সেনাবাহিনীতে একটি অভ্যুত্থান অপচেষ্টা পণ্ডের খবর দেওয়া হলো জানুয়ারিতে। এর একমাসের বেশি হয়ে গেল, এরমাঝে আর কোনও খবর নেই কেন? সবশেষ ইকোনমিস্টের সঙ্গে ইন্টারভ্যু দিয়ে নিজেদের কথাগুলো বলে দিয়েছেন নেপথ্যের অন্যতম কুশীলব প্রবাসী ব্যবসায়ী ইশরাক!
পলাতক মেজর সৈয়দ জিয়াউল হককে আশ্রয় দেবার অভিযোগে গ্রেফতার করা হলো এক ব্যবসায়ীকে।
সবচেয়ে বিপদজ্জনক হলো, এই অভ্যুত্থান অপচেষ্টার মূল সেনা কুশীলব মেজর সৈয়দ জিয়াউল হক এখনও ধরা পড়েনি। নানা সূত্র থেকে বলা হচ্ছে সে পলাতক, ‘দৌড়ের ওপর আছে’, এবং দেশের মধ্যেই আছে। দেশের মধ্যে তাকে আশ্রয় দেবার যথেষ্ট লোক আছে বলেই তাকে এখনও ধরা যাচ্ছে না! অভ্যুত্থান অপচেষ্টা শুরুর আগে বন্ধু ভেবে অথবা বন্ধু খুঁজে খুঁজে মেজর জিয়া মিডিয়াসহ নানাজনকে কী পরিমাণ ই-মেইল করেছিল, ওয়াকিফহালরা তা জানেন। মূলত তার এসব ই-মেইলের সূত্র ধরেই একটি পত্রিকায় এ ব্যাপারে প্রথম রিপোর্ট ছাপা হয়। বিরোধীদলের নেত্রী খালেদা জিয়া চট্টগ্রামের জনসভায় প্রথম সেনাবাহিনীতে গুমের অভিযোগ তোলেন! এখন এভাবে নির্বাচিত সরকার উচ্ছেদ অপচেষ্টা পণ্ড হয়ে যাবার কারণেই কী এখন এই সরকারকে লুলা-ল্যাংড়া করে ছেড়ে দেবার ঘোষণা দিয়েছেন বিরোধীদলের নেত্রী? আবার দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়া বিষয়ক মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী রবার্ট ও’ ব্লেইককে বলেছেন, আগামীতে ক্ষমতায় গেলে ঐকমত্যের ভিত্তিতে দেশ চালানোর কথা! তা ম্যাডামের সেই সরকারে কী রাজাকার যুদ্ধাপরাধীদের সঙ্গে এমন কিছু ‘লুলা-ল্যাংড়া’ রাখারও ইচ্ছা?
আমাদের এই বিরোধীদলের নেত্রীকে বক্তৃতা-কথাবার্তায় যারা তুলনামূলক সংযত বলে জানেন, তারাও মানবেন, ম্যাডাম তার অনেক অর্জন এমন বেফাঁস কথাবার্তার কারণে হারান। একটু ঠাণ্ডা মাথায় ভেবে দেখুন, কী ভীতিকর ‘বন্য’, ‘বর্ণবাদী’ এখনও আমাদের দেশের রাজনীতিকদের মুখের ভাষা! বিদেশে এমন কেউ বললে ‘নিষ্ঠুরতা’, ‘রেসিজমের’ দায়ে মিডিয়াসহ সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষজনের কাছে সোজা বাতিল হয়ে যেতেন। আমাদের দেশ বলে, সবার চামড়া এত মোটা বলে কিছুই হলো না! বা হয় না! আওয়ামী লীগের নতুন একজন এমপি অ্যাডভোকেট ফজিলাতুন্নেসা বাপ্পী পার্লামেন্টের বক্তৃতায় বলেছেন, ‘লুলা’ শব্দটি এভাবে ব্যবহারের মাধ্যমে দেশের সত্তুর লাখ প্রতিবন্ধীকে অপমান করেছেন বিরোধীদলের নেত্রী। বাপ্পী আওয়ামী লীগের এমপি বলে অনেকে বিষয়টিকে পাল্টা দলীয় বক্তৃতা হিসাবে দেখতে পারেন। কিন্তু সুলতানা কামালসহ বাংলাদেশের মানবাধিকার নেত্রীরা কী এ ইস্যুতে কোন কথা বলেছেন? দেশের নানা ইস্যুতে খুব স্বাভাবিক উদ্বিগ্ন হয়ে কথা বলেন, সৈয়দ আবুল মকসুদসহ সুশীল সমাজের আরও অনেকে। বিরোধীদলের নেত্রীর এমন ‘বন্য’ ভাষা কী তাদের উদ্বিগ্ন করেছ? এ নিয়ে কোথাও কোন ফোরামে তারা কথা বলেছেন? চোখে পড়েনি। এখন ব্যর্থ সেনা অভ্যুত্থান প্রসঙ্গ আলোচনা শুরু করে এ প্রসঙ্গটি আনলাম কেন? কারণ এসবের অগণতান্ত্রিক অনেক কিছুর যোগফল সেনা অভ্যুত্থান স্বপ্নবিলাসসহ অগণতান্ত্রিক পক্ষগুলোকেও আস্কারা দেয়।
প্রবাসী ব্যবসায়ী ইশরাক অভ্যুত্থান অপচেষ্টার সঙ্গে নিজের সংশ্লিষ্টতা অস্বীকার করলেও নিষিদ্ধ জঙ্গী সংগঠন হিযবুত তাহরীর করেনি। উল্টো এ ব্যাপারে সেনা ঘোষণার পরপরও মাঠে নামার মরিয়া চেষ্টা করেছে! ওয়াকিফহালরা এখনও দেশের বিভিন্ন এলাকায় কখনো নিজেদের ব্যানারে, কখনো জামায়াত-শিবিরের ব্যানারে ঝটিকা নামে। রসুনের গোড়া এক জায়গায়! ইশরাক নিজেকে মোল্লাপন্থী না’ দাবি করতে গিয়ে বলেছেন, তিনি মদ খান। তার ঢাকার বাড়ি থেকে মদ উদ্ধারের কথা বলেছেন। কিন্তু হিযবুত তাহরীর বলেনি যে ইশরাকের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক ছিল না। সবচেয়ে বিপদজ্জনক হলো দেশে জঙ্গি নেই বলে সরকারের দাবিকে অসার হিসাবে নতুন চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছে মর্ডান মোল্লা এই সংগঠন! জঙ্গি সংগঠন বলতে সরকার হয়তো শায়েক-বাংলা ভাইদের জেএমবি-হরকাতুল জিহাদ বোঝাতে চেয়েছে। কিন্তু কাঠমোল্লাগোছের এদের চেয়ে যে পড়াশুনা করা বৈদেশিক মদদপুষ্ট দেশি ধনীর দুলালদের একটি সংগঠন দেশের সরকারি-বেসরকারি নানা প্রতিষ্ঠানে ছড়িয়ে পড়েছে, তাদের সঙ্গে আইটি বিশেষজ্ঞও আছেন উল্লেখযোগ্য সংখ্যক, নিষিদ্ধ করলেও এদের ব্যাপারে সরকার কী আগে এমন সিরিয়াসলি ভেবেছে? সরকারি লোকজন এখনও এদের আন্তর্জাতিক কানেকশন নিয়ে ভুল করে এদের সঙ্গে বিলাতের হিযবুত তাহরীরের সম্পর্কের কথা বলেন। অথচ ওয়াকিফহালরা জানেন বিলাতের চাইতে অস্ট্রেলিয়ান হিযবুত তাহরীরের সঙ্গে বাংলাদেশের হিযবুতওয়ালাদের সম্পর্ক তুলনামূলক ঘনিষ্ঠ। মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশটাকে বদলে দেওয়া এদের মূল নিয়ত। সব ধর্ম-বর্ণের মানুষের জন্য এটি সমান একটি দেশ হবে বলে বাংলাদেশে যুদ্ধ হয়েছিল। স্বপ্ন ছিল একটি গণতান্ত্রিক ধর্ম নিরপেক্ষ বাংলাদেশ। কিন্তু বাংলাদেশি বাঙ্গালিদের স্বপ্ন পাল্টে দিয়ে এরা দেশটারে করতে চায় একটি ধর্মরাষ্ট্র, সো-কল্ড ‘খিলাফত স্টেট’! এর মাধ্যমে চল্লিশ বছর আগের পরিত্যক্ত পথে তারা বাংলাদেশকে ফিরিয়ে নেবার ষড়যন্ত্র করছে, ভূতের মতো পিছনে হাঁটিয়ে নিতে চাইছে! সবচেয়ে বিপজ্জনক তথ্যটি হলো তাদের সঙ্গে জামায়াত-শিবিরসহ মোল্লা রাষ্ট্র স্বপ্নের সকল পক্ষের সংশ্লিষ্টতা। সেনানিবাসের ভিতরেও তাদের লিফলেট পাওয়ার খবরও ওয়াকিফলরা জানেন।
প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্প্রতি ঢাকা সেনানিবাসে জেনারেলদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। এর আগে সেনাবাহিনীর ফর্মেশন বৈঠকও হয়। এ দুটি বৈঠকে হিযবুত তাহরীর প্রসঙ্গ কীভাবে এসেছে, প্রতিকারের কী কী সুপারিশ এসেছে, তা ওয়াকিফহালরা জানেন। এর সঙ্গে যেন সামনের দিনগুলোতে যুদ্ধাপরাধীদের আন্ডাবাচ্চা জামায়াত-শিবিরের ক্যাডার, তাদের আশ্রয়দাতাদের বিষয়গুলো মাথায় রাখা হয়। সর্বশেষ ব্যর্থ অভ্যুত্থানের সঙ্গে ২৫-২৬ জনের জড়িত থাকার কথা জানা গেছে। মার্চের মধ্যে যদি তদন্ত শেষ হয়, এর সারবত্তা যেন জানানো হয় দেশের মানুষকে। ভালোমন্দ যাই হোক দেশের মানুষ গণতন্ত্রের পথেই থাকতে চায়। কোনভাবেই সাবেক দুঃস্বপ্নের অগণতান্ত্রিক পথে আর নয়। পরিত্যক্ত পাকিস্তানি মোল্লা রাষ্ট্রের পথে আর নয়।
ফজলুল বারীঃ সিডনিপ্রবাসী সাংবাদিক
বাংলাদেশ সময় ১৫৪৬ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৬, ২০১২