ফরীদি ভাইয়ের চলে যাওয়াটা হঠাৎ চলে যাওয়া মনে হতে পারে অনেকের কাছে।
কিন্তু বিষয়টি কি আসলে তাই?
না।
গত কিছুদিন ধরে তার চলে যাওয়াটা অনেকটা সময়ের ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছিল। জানি না বেঁচে থাকার প্রতি তাঁর অনীহা তৈরি হয়েছিলো কিনা। হয়তো হয়েছিল। নিজের শরীরের প্রতি যত রকমের অবিচার করা যায় কোনটাই বাদ দেননি তিনি। খাওয়া-ঘুম কমিয়ে দিয়েছিলেন। দেখারও কেউ ছিলো না। যে হুমায়ুন ফরীদির বাসা একসময় মানুষের ভারে গমগম করতো শেষ সময়গুলোতে সেখানে ছিল রাজ্যের শূন্যতা। শুনেছি শেষ সময়ে অনেককে ডেকেও কাছে পাননি তিনি।
একাকীত্ব ফরীদি ভাই পছন্দ করতেন না। কিন্তু শেষ দিনগুলোতে সেই যন্ত্রণাই তীব্রভাবে সইতে হয়েছে তাকে।
অল্প কয়েকদিন আগেই হাসপাতাল ঘুরে এসেছিলেন তিনি। হাসপাতালে থাকাকালে তার স্মৃতিতে কিছুই ছিল না। অতি আপনজনদেরও চিনতে পারছিলেন না তিনি। তাদের দেখে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকতেন। সে সময় তাকে হাসপাতালে দেখতে গিয়ে চোখের জল ধরে রাখতে পারেননি হুমায়ুন ফরীদির অতি স্নেহভাজন হিসেবে পরিচিত অভিনেতা জাহিদ হোসেন শোভন। কারণ কোনওভাবেই শোভন ভাই নিজেকে চেনাতে পারছিলেন না। নির্বিকারভাবে এক পর্যায়ে নিজেকেই নিজে বললেন, ‘দেখতে দেখতে জীবনটা পার করে ফেললাম’। তারপর তাঁর সেই চিরচেনা হা হা হা হাসি।
‘মানুষ মরে গেলে পচে যায় আর বেঁচে থাকলে বদলায়’- এ কথাটা আমরা প্রায়ই বলি। কিন্তু এ কথাটি ফরীদি ভাইয়ের ক্ষেত্রে খাটবে না।
যখন ছিলেন তখন তার মতোই ছিলেন অভিনয় জগতের এই রাজপুত্র। আগাগোড়া একই রকম। অনেকটা আমুদে আর পুরোটাই খেয়ালি। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত হুমায়ুন ফরীদিকে যারা চেনেন তার বিষয়টা ভালো জানেন। যতদিন ছিলেন একই রকম ছিলেন হুমায়ুন ফরীদি। বদলাননি কখনোই। রিকশায় চড়ে অভিনয় জীবনের শুরু, মাঝে আকাশ ছোঁয়া সাফল্যে প্রচুর অর্থ-বিত্ত। খ্যাতি আর অর্থ তার খোলস বদলিয়েছে কিন্তু মন বদলাতে পারেনি। শুরুর হুমায়ুন ফরীদি-ই ছিলেন শেষ পর্যন্ত।
আর মৃত্যুর পরও আর সবার মতো হারিয়ে যাবেন না এই জাত অভিনেতা। কারণ হুমায়ুন ফরীদির মতো অভিনেতারা যুগে যুগে আসে না। আর একজন হুমায়ুন ফরীদি পেতে আমাদের কতকাল অপেক্ষা করতে হয় তা নিয়তিই জানে। মঞ্চ, টেলিভিশনআর চলচ্চিত্র- একাধারে এই তিন মাধ্যমে তুমুল জনপ্রিয়তা পাওয়া একমাত্র অভিনেতার নাম হুমায়ুন ফরীদি।
ফরীদি ভাইয়ের সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত জানাশোনা ছিলো। তিনি কখনো টেলিভিশনের লাইভ প্রোগ্রামে অংশ নিতেন না। বিষয়টি তার ভালো লাগতো না। অনেকবার চেষ্টা করেও সফল হয়নি। কিন্তু গেলো বিশ্বকাপ ক্রিকেটের সময় ‘টাইম টু ক্রিকেট’ নামে একটা লাইভ অনুষ্ঠান করেছি। জানতাম ক্রিকেট পাগল ছিলেন ফরীদি ভাই। সুযোগটা কাজে লাগালাম। অনেক অনুরোধ আর আবদারের পর লাইভ অনুষ্ঠানে আসতে রাজি হয়েছিলেন। এবং তিনি অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, এটা তার প্রথম লাইভ অনুষ্ঠান। ‘টাইম টু ক্রিকেটের’ সবচেয়ে জনপ্রিয় পর্ব ছিল ফরীদি ভাইয়ের পর্ব।
অনুষ্ঠান শেষে ফরীদি ভাই হাসতে হাসতে বলেছিলেন, বুঝলানা মিয়া, আমার মতো অভিনেতা আর পাবা না। তারপর সেই হাসি আর সিগারেটের ধোঁয়া।
কথাটা হয়তো তিনি মজা করে বলেছেন। হয়তো এই কথার মাঝেই থাকতে পারে লুকনো কোনও আক্ষেপ।
ফরীদি ভাই এই সমাজ এই দেশকে অনেক দিয়েছেন। কিন্তু বিনিময়ে আমরা কি দিয়েছি?
হুমায়ুন ফরীদিরা বেশি কিছু চান না। একটু সম্মান চান।
আমরা কি রাষ্ট্রীয়ভাবে সেই সামান্য সম্মানটুকুও তাঁকে দেখিয়েছি?
এখন তিনি নেই। হয়তো মরনোত্তর কোনও পুরষ্কারের ক্রেস্টে তার নাম খোদাইয়ের কাজ শুরু হয়ে গেছে। কিন্তু মরনোত্তর পুরষ্কার এক ধরনের প্রহসন।
যে অবদান তিনি বেঁচে থাকতে রেখেছেন তার হিসেব কেন মৃত্যুর পর করা হবে!
পলাশ মাহবুব : সাহিত্যিক ও নির্মাতা। প্রোগ্রাম ম্যানেজার, বৈশাখী টেলিভিশন।
বাংলাদেশ সময় ২১০৪ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৩, ২০১২