দর ছেড়ে গ্রামের মেঠোপথে।

সেই আন্দোলনের তীব্রতা দোলা দিয়ে যায় আমার কিশোর মনে। তাই স্কুল কামাই করে, হাউস টিউটর ফাঁকি দিয়ে মিলিয়ে যেতাম স্বৈরাচারবিরোধী স্থানীয় মিছিল-মিটিংয়ে। এলাকার বড়ভাইদের সঙ্গে সুর মেলাতাম ‘আগামীকাল রোববার, পূর্ণদিবস হরতাল,’ ‘গাড়ির চাকা ঘুরবে না’, ‘দোকানপাট খুলবে না’সহ অগ্নিঝরা নানা স্লোগানে।

’৯০ এর ৬ ডিসেম্বর স্বৈরাচারী এরশাদ সরকারের পতনের আগ পর্যন্ত রাঙ্গুনিয়া থানার মোড়, রাঙ্গুনিয়া কলেজ গেট, রোয়াজারহাট এলাকায় এভাবেই মিছিলে মিছিলে লাফিয়েছি, কখনো বা এগিয়ে গেছি মারমুখী ভঙ্গিতে। আর সেই সময়টাতে আমার চেতনায় ‘অন্যরকম’ এক চরিত্র হয়ে ধরা দেন ডা. জাহাঙ্গীর সাত্তার টিংকু। আড্ডা-আলোচনায়, মিছিল-মিটিং, কিংবা খবরের কাগজ- সবখানেই ডা. জাহাঙ্গীর সাত্তার টিংকুর একচ্ছত্র সুনাম। ছাত্ররাজনীতির আকাশে যেন এ এক নতুন ধ্রুবতারা, নতুন সেলিব্রেটি। বলাবাহুল্য, সেই থেকেই আমি জাহাঙ্গীর সাত্তার টিংকুর অসম্ভব ভক্ত।

‘ছেলেবেলার রাজনৈতিক সংশ্রব’ ছেড়ে লেখালেখি ও সাংবাদিকতায় আসার পরও টিংকু ভাইয়ের প্রতি সেই ভালোলাগা এতটুকু কমেনি। ‘রাজনীতি’ প্রসঙ্গে কিছু লিখতে গেলেই টিংকু ভাইয়ের সহযোগিতা নিতাম, কমেন্ট ছাপতাম। একটা সময়ে গিয়ে তার কাছাকাছি যাওয়ার সুযোগ হয়। পেয়েছি তার অপত্য স্নেহও।

টিংকু ভাই প্রায়ই বলতেন, ঢাকা গেলে তার সঙ্গে যেন দেখা করি। তাই ১৯৯৯ সালের দিকে  কোনো এক কাজে ঢাকা গিয়ে ফেরার আগে ফোন দিয়েছিলাম টিংকু ভাইয়ের মোবাইল ফোনে। বললেন, ‘আমি অফিসে আছি, এখনই আস। ’

লোকেশন জানানোর পর বললাম, ‘জোনাকি সিনেমা হলটা কোথায় যেন টিংকু ভাই!’ অপর প্রান্তে মস্তবড় একটা হাসি দিয়ে টিংকু ভাই বললেন, ‘চট্টগ্রামের ছেলেদের এ একটাই সমস্যা, ঢাকা শহর চেনে না!’
 
এরপর বললেন, ‘একটা টেক্সি নিয়ে জোনাকি সিনেমার কথা বলো, টেক্সিওয়ালা সোজা নিয়ে আসবে। জোনাকির কাছে এসেই ফোন করো আমাকে। ’ এরপর ট্যাক্সি চেপে আধঘণ্টার মধ্যেই পৌঁছে গেলাম জোনাকি সিনেমার কাছে। টিংকু ভাইয়ের লোক এসে সেখান থেকে আমাকে নিয়ে গেলেন তার অফিসে।

এই প্রথম দেখা টিংকু ভাইয়ের সঙ্গে। টিংকু ভাইকে যতই দেখছি ততই আমি মুগ্ধ হচ্ছি। কথা বলার ধরণ, ব্যক্তিত্ব, স্মার্টনেসের সঙ্গে নান্দনিক চেহারা সৌষ্ঠবের এমন পুরুষ পরবর্তী সময়েও আমি আর দেখিনি। অনেকগুলো মেন্যু দিয়ে সেদিন দুপুরে খাওয়ালেন টিংকু ভাই। দিলদরিয়া এই মানুষটি খাওয়া-দাওয়ার ব্যাপারে কতটা রুচিশীল ছিলেন সেদিনই তা বুঝেছি।

২০০০ সালের দিকে আমার মাকে নিয়ে চিকিৎসার জন্য চেন্নাই যাবো। পেশায় চিকিৎসক বিধায় কথাপ্রসঙ্গে পরামর্শ ও টিপস চাইলাম টিংকু ভাইয়ের কাছ থেকে। তিনি বললেন, ‘আমি কাল চট্টগ্রাম যাচ্ছি। পারলে বাসায় আস, কথা হবে সামসামনি। ’ সে অনুযায়ী টিংকু ভাইয়ের নাসিরাবাদ হাউজিং সোসাইটির মেরিনা মঞ্জিলের বাসায় হাজির হই। তখন সেখানে বাসা শিফটিংয়ের কাজ চলছে। এর মাঝেই মেসেজ পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে ডেকে পাঠালেন ব্যালকনিতে, যেখানে একটি সুদৃশ্য চেয়ারে বসে আছেন টিংকু ভাই। আর সেই চেয়ারের হাতলে বসে আছেন ভাবি কোগেস্টা নূর-এ-নাহারিন মুন্নি। ‘ছোটভাই’ সম্বোধন করে ভাবীর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন।

ভাবীও যথেষ্ট সদালাপি, স্মার্ট এবং প্রাণবন্ত স্বভাবের মানুষ। দুজনের আলাপচারিতা, বোঝাপড়া দেখে মনে হলো তারা কেবল আদর্শ স্বামী-স্ত্রী কিংবা সুখী দম্পতিই নন, একে অপরের ভালো বন্ধু, গাইড, ফিলোসফার সর্বোপরি ব্যবসায়িক পরামর্শক। যতদূর জানি, টিংকু ভাইয়ের এটকো পারিশায় (কনস্ট্রাকশন ফার্ম) পরামর্শ-সহযোগিতা দেওয়া ছাড়াও মুন্নি ভাবি ‘মডার্ন সিকিউরিটিস’ নামে একটি স্বতন্ত্র ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেন। ভাবী এই প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের মেম্বার।

একটা সময়ে ফেসবুকই হয়ে ওঠে টিংকু ভাইয়ের সঙ্গে যোগাযোগের প্রধান মাধ্যম। ফেসবুকে সপ্তাহে অন্তত একবার ‘চ্যাট’ হতো তাঁর সঙ্গে। জানা হতো তার বিদেশ ট্যুর, ব্যবসা-বাণিজ্য, ভাবি-সন্তানদের (ধ্রুব সাত্তার ও শ্রেয়সী সাত্তার) খবরাখবর। সুযোগ পেলেই ভাবী-বাচ্চাদের নিয়ে বিদেশ বেড়াতে যেতেন টিংকু ভাই। যুক্তরাষ্ট্র, লন্ডন, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, দুবাই ও আটলান্টিক সিটিতে ঘুরে বেড়িয়েছেন মুক্ত বিহঙ্গের মতো। বিদেশের দর্শনীয় স্থানে ছবি তুলে তা ফেসবুকে আপলোড করতেন টিংকুভাই ও ভাবী। আমরা সেখানে ‘লাইক’ দিতাম, কমেন্ট করতাম। ব্যস্ততার মাঝেও এসবের জবাব দিতেন টিংকু ভাই।
টিংকু ভাইয়ের ছেলে ধ্রুব সাত্তারও আমার ফেসবুক ফ্রেন্ড। বাবা-ছেলে দুজনের সঙ্গে বন্ধুতা বলে ফেসবুকে মুন্নি ভাবী, ছোটমেয়ে শ্রেয়সীর উপস্থিতিও পাওয়া যেত প্রায় সময়। দেখা যেত তাদের ‘ফেসবুক একটিভিটি’ ও পারিবারিক ফটোগ্রাফ। সবমিলিয়ে সার্বক্ষণিক টিংকু ভাই ও তার পরিবারের কাছাকাছিই ছিলাম বলা যায়।

আমার প্রিয় সেই টিংকু ভাই আর নেই, আর কখনোই ভাবি-সন্তানদের সঙ্গে ফেসবুকে কিংবা বিদেশের কোনো ছবিতে দেখা যাবে না টিংকু ভাইকে’ সেই কষ্ট আমাকে অনেকদিন ভোগাবে, তাড়িয়ে বেড়াবে।

টিংকু ভাই, যেখানেই থাকেন, সেই হাসিখুশি প্রাণবন্ত মানুষটিই হয়ে থাকেন স্বর্গের বাসিন্দাদেরকেও আনন্দে মাতিয়ে রাখুন- এ প্রার্থনা করি।

আজাদ তালুকদার: সাংবাদিক, চট্টগ্রাম থেকে প্রকাশিত একুশে পত্রিকার সম্পাদক

বাংলাদেশ সময়: ২২৪১ ঘণ্টা, ০৯ ফেব্রুয়ারি, ২০১২

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।