ঢাকা, শুক্রবার, ১৭ কার্তিক ১৪৩১, ০১ নভেম্বর ২০২৪, ২৮ রবিউস সানি ১৪৪৬

মুক্তমত

‘কর্পোরেট ভালোবাসা’র জোয়ারে ভেসে যাওয়া জাফর-দীপালি

শিবলী নোমান, অতিথি লেখক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২০০৫ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৪, ২০১২
‘কর্পোরেট ভালোবাসা’র জোয়ারে ভেসে যাওয়া জাফর-দীপালি

চারিদিকে ভ্যালেন্টাইনস ডে’র জোয়ার। সারা বছরে ভালোবাসা থাক আর না থাক, বছরের এই একটি দিনে আমরা যেন ভালোবাসার দোকান খুলে বসি! কর্পোরেট বাণিজ্যের বদৌলতে বছর বছর দিনটি আরো বেশি আকর্ষক হয়ে উঠছে।

 অন্যদিকে এই ‘কর্পোরেট ভালোবাসা’র জোয়ারে খাবি খেতে থাকেন জাফর-দীপালি সাহারা। আমরা তাদের মনে রাখি না।

কী মুশকিল! এই তো দিব্যি ‘কর্পোরেট ভালোবাসা’য় উড়ে বেড়ানো চলছে। এর মধ্যে আবার হুট করে দীপালি সাহারা কোত্থেকে এলো? কারা তারা? নতুন প্রজন্মের বড় অংশই এই প্রশ্ন তুলে চোখ কপালে উঠিয়ে ফেলবেন---নিশ্চিত বলা যায়।

তাদের আর কী-ই বা দোষ? যখন গণমাধ্যম থেকে শুরু করে সবাই দীপালিদের রক্তঝরা দিনগুলোকে এক প্রকার আড়ালই করে ফেলেছে, তখন নতুন প্রজন্ম এসব জানবেই বা কোত্থেকে?

দিনটি ছিলো ১৯৮৩ সালের একটি দিন। সেই বছরটি শুরু থেকেই উত্তাল হয়ে উঠেছিলো গণবিরোধী মজিদ খান শিক্ষানীতি বাতিলের দাবিতে। ভাষা আন্দোলন, গণঅভ্যুত্থান, স্বাধীনতা যুদ্ধের মতোই এখানেও অগ্রণী ভূমিকায় ছিলেন ছাত্ররা। ১৪ ফেব্রুয়ারি গণবিরোধী শিক্ষানীতি প্রত্যাহার, ছাত্রবন্দিদের মুক্তি ও দমননীতি বন্ধ এবং গণতন্ত্র ও মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠার দাবিতে ঢাকায় ছাত্র জমায়েত, সচিবালয় অভিমুখে বিক্ষোভ মিছিল ও অবস্থান ধর্মঘটের ডাক দেয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ। সকাল থেকেই ছাত্র-জনতার অংশগ্রহণে বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে সচিবালয় এলাকা। গণতন্ত্রকামীদের আন্দোলনে স্বৈরাচারি শাসক লেলিয়ে দেয় পুলিশ। তাদের গুলিতে শহীদ হন জাফর, দীপালি সাহা, জয়নালসহ ১০ জন। নব্বইয়ের যে গণঅভ্যুত্থানে আজকের এই গণতন্ত্রের উন্মেষ, তার সূচনা কিন্তু ছিলো সেই দিনটিই।

কিন্তু আফসোস, এই দিনটির কথা আমরা যেনো ভুলতে বসেছি।

বেশ কয়েক বছর ধরেই নূর হোসেনের আত্মত্যাগের দিনটি নীরবে আসে, নীরবে যায়। পত্রিকার পাতায় শুধু ‘আজ নূর হোসেন দিবস’ টাইপের একটা প্রতিবেদন। সঙ্গে সেই ট্রেডমার্ক ছবি- বুকে-পিঠে লেখা ‘স্বৈরাচার নিপাত যাক, গণতন্ত্র মুক্তি পাক’। পরের দিনের পত্রিকা খুলে নূর হোসেন দিবস পালনের বেশি খবর দেখা যায় না। যে নূর হোসেনদের রক্তের বিনিময়ে আজ গণতান্ত্রিক হাওয়া-বাতাস খেয়ে প্রধান দুই রাজনৈতিক দল সরকার চালান অথবা বিরোধী দলে থাকেন, তারাও সাংগঠনিকভাবে এ নিয়ে খুব একটা উচ্চবাচ্য করেন না।
 
নূর হোসেন দিবসটি তো তবু বেশিরভাগ গণমাধ্যমে ঠাঁই পায়। কিন্তু জাফর-দীপালিদের আত্মত্যাগের দিনটি যেন আরো উপেক্ষিত। পাশ্চাত্যের ভ্যালেন্টাইন দিবসকে ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে ভালোবাসা দিবসে পরিণত করা গেছে। আমরা এখন সেই দিবসে বুঁদ হয়ে থাকি। কিন্তু নিজের ইতিহাসের দিনটিকে বেমালুম ভুলে যাই!

আজ যখন ছাত্র রাজনীতি তাদের গৌরবময় অতীত ভুলে বিপথে চলছে, তখন আমরা অনেকে শুধুমাত্র এটিকে নিষিদ্ধ করার দাবি জানিয়ে নিজের ‘সুশীল’ পরিচয় জাহির করি। কিন্তু ১৪ ফেব্রুয়ারির মতো ছাত্র রাজনীতির গৌরবময় দিনগুলো যাতে আমরা ভুলে না যাই, সে ব্যাপারে ক’জন কাজ করছি? ক’জন এই ইতিহাসগুলোকে তুলে এনে নিজেদের আত্মপরিচয়ের সন্ধানে উদ্বুদ্ধ করছি?
জাফর-দীপালি সাহারা দেশকে ভালোবেসে, এদেশের মানুষকে ভালোবেসে, মুক্তবুদ্ধির চর্চার দুয়ার খুলতে প্রাণ দিয়েছিলেন। আমরা তাদের শ্রদ্ধা জানাই, তাদের আত্মদানকে ভালোবাসি। এই ভালোবাসার পেছনে কোনো কর্পোরেট ধান্দা নেই। তাই উদাত্ত কণ্ঠে দাবি জানাই, সর্বস্তরে দিনটি স্বৈরাচার প্রতিরোধ দিবস হিসেবে পালিত হোক।

শিবলী নোমান: রাজশাহীতে কর্মরত সাংবাদিক

বাংলাদেশ সময়: ২০২১ ঘণ্টা, ১৪ ফেব্রুয়ারি, ২০১২

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।