বিশাল সাগরের সুশীতল প্রবাহ যে ছোট্ট মেঘ খণ্ডটিকে পরিণত করছিল ধীরে ধীরে, সেই সাগরেরই অথৈ জলে নিমজ্জমান এখন মেঘের টুকরোটি! কোনো এক অশুভ দুর্বৃত্তচক্রের নৃশংসতার শিকার হয়ে বাবা-মা সাগর-রুনি পৃথিবীর অথৈ সমুদ্রে ভাসিয়ে দিয়ে গেছে একমাত্র আদরের ধন মেঘকে। অবশ্য পৃথিবীর সবচে আপনজনদের হারিয়েও মেঘ এখন রাষ্ট্রের কাছে; প্রধানমন্ত্রীর কোলে; রাজনীতির ছায়াতলে শীতল প্রবাহের আরেক নবতর উৎসস্থলে; এতিম নয় সেই শিশু! অন্য আত্মীয়-স্বজনসহ অনেক মানুষের উষ্ণ আলিঙ্গনে-ভাবাবেগেও মেঘের অন্ধকারদশা আপাতত স্তিমিত।
স্বজন হারানোর বেদনা বোঝেন আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শুধু বোঝেনই না; তার বেদনার সঙ্গে এদেশের ঘটমান-চলমান কোনো বেদনাপ্রবাহই তুলনীয় নয়। কিন্তু যে প্রশ্নটি মর্মান্তিক, তা হলো-স্বাধীন এই দেশ, এই সমাজ, এই শহর, এই নগর-বন্দর-গ্রামে একের পর এক যে ধরনের হত্যাকাণ্ড, গুম, অপহরণসহ নৃশংস ঘটনা অব্যাহত রয়েছে, এর প্রতিকার, প্রতিরোধ কিংবা নিদেনপক্ষে নিয়ন্ত্রণের যথাযথ দায়িত্ব কে, কারা কীভাবে নেবেন?
দার্শনিকদের মতে, মনুষ্যসমাজে, মানবজীবনে একেবারেই অলক্ষ্যে-অদৃশ্যে বহুভ্রান্তি থেকে যায়। সেইসব ভ্রান্তি থেকে মতিভ্রম ঘটে অনেকক্ষেত্রে অনেক জীবনে। অর্থ-সম্পত্তির ভাগ-বাটোয়ারা, প্রেম-প্রীতি-ভালবাসা-পরকীয়া-পরিণয়ঘটিত জটিলতা, পারিবারিক- সামাজিক- রাজনৈতিক- পারিপার্শ্বিক হিংসা- দ্বেষ- বিদ্বেষ- সহিংসতা- নৃশংসতা’ এসবই মানুষের জীবনপ্রবাহে সংশ্লিষ্ট। আর এসবের আগে যেগুলো মানবজীবনের মূল চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য তা হলো-জ্ঞান-বিবেক-বুদ্ধি-বিবেচনা-মানবতা-মহানুভবতা-সহানুভূতিশীলতা, স্নেহ, ভালবাসা, শ্রদ্ধাশীলতা এবং সর্বোপরি মানবিক মূল্যবোধ। এগুলোই মানুষের হৃদয়-আবেগ-স্নায়ুঘটিত বিষয়। বিবর্তনবাদের সূত্র অনুযায়ী, শিক্ষা-সংস্কৃতি-জ্ঞান-বিজ্ঞানের সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছে গেছে আজকের বিশ্ব। আর সৃষ্টির সেরা জীব মানুষের জীবনপ্রবাহেও এসেছে বিস্তর পরিবর্তন। মানুষ পারছে না এমন কিছুই বলতে গেলে নেই বর্তমানে। কিন্তু, দুঃখজনক বাস্তবতা হলো- এই মানবসমাজেরই কোনো কোনো অংশে, ভূখণ্ডে যেমন আমাদের প্রিয় স্বাধীন গণতান্ত্রিক সোনার বাংলাদেশে মানুষের হিংসাত্মক, ধ্বংসাত্মক, নাশকতামূলক, নৃশংস বহু ঘটনাই আজো ঘটে চলেছে অনেকটা ফ্রি স্টাইলে! যা চরম অসভ্যতা-অমানবিকতা-পাশবিকতার নগ্ন দৃষ্টান্ত!
এর অনেক কারণ থাকতে পারে। তবে যে দেশের রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রকবৃন্দ প্রতিহিংসা, নৃশংসতা, নাশকতামূলক অসহনশীল রাজনৈতিক আচরণকেই চিরাচরিত ঐতিহ্য হিসেবে সুপ্রতিষ্ঠিত করেন; জীবনজুড়ে ঝগড়া-বিবাদ-বিষম্বাদ এমনকি হত্যা-খুন-লুট-গুমের রাজনীতি যাদের পার্থিব আরাধ্য বস্তু হয়ে যায়- সেই দেশে, সেই সমাজে আর যাই হোক আমাদের ছোট মেঘেদের বিরাট বিরাট দুঃখই যে চিরাচরিত সঙ্গী হয়ে থাকবে এটার মধ্যে অস্বাভাবিকত্ব কোথায়?
নাটক, সিনেমার নায়কেরা যেভাবে ফাইট করেন, উঠতি বয়সের কিশোর জীবনে সেই স্টাইলের প্রভাব পড়ে। নায়িকারা যেভাবে চুল-দুল বাঁধেন, উদীয়মান তরুণীরাজ্যেও সেই সাজের প্রভাব পড়ে। এটাই জীবন-সংস্কৃতির চলমান ঘটনা-বাস্তবতা। নেতারা, রাষ্ট্রনায়কেরা যেভাবে দেশ ও সমাজ পরিচালনা করেন, সেই দেশের মানুষের জীবনেও সেই প্রভাব ক্রমশঃ প্রকট্য পায়। যে দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির চলমান প্রবাহ যেমন ধাচের, সেই দেশের শৃঙ্খলাও নির্ধারিত হবে তেমন ধাচেই-তেমন ধারায়। আইডলদের- আইকনদের ফ্যানেরা অনুকরণ করবেই। যেমনটি রাজনীতিবিদদের করেছে ছাত্রলীগ-দল-শিবিরেরা।
বাবা সাগর আর মা রুনির যে নৃশংস হত্যাকা-ের রক্তের ছাপ দেখলো আমাদের মেঘ, সেই দৃশ্য যে মাসুম বালকটির মস্তিষ্কের স্নায়ুতে শৈশবে গেঁথে গেলো, গেঁথে রইলোÑএর পরিণতি কেবল মেঘের আগামী ভবিষ্যতই নির্ধারণ করবে। ওর মনোবিকৃতি-স্বীকৃতির কথা আমরা আপাতত বলতে পারবো না। আবার এমন একটি হত্যাকাণ্ডের জন্য কারোরই কিছু করারও থাকে না; করার নেই। যেটি করার ছিল, আছে, তা হলো- অনতিবিলম্বে ঘটনার ক্লু উদ্ধার করে এর সঙ্গে দায়ীদের যথাযথ দৃষ্টান্তমূলক বিচার করা।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী মেঘের সকল দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে যে রাজনৈতিক উদারতার প্রচার-প্রসার ঘটিয়েছেন-এর জন্য তিনি যেটুকু কৃতজ্ঞতা পাচ্ছেন, পাবেন, তার চেয়ে বেশি বাহবা পাবার প্রক্রিয়াটি হলো- এই ধরনের ঘটনার শেকড় উপড়ে ফেলার রাজনীতি। যাতে বাংলার আকাশে জমে থাকা আগামীর সুজলা-সুফলা মেঘকণাগুলো ক্ষত-বিক্ষত না হয়ে যায়। দেশে-সমাজে-রাষ্ট্রে প্রকৃত আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করার মধ্য দিয়েই যেনো এই মেঘেরা আমাদের আগামী বাংলাদেশকে ক্ষমা করে; নচেৎ বিবর্তনবাদ আর দর্শনশাস্ত্রের চলমান গতিধারায়- এরা যদি আপনহারার সুবিচারটুকু পরিণত বয়সে গিয়েও আপনাদের মতোই দেখতে না পায়- তাহলে প্রধানমন্ত্রীর উষ্ণ আলিঙ্গন আর রাষ্ট্রের সাময়িক মায়া-মোহনীয়তা ওদের মানসিকতায় কোনো ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারবে না।
বাংলাদেশ সময় ২০৪৮ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৪, ২০১২