১৯৮২ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি গণতন্ত্রের দাবিতে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের মিছিলে ‘বিশ্ববেহায়া’ স্বৈরাচারী এরশাদ সরকারের পুলিশের গুলিতে নিহত হন দীপালি সাহা , জাফর, জয়নাল, মোজাম্মেল, আইয়ুব। ১৯৮৩ সালের একই দিনে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের শান্তিপূর্ণ মিছিলে পেছন থেকে ট্রাক তুলে হত্যা করা হয় সেলিম এবং দেলোয়ার কে।
আমাদের বারবার স্মরণ করতে হবে এদের, যারা এভাবে এরশাদবিরোধী আন্দোলনে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্যে প্রাণ উৎসর্গ করেছেন। ভুলে গেলে চলবে না বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র হয়েও শ্রমিকদের পাশে থেকে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন - সেই তাজুল ইসলামকে । যেচে বর্বরতম নির্যাতন, নিপীড়ন বেছে নিয়ে জীবন উৎসর্গ করেছেন শত হাজার দেশপ্রেমিক, এই দিনে তাদের প্রতি হৃদয় উজাড় করা ভালোবাসা আর বিনম্র শ্রদ্ধা।
এই দিনটিতে বিশ্বজুড়ে ভালোবাসা দিবস পালন করা হচ্ছে। চারিদিকে যেন বেজে উঠছে , “আমার লতার একটি মুকুল ভুলিয়া তুলিয়া রেখো তোমার অলক বন্ধনে, ... মনে করে সখী বাঁধিয়া রাখিও আমার হাতের রাখি তোমার কনক কঙ্কনে...”। কথায় বলে, নারীর মন ভোলানো এ গান গেয়ে একটু পরেই ভুলে যেতে দেরী করে না স্বার্থসচেতন মানুষ। তবু মানুষ কেন ভালোবাসার এতো কাঙ্গাল?
দু’দিন আগে নারী নির্যাতনবিরোধী আইন ও তার অনুষঙ্গ নিয়ে এক প্রশিক্ষণ কর্মশালায় দিনশেষে প্রত্যেককে গান অথবা আবৃত্তি করতে হয়েছে। মাথায় হিজাব পরা পঞ্চাশ, বায়ান্ন বছরের এক নারী গেয়ে উঠলেন,
“... জাগরণে যারে না দেখিতে পাই, থাকি স্বপনের আশে,
ঘুমের আড়ালে যদি ধরা দেয়, বাঁধিবো স্বপন পাশে।
এতো ভালোবাসি এতো যারে চাই,
মনে হয় না তো সে যে পাশে নাই।
যেন এ বাসনা আকুল আবেগে তাহারে আনিবে ডাকি,
দিবস রজনী আমি যেন কার আশায় আশায় থাকি...”
তার অজান্তেই যেন দু’চোখ বেয়ে অশ্রুধারা। অন্য সহকর্মীরা প্রথমে কিছুটা বিস্মিত হলেও পরে তার সাথে কন্ঠ মিলিয়ে একই বেদনায় ভাসলেন।
রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ``প্রেমের ফাঁদ পাতা ভূবনে, কে কোথা ধরা পড়ে কে জানে। `` আবার তিনিই বলেছেন, “ভুল করে ভালোবেসো না”। তবু স্বজন, স্বদেশ, মানুষের প্রতি ভালোবাসাই পারে মানুষকে অনন্তকাল বাঁচিয়ে রাখতে। প্রাণে যতো ভালোবাসা আছে তা নিয়ে ভালো থাকার চেষ্টা করাই সবার জন্যে মঙ্গল। ভূপেন হাজারিকা তার গানে বলেছেন, “প্রেমহীন ভালোবাসা যুগে যুগে ভেঙেছে সুখের ঘর...”।
আমার বন্ধু তিস্তা (ছদ্মনাম), তার প্রেমের বিয়ে টেকেনি। কর্মক্ষেত্রে যাকে ভুল করে ভালোবেসেছিলো, একসময়ে জানা গেলো সে প্রতারণা করেছে। বিচ্ছেদ ঘটে গেলো। তিস্তা সেই চাকরি ছেড়ে অন্য পেশায় যায়। দীর্ঘ সময় পর আবার প্রেম আসে তার জীবনে। বিয়ের প্রস্তুতি ও চলতে থাকে। এর মধ্যেই তিস্তা বুঝে যায় , আবারো ভুল পথে পা বাড়াচ্ছে সে। দ্রুত ফিরে আসার সিদ্ধান্ত নেয়।
চারিদিকে যখন এমন ভাঙ্গনের খেলা, তখন আমাদের সহকর্মী রুনি এবং সাগর ভাইয়ের প্রেম, বিয়ে এবং বিবাহিত জীবন ছিল কিংবদন্তীর মতো। নিষ্ঠুরভাবে তাদের হত্যার পর তাদেও সুন্দর হাস্যোজ্জ্বল ছবিগুলো বিশ্বজুড়ে বাংলাদেশের মিডিয়াসংশ্লিষ্টদের স্বজন পরিজনের চোখের জলে ভাসছে। এতো সুন্দর বোঝাপড়া তাদের মধ্যে ছিল- কী কুক্ষণে তাদের এতোটা নির্মমভাবে হত্যা করা হলো? কেন এমন নিষ্ঠুর ছুরিকাঘাত? এভাবে রক্তে ডুবিয়ে দিলো আমাদের দুই সহকর্মীকে? ছোট্ট মেঘের মাথার উপর থেকে আকাশটা এভাবে কেড়ে নিলো কারা? শারীরিক অস্তিত্বে থাকলেও মেঘকে মানসিকভাবে হত্যা করা হয়েছে। সবার পক্ষ থেকে সহযোগিতা না পেলে মেঘের পক্ষে সুস্থভাবে বেড়ে ওঠা দুরূহ ।
গতকাল ১৩ ফেব্রুয়ারি সোমবার দুপুরে পুলিশ হেডকোয়ার্টারের সভাকক্ষে আইজিপি হাসান মাহমুদ খন্দকারকে প্রশ্ন করেছিলাম কোন হত্যার ঘটনা ঘটলেই একজন নারীকে খুঁজে নিয়ে একটি ঘটনা সাজানো হয়। তিনি ব্যতিক্রমী একজন দায়িত্বশীল ব্যক্তিত্ব। যার কাছে আমাদের প্রত্যাশা অশালীন মিথ্যাচারে তিনি প্রশ্রয় দেবেন না।
যা তখন বলতে পারিনি, আমাদের সহকর্মী বন্ধু মেহেরুন রুনিকে এবং তার স্বামী সাগর সরওয়ারকে হত্যা করা হয়েছে। দু’জন এ বর্বরতার শিকার হলেও লক্ষ্যণীয় এবং দুর্ভাগ্যজনক বিষয় হলো (সাগর ভাইয়ের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে বলছি, কেউ ভুল ব্যাখ্যা করলে অন্যায় করা হবে) রুনিকে নিয়ে নানান গল্প কাহিনী বাজারে চাউর করে দেওয়া হলো। আমি বিস্মিত হলাম তথাকথিত শালীন এবং প্রতিষ্ঠিত সাংবাদিকও এসব গল্পে অংশ নিলেন। এরকম নৃশংসতার শিকার হয়েও রুনির পরিচয় সে ‘নারী’। তাই নানান অনাচারের শিকার হতে হবে তাকে। ‘গসিপ’ হতে হবে তাকে নিয়ে। পুরুষশাসিত এ সমাজটার জন্য মাঝে মাঝে খুব করুণা হয় আমার।
সমাজে অনেক নারী-পুরুষ একেবারেই অনিয়ন্ত্রিত জীবন উপভোগ করেন। সেটাই হয়তো তাদের লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্য। রুনি এবং সাগর ভাই কেউই এমন ছিলেন না। অজাতশত্রু এ দম্পতির কঠোর সমালোচকও তাদের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ করবেন না। সমাজের অন্য স্বাভাবিক মানুষের মতোই জীবন ছিল তাদের। তারা বন্ধুহীন ছিলেন না।
দু’জনেই খুব বন্ধুবৎসল ছিলেন। রুনি বা সাগর ভাইয়ের সাথে কোন বন্ধু বা সহকর্মীর গল্প আড্ডা হতেই পারে। সেটা নিশ্চয়ই হত্যা করার মতো অপরাধ না। তবু পত্র পত্রিকায় প্রতিনিয়ত আমরা দেখতে পাই, হীন স্বার্থেও বন্ধুর হাতে বন্ধু খুন হয়। সেরকমও যদি কিছু ঘটে থাকে সত্য বলা হোক।
তদন্তের স্বার্থে বন্ধুদের জিজ্ঞাসাবাদ করতে হতে পারে। সেটা নিয়ে একটি মহল কেন অযথা চরিত্রহননে নেমেছে? কী স্বার্থ তাদের? কাদের বাঁচাতে চাইছে? যারা এই হীন স্বার্থে মাঠে নেমেছেন, তাদের উদ্দেশ্যে আমার একটি নিরীহ প্রশ্ন , ‘শেষ রক্ষা হবে তো?’
মনে রাখবেন, সত্য উদ্ঘাটন হবেই একদিন। খুনি যেই হোক আমরা যেন তার বিচারের দাবিতে সোচ্চার থাকি।
রুনি বেঁচে নেই। তার পক্ষে আত্মপক্ষ সমর্থন সম্ভব নয়। তার বন্ধু, প্রিয়জন সাগর ভাইও নেই, যিনি রুনির প্রতি কোন অন্যায় বা মিথ্যা অভিযোগ শুনলে প্রত্যাখ্যান করতে পারতেন। আমরা যারা সহকর্মী -বন্ধু এখনো বেঁচে আছি এতো বর্বর হত্যাকাণ্ডের মূল নায়কদের বাঁচাতে কোনও ধরণের অন্যায় মিথ্যাচার আমরা মেনে নেবো না। দীর্ঘদিন ক্রাইম রিপোর্টিংয়ে থেকে অনেক হত্যা, বর্বরতা, ``জজ মিয়া নাটক`` দেখেছি।
এই লেখাটা লিখতে বসে আমার এক ছোটভাই ফোন করে হতাশা আর ক্ষোভের সাথে জানালো সচিবালয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সংবাদ সম্মেলনে কিছু সাংবাদিক মুখরোচক কল্প-গল্প করছেন। তাদের বক্তব্য অনুযায়ী রুনি নাকি ভেবেছিলো সাগর ভাই সকালে আসবেন। তারা জানলেন কিভাবে এ কথা? মাছরাঙ্গা টেলিভিশনে কোনও নিউজ এডিটরকে রাতে থাকতে হয় না। একজন রিপোর্টার এবং একজন ক্যামেরাপারসন নাইট ডিউটি করেন। রুনি কেন অবাস্তব কিছু ভেবে নেবে? কী প্রমাণ নিয়ে এ ধরণের মিথ্যাচার করছেন তারা? কেনইবা করছেন? এতোটা নির্মমতার শিকার হয়েও কি রুনি একজন সহকর্মী হিসেবে অন্তত আমাদের সাংবাদিক বন্ধুদের কাছে ন্যূনতম মানবিক আচরণ আশা করতে পারেন না?
সুনির্দিষ্ট তথ্য প্রমাণ সংগ্রহ করে পুলিশ প্রশাসন থেকে স্বচ্ছতার সাথে জানানো হোক হত্যাকারী কে, তার মোটিভ কী ছিল? খুনি যেই হোক, আমরা অপরাধীর দৃষ্টান্তমূলক সাজা চাই। আমাদের গোয়েন্দারা অনেক আধুনিক প্রযুক্তি দিয়ে তদন্ত করতে পারেন । শোনা যায় কোনও কোনও ব্যক্তি পুলিশের উচ্চপর্যায়ে বৈঠক করছেন বারবার। প্রশাসনের প্রতি অনুরোধ যতো প্রভাবশালীই হোক না কেন, সততার সাথে দৃঢ়তার সাথে সত্য উদ্ঘাটন করুন, প্লিজ। আমরা সবাই আপনাদের সাথে আছি।
আমি বিশ্বাস করতে চাই, ঘরভর্তি সাংবাদিক পুলিশ সদস্যদের মাঝে আইজিপি হাসান মাহমুদ খন্দকার আমাকে মিথ্যে আশ্বাস দেননি। তার দক্ষ গোয়েন্দা বাহিনী নিশ্চয়ই মূল অপরাধীদের শনাক্ত করবেন। সাজানো কোন গল্প ফেঁদে বসবেন না। তবু ভয় হয় । এই পোড়াদেশে বারবার অপরাধীদের বাঁচিয়ে দেওয়া হয়। খুনিরা ভীষণ প্রভাবশালী হয় । না হয় একাত্তরের খুনিদের এখনো আমরা দাপিয়ে বেড়াতে দেখছি কেন? তাদের হৃদয়ে তো বাংলা অথবা বাংলাদেশ অথবা মানুষ- কারো জন্যে কোন ভালোবাসা নেই। তবু তারা এদেশে ছড়ি ঘোরাতে পারে। যখন যারাই ক্ষমতায় আসুক, তারা ক্ষমতাশীনদের সম্পর্কের খাতিরে প্রচণ্ড ক্ষমতাধর। কারা এই হত্যাকারীর দল?
এমন ফিকে বসন্ত আমাদের জীবনে কখনো এসেছে কি? তবু বলতে হয়, “...একদিন নয় বিষাদ ভুলিয়া সকলে মিলিয়া গাহিবো মোরা/ ভাবনা কাহারে বলে? সখী, যাতনা কাহারে বলে/ তোমরা যে বলো দিবস রজনী ভালোবাসা ভালোবাসা/ সখী ভালোবাসা কারে কয়? /সেকি কেবলি যাতনাময়? লোকে তবে করে /কী সুখের তরে এমন দুখের আশ?”
আবার তিস্তার কথায় আসি। পরিবারে যে সম্পর্ক সম্পত্তি বা কোন স্বার্থনির্ভর, দায়িত্বশীল ব্যক্তির স্বার্থপরতা বা দায়িত্বহীনতার কারণে অথবা অসতর্কতায় তাতে হঠাৎ ছন্দপতন হয়। তবু জীবন থেমে থাকে না।
সামান্য ভুলে নিঃস্বার্থ সম্পর্ক ও কালের অতলে হারিয়ে যায়। অকৃত্রিম বন্ধুত্ব চিরকাল ধরে রাখতে পারে না সবাই। এ দুরূহ কাজ যারা পেরেছে তারাই জিনে নিয়েছে জীবনের সুন্দরতম দিন। জীবনের বন্ধুর পথে চলতে গিয়ে কেবলি মনে হয় , সাংবাদিকতা পেশাকে কলুষমুক্ত করতে এগিয়ে আসতে হবে সকলকে। মানুষের প্রতি নির্লোভ ভালোবাসা নিয়ে অন্যায়ের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিতে হবে। রুনি-সাগর ভাইয়ের খুনির প্রতি আমরা যেন কোনও করুণা না দেখাই। এর পরিণতি আমাদের জন্যে আরো ভয়াবহ বিপদ ডেকে আনতে পারে। খুনির কোনও ক্ষমা নেই। তাদের প্রতি কোনও করুণা নয়। মিথ্যুক অপেশাদার সহকর্মীদের প্রতি কঠোরভাবে বলতে চাই, একটু মানবিক হোন। না জেনে রুনির প্রতি, সাগর ভাইয়ের প্রতি এবং মেঘের প্রতি এমন কোনও অন্যায় করবেন না, যা খুনিদের বাঁচিয়ে দেবে।
হঠকারী ব্যক্তিদের হাতের মুঠোয় বন্দী রাজনীতি। বৈষম্যহীন সমাজের প্রত্যাশা বড়ো বেশি চাওয়া আজ। তবু মন বলে , নির্মল ভালোবাসায় ভরে যাক সারা বিশ্ব। মেঘের মতো যতো শিশু আছে, তাদের বাসযোগ্য হোক এ বিশ্ব। প্রেমময় ভালোবাসায় সমৃদ্ধ হোক সবার জীবন।
সুমি খান: সংবাদকর্মী
বাংলাদেশ সময় ১৫৫৩ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৪, ২০১২