অতিসম্প্রতি বাংলাদেশে শিশুদেরকে করোনার টিকা প্রদানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে। ৪ সেপ্টেম্বর স্বাস্থ্যমন্ত্রী দেশবাসীকে সিদ্ধান্তটি জানান।
করোনার টিকা মানুষের শরীরে প্রদানের আগে নানারকম পরীক্ষা বা ট্রায়ালের মধ্য দিয়ে নিরাপদ বলে প্রমাণিত হতে হয়। সুনির্দিষ্ট বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি ও রীতিনীতি অনুসরণ করে এই ট্রায়ালের কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়। ট্রায়ালের ফলাফল জার্নালে প্রকাশ করা বিধেয়। প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্ত বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক সংস্থা নানাভাবে পরীক্ষা ও বিচার-বিশ্লেষণ করে। টিকাটি নিরাপদ ও কার্যকর প্রমাণিত হলেই কেবল সেটি মানবদেহে ব্যবহারের অনুমোদন দেওয়া হয়। প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের শরীরে নিরাপদ ও কার্যকর প্রমাণিত হওয়ার পরে টিকাটিকে শিশুদের শরীরে ব্যবহারের জন্য পুনরায় শিশুদের নিয়ে ট্রায়াল সম্পন্ন করতে হয়। সুনির্দিষ্ট বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি অনুসরণ করে ধাপে ধাপে এই ট্রায়াল অনুষ্ঠিত হয়। নিরাপদ ও কার্যকর প্রতীয়মান হওয়ার পরে টিকাটি শিশুর শরীরে প্রদান করার অনুমতি দেওয়া হয়। টিকার ট্রায়ালের বিষয়টি অনেকটা খোলা বইয়ের মতো। যে কেউ ইচ্ছা করলে এর ফলাফল দেখতে পারে।
বর্তমানে পৃথিবীতে মোট চারটি করোনার টিকা শিশুদের দেওয়া হচ্ছে। এগুলো হলো- ফাইজার-বায়োনটেক, মর্ডানা, সিনোভ্যাক ও সিনোফার্মের তৈরি করা টিকা। প্রতিটি টিকাই সফলভাবে তিন পর্যায়ের ট্রায়ালে উত্তীর্ণ হওয়ার পরে মানবশিশুর শরীরে দেওয়া হচ্ছে। ফাইজার-বায়োনটেকের টিকা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া ও ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোতে ১২-১৭ বছর বয়সীদের ব্যবহারের জন্য অনুমোদন পেয়েছে। মর্ডানার টিকা যুক্তরাষ্ট্রে ১২-১৭ বছরের শিশুদের দেওয়ার জন্য অনুমোদিত হয়েছে। সিনোফার্মের টিকা ৩-১৭ বছরের শিশুদের প্রদানের জন্য অনুমোদন পেয়েছে চীন এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতে। সিনোভ্যাকের টিকা শুধু চীনে ৩-১৭ বছরের শিশুদেরকে দেওয়া হচ্ছে।
এই চারটি টিকাই শিশুদের শরীরে নিরাপদ ও কার্যকর বলে বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত হয়েছে।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সবদিক বিবেচনা করে আমাদের জন্য কোন টিকাটি উপযুক্ত? যে টিকাটি আমাদের সন্তানের প্রদান করা হবে সেটা অবশ্যই নিরাপদ ও কার্যকর হতে হবে। দেশে আনার পর সঠিক তাপমাত্রায় টিকার স্টোর করার ব্যবস্থা থাকতে হবে। নিয়মিত প্রাপ্যতার বিষয়টি অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ এবং মূল্যটি ক্রয়সীমার মধ্যে থাকলে ভালো হয়। ফাইজার এবং মর্ডানার টিকা মাইনাস ৭০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় স্টোর করতে হয়। রাজধানী ঢাকার বাইরে আমাদের জন্য এই টিকা দুটি স্টোর করা দুরূহ। প্রাপ্তবয়স্কদের বেলায় টিকা দুটি কেবলমাত্র ঢাকায় দেওয়া হয়েছিল।
ফাইজারের টিকার ট্রায়াল আমাদের মতো কোনো দেশের শিশুদের নিয়ে করা হয়নি। শিশুদের ক্ষেত্রে এশিয়ার কোন দেশের অভিজ্ঞতা ফাইজারের টিকার নেই। অনেকে মনে করে যুক্তরাষ্ট্রে তৈরি বলে এই টিকাটি মানে সর্বোত্তম। এট এক ধরণের প্রচারণা মাত্র। কারণ ইসরায়েলের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের করোনা ভাইরাস প্রতিরোধ ফাইজারের টিকা মাত্র ৩৯% কার্যকর বলে প্রমাণিত হয়েছে। এজন্য ইসরায়েল রুটিন হিসাবে সবাইকে তৃতীয় ডোজের ফাইজারের টিকা দেওয়া শুরু করেছে।
সিনোফার্মের টিকার শিশু-ট্রায়ালের তৃতীয় পর্যায়/চূড়ান্ত ধাপ চীন ও সংযুক্ত আরব আমিরাতে যুগপৎ সম্পন্ন করা হয়। আরব আমিরাতের ট্রায়ালে বহুজাতিক শিশুদের নির্বাচন করা হয়, যার মধ্যে ভারত উপমহাদেশীয় শিশুরাও ছিলো। ফলে আরব আমিরাতের অভিজ্ঞতা আমাদের কাজে আসবে। এই টিকাটি স্টোর করতে হয় ২-৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায়। যা আমাদের জন্য একান্ত উপযোগী। গত মধ্যে-জুলাই থেকে চীনে বিপুলসংখ্যক শিশুকে চলমান কর্মসূচির অংশ হিসেবে সিনোফার্মের টিকা প্রদান করা হয়েছে। আগস্টের প্রথম সপ্তাহ থেকে সংযুক্ত আরব আমিরাত এই টিকাটি শিশুদের দেওয়া শুরু করেছে। এই দুটি অভিজ্ঞতা আমাদের গভীরভাবে পর্যালোচনা করতে হবে। সবমিলিয়ে এখন পর্যন্ত আমাদের শিশুদের জন্য সিনোফার্মের টিকাকে সুবিধাজনক মনে হচ্ছে। তবে শেষকথা হলো- শিশুরা শারীরিকভাবে অত্যন্ত সংবেদনশীল। তাই তাড়াহুড়ো না-করে, বৈজ্ঞানিক তথ্য-উপাত্ত ও অভিজ্ঞতার চুলচেরা বিশ্লেষণ করেই শিশুদের জন্য টিকা নির্বাচন করা হোক। ন্যাটো ও ন্যাটোজোটের বাইরের দেশগুলোর মধ্যকার প্ররোচনা ও মুনাফা যুদ্ধের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে আমরা যেন আমাদের শিশুদের জন্য টিকা নির্বাচন না করি।
লেখক: চিকিৎসক ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ
বাংলাদেশ সময়: ২১২৪ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ০৬, ২০২১
নিউজ ডেস্ক