প্রিয় সাগর-রুনি’র হত্যা রহস্যের শেষ খবর জানতে উন্মুখ হয়ে থাকি সারাক্ষণ। চেহারা দুটো চোখের সামনে ভাসতে থাকে।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুনের বেঁধে দেওয়া ৪৮ ঘন্টার মেয়াদ অতিক্রান্ত হয়েছে সোমবার। কিন্তু কোন অগ্রগতি হয়নি! আইজিপি বলেছেন, তারা ভালো এগিয়েছেন। কিন্তু সব সময় মেয়াদ বা সময়সীমার তদন্তের কাজ শেষ করা যায় না। এ নিয়ে খালেদা জিয়াসহ আরও অনেকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর পদত্যাগ দাবি করেছেন। কিন্তু সাগরের প্রতিষ্ঠান তদন্ত কর্তৃপক্ষের অবস্থানকে সমর্থন করেছে। মাছরাঙ্গা টেলিভিশনের শোকার্ত সহকর্মীরা সোমবার তাদের মানববন্ধন সমাবেশে বলেছেন, সময়সীমার নামে যাতে তদন্তে তাড়াহুড়া করা না হয়। প্রকৃত সত্য যাতে বেরোয়, খুনিরা যাতে ধরা পড়ে সে আকুতি তারা জানিয়েছেন। আমরাও তাই চাই। আগেই লিখেছি, অভাবিত নৃশংস হত্যাকাণ্ডটি নিয়ে দেশে বিদেশে বাংলাদেশি বাঙ্গালিদের মধ্যে স্বজন হারানোর বিশেষ একটি আবেগ-অনুভূতির সৃষ্টি হয়েছে। এই আবেগ-অনুভূতির আরেক নাম এখন মেঘ। , সাগর-রুনি’র রেখে যাওয়া স্মৃতি। কাজেই পুরো বিষয়টি নিয়ে কোনও অবস্থাতেই যেন ছেলেখেলার চেষ্টা করা না হয়। এতে কিন্তু আগুন জ্বলে উঠবে দেশে। এর মাঝে মেঘ আর সাগর-রুনি’র শোকার্ত স্বজনদের গণভবনে ডেকে এনে সহানুভূতি জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। মেঘের সারাজীবনের পড়াশুনার দায়িত্ব নেবার ঘোষণা দিয়েছেন। কিন্তু এ ঘোষণায় একটা ফাঁক আছে। সে কথায় পরে আসছি।
এখন সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের মিডিয়া রিপোর্ট নিয়ে আলোকপাত করতে চাই। সাগর-রুনি দু’জনেই ঢাকার মিডিয়ার আলোকিত-আলোচিত তরুণ প্রতিভা। তাদের বাচ্চাটাও খুব সপ্রতিভ। কিউট। মিডিয়ার মানুষ হিসাবে এদের অভাবনীয় জীবনঘাতী ঘটনার ভালো মিডিয়া কভারেজ হবে এটিই স্বাভাবিক। মিডিয়া তার দায়িত্ব পালন করেছে ও করছে। কিন্তু কিছু কিছু মিডিয়ার ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। টেলিভিশনে যেভাবে নিহত সাংবাদিক দম্পতি রক্তাক্ত ছবি যেভাবে দেখানো হয়েছে, তাতে দেশজুড়ে সহানুভূতির উল্টো এক ভীতির পরিবেশ সৃষ্টির অভিযোগ উঠেছে। এরপর খুনের ঘটনার একমাত্র প্রত্যক্ষদর্শী শিশু মেঘের ইন্টারভ্যু যেভাবে নেওয়া হয়েছে, তার বাবা-মা’কে কুপিয়ে হত্যার বৃত্তান্ত তাকে যেভাবে জিজ্ঞেস করা হয়েছে, প্রশ্ন উঠেছে মিডিয়ার এথিক্যাল অথরিটি নিয়ে। এমনিতেই এমন একটি ছেলের বাকি জীবন মানসিক সুস্থতা নিয়ে বেঁচে থাকার সম্ভাবনা কম। এরপর কিছু মিডিয়াসহ অনেকে যেন তাকে নিশ্চিত একটি মানসিক রোগী বানানোর মিশন নিয়েছেন! এটি কেউ জেনে করছেন যে তাও নয়। কিন্তু এর সুদূরপ্রসারী প্রতিক্রিয়া যারা ভেবে চলার যোগ্যতা রাখেন না, তারা দায়িত্বশীল কীনা, সে প্রশ্নতো উঠতেই পারে। কারণ এরমাঝে পুরো বিষয়টি দেশজুড়ে এক ধরনের বিষাদের আবহ সৃষ্টি করেছে। বিশেষ করে কোমলমতি শিশুদের মধ্যে। মিডিয়ার দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা এসব ব্যাপারে নিজেরা বসে পুরো বিষয়টির পর্যালোচনা, প্রয়োজনে অবশ্য পালনীয় কিছু সিদ্ধান্ত নেবেন আশা করছি। প্রেস কাউন্সিল বা এ বি এম মুসার মতো সিনিয়র একজন সাংবাদিকও উদ্যোগটি নিতে পারেন।
এক্ষেত্রে উল্লেখ্য, সম্প্রতি হাটহাজারীসহ আরও কিছু ঘটনায় কিন্তু মিডিয়া দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করেছে। বিশেষ করে হাটহাজারীর ঘটনা মিডিয়া এড়িয়ে গেছে বলে অনলাইনে অনেক সমালোচনা হয়েছে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে নানা `রং’এর মিডিয়া যদি নানামুখি মিশন নিয়ে ঘটনায় ঝাঁপিয়ে পড়তো তাহলে হিতে বিপরীত হতে পারতো। বাড়তো সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা-নির্যাতনের ঘটনার ঝুঁকি। আর গরু মরার পক্ষে শকুনের প্রার্থনার মতো এমন একটি পরিস্থিতি সৃষ্টির আশায়তো বসেই আছে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার পণ্ড করতে ইচ্ছুক দলটি।
মঙ্গলবারের কিছু পত্রিকায় নিহত রুনি’র দিকে সন্দেহের আঙ্গুল রেখে রিপোর্ট ছাপা হয়। ঘটনার সঙ্গে মিডিয়ার লোকজনের সংশ্লিষ্টতা, সাংবাদিক আটক বা গ্রেফতার, জিজ্ঞাসাবাদের তথ্যও ছাপা হয়। পড়ে খুব বিচলিত লাগে। বাংলাদেশের সঙ্গে অস্ট্রেলিয়ার সময়ের ব্যবধান পাঁচ ঘন্টা। এমন বিচলিত পাঁচঘন্টা পার করে ঢাকার সকালবেলায় দায়িত্বশীল একাধিক ব্যক্তিকে ঘুম থেকে জাগিয়ে আগে বিনীত দু:খপ্রকাশ করে এসব রিপোর্টের সত্যতা জানতে চাইলে বলা হয়, এসব সিণ্ডিকেটেড রিপোর্ট। এরপর বলা হয়, একটু খেয়াল করে দেখুন, কয়েকটি পত্রিকার রিপোর্ট এক। অথচ কোনও সুনির্দিষ্ট তথ্যসূত্র উল্লেখ করা নেই। সাগর-রুনির ঘটনা নিয়েওতো সৃষ্টি হয়ে গেছে একাধিক সিন্ডিকেট নিউক্লিয়াস! সেগুলোয় বসেই প্রতিদিনের গল্পের গতিপ্রকৃতি ঠিক করা হয়!
দায়িত্বশীল একজন বলেন, এখন মিডিয়া যদি মিডিয়ার নিজের লোকজন নিয়ে সিন্ডিকেট করে গল্প লেখে, তাহলে আমরা কী করতে পারি? মঙ্গলবারের কিছু রিপোর্টে এমন কিছু ভয়াল অথবা নোংরা ইঙ্গিত আছে এর সামান্যও যদি সত্য হয়, তাহলে মর্মন্তুদ ঘটনাটি নিয়ে দেশজুড়ে যে সহানুভূতির সেন্টিমেন্ট সৃষ্টি হয়েছে, এর পুরোটাই কিন্তু শেষ হয়ে যাবে। সে কারণেই পুরো বিষয়টি নিয়ে আমার মনে ভয় সৃষ্টি হয়েছে। আমার এসব ভয় কী নিতান্তই অমূলক? তাই যেন হয়। কারণ সাগর-রুনি দু’জনকেই যে ভালোবাসতাম।
ডিএমপির পক্ষে অবশ্য মঙ্গলবারই বলা হয়েছে মিডিয়ার লোকজনের কোনও সংশ্লিষ্টতা তারা এখনও পায়নি। সাংবাদিক গ্রেফতারের খবর সঠিক নয়। এমনকি মিডিয়ার কাউকে জিজ্ঞাসাবাদও করা হয়নি।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মেঘের পড়াশুনার দায়িত্ব নিয়ে বলেছেন, তিনি যতদিন বেঁচে থাকবেন, মেঘের সমুদয় দায়িত্ব তার। প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণাকে আমার বেশ ত্রুটিপূর্ণ মনে হয়েছে। আমরাতো দায়িত্ব নেওয়াটা চাই দেশের-রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর কাছে, ব্যক্তি শেখ হাসিনার কাছে নয়। যাতে শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী না থাকলেও রাষ্ট্র দায়িত্বটি পালন করে যায়। আমাদের দেশে আবার হাসিনা ক্ষমতায় এসে খালেদারটা বাতিল করেন, খালেদা ক্ষমতায় এসে হাসিনারটা। কাজেই রাষ্ট্র যে এমন দায়িত্ব পালন করবে, সে নিশ্চয়তা কোথায়?
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কী আরেকটি কাজ করতে পারেন? একটি তহবিল গড়ে দেয়ার? এখন দেশজুড়ে যে মেঘপ্রবাহ, তিনি ঘোষণা দিলেই কিন্তু গণভবনে মানুষের লাইন পড়ে যাবে। তবে সবার আগে আমরা এই ঘাতকদের চেহারা দেখতে চাই। আমাদের প্রিয় সাগর, প্রিয় রুনি’কে যারা খুন করেছে, মেঘ’কে যারা এতিম করেছে, চাই তাদের দৃষ্টান্তমূলক বিচার।
ফজলুল বারীঃ সিডনিপ্রবাসী সাংবাদিক