মুন্নী ভাবী তথা প্রয়াত জাহাঙ্গীর সাত্তার টিংকুর সহধর্মিনী খুজিসতা নূরে নাহারিন মুন্নীর ‘কোথায় আছ, কেমন আছ?’ লেখাটি পড়ে কাঁদেননি, এমন লোক কম পাওয়া যাবে। ফেসবুকে লেখাটির শেয়ার দিতেই অনেক বার্তা আসে।
আঠার বছরের জীবনের ছায়া লিখেছেন মুন্নী ভাবী। অনেক কথা। ব্যক্তিগত পারিবারিক অনেক স্মৃতি লিখেছেন। মরণব্যাধি ধরা পড়ার পর তার-তাদের বিন্দু বিন্দু জমানো কষ্ট, দুরারোগ্যের বিরুদ্ধে সংগ্রামের ডায়েরি, শেষদিকে নব্বুইয়ের আগুন ঝরানো ছাত্রনেতা জাহাঙ্গীর সাত্তার টিংকুর পক্ষাঘাতগ্রস্ত হুইল চেয়ার নির্ভর জীবন, এর সব কাহিনী এমন আন্তরিক নিবিঢ়ভাবে তো মুন্নী ভাবীর পক্ষেই জানা লেখা সম্ভব। নিশ্চিত মৃত্যুর অপেক্ষায় অপেক্ষমাণ প্রিয় টিংকু ভাইয়ের শেষ সময়গুলো হুইল চেয়ারে কাটানোর খবরটি আমি জানতাম না। অশ্রু সম্বরণ করতে পারিনি।
সিডনিতে টিংকু ভাইয়ের ঘনিষ্ঠ বেশ কিছু লোকজন আছেন। মনসুর আহমদ, ইফতেখার উদ্দিন ইফতু তাদের অন্যতম। মনসুর আহমদ টিংকু ভাইয়ের রাউজানের গ্রামের ছেলে। চট্টগ্রামে ছাত্রলীগের নেতৃ্ত্বে ছিলেন ইফতু। নানাভাবে দীর্ঘদিন ধরে টিঙ্কু ভাইয়ের ঘনিষ্ঠ ছিলেন। সিডনির বাঙালি সমাজেও তারা পরিচিত মুখ। কার কোথায় কি সমস্যা হলো তা জানলে বা খবর পেয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে জানেন।
এ দু’জন এখানে আমারও ঘনিষ্ঠ। টিংকু ভাইকে নিয়ে বাংলানিউজ আর কালের কন্ঠের ‘রাজনীতি’র লেখা পড়ে দু’জনে আবেগ ধরে রাখতে পারেননি। টেলিফোনে লম্বা আলোচনায় নানা স্মৃতিচারণ করে বলেন, আমরা রাজনৈতিক কারণে টিংকু ভাইকে ভালোবাসতাম। এর বাইরে সাংবাদিকদের সঙ্গেও তার যে এত ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল, বিশেষ করে আপনার সঙ্গে, তা জানতাম না। মনসুর আহমদ বলেন, অনুসারী রাজনৈতিক কর্মীদের সঙ্গে তার সম্পর্ক এতোটাই নিবিঢ় ছিল যে, চেহারা দেখেই তিনি বুঝতে পারতেন, কে কী কারণে এসেছেন। সেভাবেই সমাধান দেওয়া শুরু করতেন।
টিংকু ভাইকে নিয়ে লেখার জন্যে কৃতজ্ঞতা যারা জানিয়েছেন, তাদের সবাইকে বলেছি, এতো আমার দায়িত্ব। খুব ছোট করে দায়িত্বটি পালনের চেষ্টা করেছি মাত্র।
নব্বুইয়ের স্বৈরাচার বিরোধী গণঅভ্যুত্থান বিজয়ী ছাত্রনেতাদের মধ্যে সবার আগে চলে গেলেন জাহাঙ্গীর সাত্তার টিংকু। অথচ বয়সে তিনি তাদের অনেকের চেয়ে নবীন ছিলেন। মনে নবীন। চেতনায়। বিশ্বাসে। সেই ছাত্রনেতাদের অনেকে এখন শারীরিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে ভালো নেই। টিংকু ভাইয়ের মৃত্যুর পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার শোকবাণীতে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে তার ভূমিকা-অবদানের কথা বলেছেন। জীবিত অবস্থায় তার কোনো রাজনৈতিক মূল্যায়ন করা না হলেও মৃত্যুর পর অন্তত তা স্বীকার করা হয়েছে।
স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে অবদান রাখা জীবিত অন্য ছাত্রনেতাদের যথাযথ মূল্যায়ন করার মাধ্যমে টিংকুর প্রতি সম্মান দেখানো সম্ভব। কারণ, আজকের শেখ হাসিনা-খালেদা জিয়া যে অবস্থানে পৌঁছেছেন-আছেন, এর পুরো কৃতিত্ব সেই আন্দোলন আর নেতাদের। মৃত্যুর পর শুধু শোকবাণী আর কফিনে পুষ্পস্তবক নয়, জীবিত নেতাদেরও প্রতি অনেক দায়িত্ব পালনের বিষয় আছে। এ দায়িত্বের কথা যাতে ভুলে না যাওয়া হয়।
প্রয়াত প্রিয়তম স্বামীর উদ্দেশ্যে ‘কোথায় আছ, কেমন আছ’ জানতে চেয়েছেন মুন্নী ভাবী। না ফেরার দেশে কেমন থাকে মানুষ? অথবা তার আত্মা? মানুষে যদি বিশ্বাস করি, বিশ্বাস করি মানবিকতায়, টিংকু ভাইয়ের ভালো থাকার কথা। কারণ, জীবিত থাকাকালে সব সময় তিনি যে শুধু মানুষেরই ভালো করারই চেষ্টা করতেন।
এমন একজন মানুষ ভালো থাকুন, সে কামনাই করি। মুন্নী ভাবী, টিংকু ভাইয়ের শোকার্ত স্বজন, শোকার্ত চট্টগ্রাম-রাউজানবাসী সবাইকে সমবেদনা জানাই। আমরা যে কী হারিয়েছি, তা এখনও সঠিক পরখ করতে পারছি না।
ফজলুল বারীঃ সিডনি প্রবাসী সাংবাদিক
বাংলাদেশ সময়: ১৭২৩ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৮, ২০১২