সাগর-রুনি’র হত্যা রহস্যের এখনও কোন কুলকিনারা হয়নি। এ নিয়ে দেশের মানুষের আগ্রহের কারণে পত্রপত্রিকার লেখালেখিও থেমে নেই।
তাদের উদ্যোগ ও দায়িত্ববোধটির প্রশংসা করি। কেউ যদি তা শোনেন, তাহলে কীই বা করার আছে? আমরাতো কারও পিছনে পিছনে বিছুটি পাতা নিয়ে দৌড়াতে পারবো না, বা এটি আমাদের কাজও নয়। তবে সবারই বুঝি একটু দায়িত্বশীল হওয়ার-থাকার দরকার আছে। স্বাধীনতা মানুষকে দায়িত্বশীল করে। হত্যাকান্ডের পিছনে মিডিয়ার লোকজনের সম্পৃক্তি, আটক অথবা গ্রেফতার, এমনকি অমুক অমুকের ফোনও বন্ধ, এমন কিছু গুজবের ভিত্তিতে পুলিশ মুখ খুলেছে মঙ্গলবার। বলেছে, এসব খবরের কোন ভিত্তি নেই। পুলিশের এই ভূমিকার প্রশংসা করি। প্রতিদিন এ বিষয়ে একটা মিডিয়া ব্রিফিং করা যায় কিনা, অগ্রগতি না থাকলে এক লাইনেই বলা হবে, অগ্রগতি নেই, এ বিষয়টি ভেবে দেখার অনুরোধ করছি। কারণ সংশ্লিষ্ট তরফে সুনির্দিষ্ট বক্তব্য পাওয়া গেলে গল্প লিখার কোন সুযোগ নেই।
তদন্তে পুলিশের ভূমিকা নিয়ে অনেকে হতাশাও জানিয়েছেন। আমাদের দেশের অনেক কিছুতে সীমাবদ্ধতা আছে। এরপরও সঠিক তদন্তে সময় লাগলে লাগুক। কিন্তু কাউকে খুশি করার জন্য যেন জজ মিয়া নাটকের পুনরাবৃত্তি করা না হয়। আমাদের দেশের পুলিশি তদন্তের সাজানো আষাঢ়ে গল্প প্রতীকি উপাখ্যানের নাম জজ মিয়া নাটক। যা বিএনপি-জামায়াত শাসনামলের বাজে একটি দৃষ্টান্ত। আমরা তেমন আরেকটি জজ মিয়া নাটকের পুনরাবৃত্তি চাই না।
‘খুন হওয়া রুনি-সাগরকে আর খুন নয়’ শিরোনামের লেখাটিতে আমার বন্ধুরা যে সব প্রসঙ্গের উল্লেখ করেছেন, সে বিমার আমাদের দেশের এক শ্রেণীর মিডিয়ার নতুন নয়। দেশে নারী নেতৃ্ত্ব ক্ষমতাসীন থাকলেও সমাজতো পুরুষতান্ত্রিক। অপরাধ বিষয়ক রিপোর্টিং’এ জড়িতরা প্রায় সবাই পুরুষ। পরিবার থেকে শুরু করে সর্বত্র যেখানে আমাদের ‘পুরুষালি’র দাপট(!) সেখানে এমন একেকটি ঘটনার পর আমাদের দেশে কি কি হয়, তাতো আমরা সবাই মোটামুটি জানি। আমরা ছেলেরা বেশুমার প্রেম করি, আবার খেয়াল রাখি, আমার বোনটা যাতে আবার ‘ওসব’ না করে। তসলিমা নাসরিনের লেখার অনেককিছু আমরা ছেলেরা আড্ডায় গল্পচ্ছলে বলি। কিন্তু তসলিমা সেগুলো চাঁছাছোলা ভাষায় লিখলে তা আমাদের পুরুষত্বের জাত্যাভিমানে লাগে! ‘বেগানা’, ‘বেশরম’ একটা মহিলা কেন তা লিখবে! দেশের কোন খুনের ঘটনায় যখন কোন কুলকিনারা করা যায় না, তখন পুলিশ অথবা এক শ্রেণীর মিডিয়ার সবচেয়ে সহজ একটি কাজ হলো সেটির সঙ্গে যদি একটু ‘পরকীয়া’ জাতীয় রং’চড়ানো যায়, সেটিই পুরুষতান্ত্রিক সমাজে পাবলিক বেশি খায়! এক্ষেত্রে ইনাদের জ্ঞানে (!) আবার ‘পরকীয়া’ মানে সবকিছু নারীর দোষ! পুরুষ চরিত্র মাত্রইতো ফুলের মতো পবিত্র! এটা শুধু খুন বা অপরাধের ক্ষেত্রেই নয়। রাজনীতি সহ সমাজের অনেকক্ষেত্রেই হয়। নারায়ণগঞ্জ নির্বাচনে অনেক শামীম ওসমান সমর্থককে অনলাইনে আইভী’র বিরুদ্ধে ‘কিছু একটা রটনার’ কষ্ট-কল্পনার ‘পরিশ্রম’ করতেও দেখেছি।
সাগর-রুনি দু’জনেই প্রেম করে নিজেদের ইচ্ছায় বিয়ে করেছেন। খুব সাধারণ পরিবার থেকে উঠে আসা দু’জনে মিডিয়ায় এগিয়ে গেছেন নিজস্ব যোগ্যতায়। মানুষ হিসাবে আমাদের অনেক সীমাবদ্ধতা আছে, থাকে। সাগর-রুনি’রও তা নিশ্চয় ছিল। কিন্তু আমাদের দেখার খুব আন্তরিক একটি মিডিয়া দম্পতি, বেঁচে থাকতে কেউ কোন দোষ পেলো না, খুন হবার পর পুলিশ যখন কিছু বের করতে পারছে না, আমরা মিডিয়ার কিছু লোক বের করার চেষ্টা শুরু করেছি রুনি’র দোষ সমগ্র খুঁজে বের করার! কারণ এই আমাদের কাছে যে রুনি’র পরিচয় মানুষ না, মেয়েমানুষ! এর মাঝে একটি পত্রিকায় ঘটনার রাতে নোংরা একটি ইঙ্গিত করা হয়েছিল। কিন্তু পোস্ট মর্টেম রিপোর্টে সেটি বানোয়াট-ভিত্তিহীন প্রমাণিত হয়েছে। বুধবারের এক পত্রিকায় রুনি’র পোশাক নিয়ে লেখা হয়েছে! আর কী কী খারাপ(!) ছিল আমাদের এই বোনটির? একটা তালিকা করে, একবারেই সব লিখে দেওয়া যায় না? অথবা কী একেবারে একটা বাইলাইন রিপোর্টে লিখে দেওয়া যায় না, ‘রুনি’র জন্য কেউ কেঁদো না, সাগরের স্ত্রী-মেঘে’র মা রুনি ছিল খারাপ একটা মেয়ে’! সে সাহস আছে?
ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি আর সাংবাদিক নেতাদের বলছি, নিজেদের এসব গল্প লেখক লোকজনকে থামান। নতুবা কিন্তু একদিন কেউ আর রাস্তায় নামতে দেবেনা। এমন কিন্তু আমাদের দেশে বরাবর হচ্ছে। সংশ্লিষ্ট লোকজনকে চিহ্নিত করে একটু সাংবাদিকতা, মিডিয়া ল’ কোর্সে ভর্তির ব্যবস্থা করলে কিন্তু কেউ এমন ফ্রি-স্টাইল লিখতে পারবেন না। রিপোর্ট লিখতে গেলে সুনির্দিষ্ট সোর্সের উল্লেখ-ভাষ্য লাগবে। সাগর-রুনিকে আমরা সবাই ভালোবাসি। সবাই এই হত্যাকাণ্ডের বিচার চাই। আমাদের কোন কাজ যেন হত্যাকারীদের পক্ষে না যায়, প্লিজ!
এর মাঝে ঘটনার আলামত নষ্ট হয়ে যাবার কথা উঠেছে। বলা হয়েছে ঘটনার পর মিডিয়ারসহ এত মানুষ সেখানে হুড়মুড় করে ঢুকে গেছেন যে সেখানকার কোনটার হাতের ছাপ কার, তা চিহ্নিত করা মুশকিল। এটি কিন্তু যারা এখনই আসামিপক্ষের উকিল হবার জন্য তৈরি হচ্ছেন, তারা নোটে টুকে নিচ্ছেন! আমাদের দেশের এটি আরেক সমস্যা। বিদেশে এমন ঘটনা ঘটলে পুলিশ সবার আগে অকুস্থলটি সিলগালা করে। মিডিয়া সহ আগ্রহী সকল ব্যক্তিকে বাধ্যতামূলক ওই সিলগালা এলাকার বাইরে অবস্থান করতে হয়। যার কাজ যেখানে। কিছুদিন আগে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগের ডাক্তাররা মিডিয়ার লোকজনের ওপর হামলা চালিয়েছেন, এমন একটি সচিত্র খবর ছাপা হয়েছে। পরিচিত একজন ডাক্তার জানালেন, ঘটনা সত্য। আপনাদের মিডিয়া এত বেড়েছে যে কিছু ঘটলে মিডিয়ার লোকজনের ভিড়ের চাপে হাসপাতালের জরুরি বিভাগেও রীতিমতো জনসভার পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়! আমরা কেউ আর স্বাভাবিক কাজ করতে পারি না। আমাদেরও অনেক সীমাবদ্ধতা আছে। মাথা ঠাণ্ডা রেখে কতক্ষণ কাজ করা যায়! এমন একেকটি ঘটনা থেকে অনেক কিছু চলে আসছে সামনে। কাঠগড়ায় দাঁড়াচ্ছে মিডিয়া। মেঘে’র ইন্টারভ্যু ভিত্তিক রিপোর্টের পক্ষে সাফাই গাওয়া হয়েছে বিবিসির কাছে। এটিও কিন্তু ঠিক হয়নি। ভুলকে শুদ্ধ বলে চাপিয়ে দেয়া যায় না।
ফজলুল বারীঃ সিডনিপ্রবাসী সাংবাদিক
বাংলাদেশ সময় ১৫৩৫ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৫, ২০১২