ঢাকা, শুক্রবার, ১৭ কার্তিক ১৪৩১, ০১ নভেম্বর ২০২৪, ২৮ রবিউস সানি ১৪৪৬

মুক্তমত

মধ্যরাতের অশ্বারোহীর জন্য একটি এলিজি

ফজলুল বারী, কন্ট্রিবিউটিং এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩৫২ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২০, ২০১২
মধ্যরাতের অশ্বারোহীর জন্য একটি এলিজি

মৃত্যুর কী মড়ক লেগেছে দেশে? একের পর এক প্রিয় মানুষগুলো মারা যাচ্ছেন! প্রিয় ফয়েজ ভাই’র মৃত্যু সংবাদ বাংলানিউজের পাতায় দেখেই মন ফুঁড়ে প্রশ্নটি বেরুলো!

দেশে একের পর এক প্রিয় মানুষজন মারা যাচ্ছেন, চলে যাচ্ছেন না ফেরার দেশে, আর অবিচুয়ারি লিখে যাচ্ছি! হয়ে যাচ্ছি নিয়মিত একজন অবিচুয়ারি রাইটার! অথচ প্রতিদিন দেশের বিষয়ে লেখারতো আরও অনেক কিছু আছে- থাকে। প্রয়াত প্রিয়জনের জন্য একটি এলিজি অথবা অবিচুয়ারি লেখা কী এড়ানো যায়! তা’তো দায়িত্বও মনে হয়।

ফয়েজ ভাই তেমন প্রিয় একজন আমার। মৃত্যুর আগে তার চোখ, দেহ দান করে গেছেন ফয়েজ আহমদ। চোখ বিক্রি বিষয়ক একটি রিপোর্টকে কেন্দ্র করেই সবশেষ তার সঙ্গে দেখা-কথা হয়। সে বিষয়টিতে পরে আসছি।
 
স্বৈরাচারী এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের সময় আমরা যারা মিডিয়ায় হাঁটি হাঁটি পা পা চলা শুরু করেছি, ফয়েজ ভাই তখন আমাদের সামনে তারকা সাংবাদিক। `মধ্যরাতের অশ্বারোহী’র কিংবদন্তী চরিত্র। তখনকার যুগে মিডিয়ায় রাতের শিফটে কাজের বৃত্তান্ত বলতে বলতে দেশের সামাজিক-রাজনৈতিক চিত্রটি নিজের মতো ফুটিয়ে তোলার গুণে ফয়েজ আহমদ দেশের বিশিষ্ট মিডিয়া ব্যক্তিত্ব। আগে মিডিয়ায় কাজ করতে পড়াশুনার পাশাপাশি রাজনৈতিক কমিটমেন্ট ছিল গুরুত্বপূর্ণ। সমাজবদলের সমাজতান্ত্রিক স্বপ্ন, আপাদমস্তক অসাম্প্রদায়িক চেতনার লোকজনই মিডিয়ায় আসতেন, কাজ করতেন। ফয়েজ ভাই ছিলেন তাদের দিশারীদের একজন। একই সঙ্গে তিনি ছিলেন একজন সাহিত্যিকও। ছড়া লিখতেন, শিশু সাহিত্যের তিনি ছিলেন দেশের অন্যতম দিশারী চরিত্র। তবে এর সবকিছু ছাপিয়ে তার সাংবাদিক চরিত্রটি উজ্জ্বালোকিত। বিয়ে থা’ করেননি। এর কারণেও সাংবাদিকতার ভবঘুরে চরিত্রটি ষোল আনাই ছিল তার মধ্যে। সাংবাদিক জীবনের পুরোটা উপভোগ করেছেন তিনি। যদিও মিডিয়ার ‘ধান্ধাবাজ’ চরিত্রগুলো ‘নিজের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো মানুষটিকে’ বিশেষ পছন্দ করতো না।

প্রথম দিকে দেশের নানা রাজনৈতিক ঘটনার বিশ্লেষণ আনতে-জানতে যেতাম তার কাছে। একুশ। মুক্তিযুদ্ধ অথবা রাজনৈতিক গুরুত্বপূর্ণ নানা ইস্যুতে ইন্টারভ্যু-মতামত নেবার বিষয়েও তিনি ছিলেন বিশেষ নির্ভরযোগ্য। প্রেসক্লাব বা তার বাসায় এমন অনেক বৈঠক হয়েছে। মগবাজার, শান্তিনগর, ধানমন্ডিসহ ঢাকার নানা এলাকায় থেকেছেন। যেভাবে লিখতেন, বলার সময়ও দাড়িকমা সব উল্লেখ করে বলতেন। তা ঠিকমতো লিখছি কিনা তা মাঝে দেখতেনও। সিনিয়ররা নানান গল্প বলতেন তার। নিজের সংসার না থাকলেও তিনি অনেকের সংসারের সদস্য ছিলেন। সুখেদু:খে তিনি থাকতেন তাদের সঙ্গে। সাংবাদিক বা ঘনিষ্ঠ কাউকে বিপদে সাধ্যমতো ধারকর্জ, এমনকি বাজার করে দেওয়া, ডাক্তার দেখানো, ওষুধপথ্যের ব্যবস্থা করা এসব ছিল তার দৈনন্দিন কাজের তালিকাভূক্ত।
 
তার জীবন নিয়ে নানান জনপ্রিয় গল্প চালু ছিল। এর একটি ছিল চিরকুমার ফয়েজ আহমদ ঢাকায় ভাবীদের পাড়ায় বিশেষ জনপ্রিয়। সাংবাদিক ভাবী, রাজনৈতিক ভাবী, প্রগতিশীল ব্যবসায়ীর স্ত্রী তথা ভাবীদের কার রান্না, খাবার টেবিলটি বেশি পরিপাটি তা মজা করে বলে দিতে পারতেন। বলা হতো ফয়েজ আহমদ তার বেশিরভাগ দুপুরের খাবারের জন্য শিডিউল করে এমন ভাবীদের অতিথি হতেন। অনেকে আবার ভালো রান্না করলে দাওয়াত করতেন ফয়েজ আহমদকে। শিডিউল তার ফাঁকা থাকলে সেদিন, অথবা আরেকদিন! আমরা যখন থেকে তাকে দেখি, তখনও একটি নেশা তার ছিল। কথা বলতে বলতে নস্যি নিতেন নাকে।   পোশাকে চলনেবলনে, আচরণে কেতাদুরস্ত, সৌখিন মানুষ ছিলেন। চিরুনি প্রীতি তার বিশেষ আলোচিত ছিল। মাথায় চুলের অবস্থাটি যে পর্যায়ে থাকুক না কেন, ঘনঘন সেটিতে চিরুনি বোলানো তার প্রিয় অভ্যাস ছিল। বয়সের বিপুল ব্যবধান সত্ত্বেও সবকিছু বলা, শেয়ার করা যেত প্রিয় ফয়েজ ভাই’র সঙ্গে।

এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের সময়ও তিনি পূর্বকোণের ঢাকা ব্যুরোপ্রধান। বর্তমানে লন্ডন প্রবাসী আবু মুসা হাসান, রাজু ভাই তার সঙ্গে কাজ করতেন। তারা সে চাকরিটি ছাড়ার পর আমি সেখানে যোগ দেই। সম্ভবত মিডিয়ায় পূর্বকোণের ঢাকা অফিসের চাকরিই ছিল তার অফিসিয়াল শেষ চাকরি। কিন্তু তখন লেখালেখির চেয়ে আন্দোলনে-সংগঠনে সময় দিতেন বেশি। সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট, পেশাজীবী সংগঠনের সঙ্গে ওতোপ্রোত জড়িত ছিলেন।

দুইনেত্রী হাসিনা-খালেদার কাজিয়া তখনও নিত্য বাস্তবতা। অথচ তাদের ঐক্য ছাড়া জোরদার হচ্ছিল না আন্দোলন। মুক্তিযোদ্ধা সাংবাদিক ফয়েজ আহমদ দুইনেত্রীর সংলাপ-ঐক্য প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। এরকারণে আইয়ুব শাহীর মতো এরশাদ শাহীও তাকে বন্দী করেছে। এরশাদবিরোধী আন্দোলনে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট, জাতীয় কবিতা পরিষদ এসব সংগঠন যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে, এর অন্যতম কারণ ফয়েজ আহমদের বলিষ্ঠ ভূমিকা।

১৯৯৬-২০০১ যুগের খালেদা শাসন আমলে সৃষ্ট রাজনৈতিক অচলাবস্থার নিরসন, শহীদ জননীর নেতৃ্ত্বাধীন যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের আন্দোলনেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন চির বিপ্লবী ফয়েজ আহমদ।

সন্তানের সুখ চিন্তায় এক নারীর চোখ বিক্রির আগ্রহ-আকুতিভিত্তিক এক রিপোর্টকে কেন্দ্র করে তার সঙ্গে সর্বশেষ কথা-দেখা হয়েছিল। মানবজমিনে সাংবাদিক মারুফ মল্লিক প্রথমে রিপোর্টটি করেন। পরে রিপোর্টটি জনকন্ঠে আরও বিস্তারিত তুলে আনলে দেশ-বিদেশ থেকে ব্যাপক সাড়া আসে। জীবিত কারও চোখের কর্নিয়া বিক্রি করা যায় কিনা তা জানতেন না সেই স্বামী পরিত্যক্ত মা। সন্তানের সুখ চিন্তায় নিরুপায় ধারনা থেকে তিনি আবেদনটি করেন।

খবরটি ফয়েজ আহমদকে এমন বিচলিত করে যে ফোনে ধানমন্ডির বাসায় ডেকে নিয়ে গিয়ে তিনি সেই মায়ের আর তার সন্তানের ভরণপোষনের দায়িত্ব নেবার আগ্রহ প্রকাশ করেন। প্রাথমিকভাবে তার তিনমাসের ব্যয়-বাবদ তুলে দেন তিনটি একাউন্টপেয়ি চেক। এর ফলোআপ রিপোর্ট করলে এত সাড়া আসে যে ফয়েজ আহমদকে আর সে মায়ের জন্য উদ্বেগ করতে হয়নি। বিলাতের একটি বৈকালিক দৈনিক মেট্রো রিপোর্টটি লুফে নিলে শিশু সন্তানসহ সে নারীর নিরুদ্বেগ জীবন কাটানোর স্থায়ী একটি ব্যবস্থা হয়ে যায়।

ফয়েজ আহমদের মৃত্যুর পর তার চোখ-দেহ দান করার খবরটি পড়ে সে ঘটনাটি খুব মনে পড়েছে। চোখ দান করলে এভাবে কারও মৃত্যুর পরও বেঁচে থাকে একজনের চোখ। ফয়েজ আহমদের কর্নিয়ায় দেখা আলোয় সৌভাগ্য ফিরবে দৃষ্টি হারানো কেউ একজন। তার চোখে বাংলাদেশ দেখবেন সেই সৌভাগ্যবান। বাংলাদেশের সাহিত্যে-সাংবাদিকতায় অনন্য অবদান-ভূমিকার পাশাপাশি রাজনৈতিক-সামাজিক অনেক অবদানের কারনে ফয়েজ আহমদকে  ভুলবেনা দেশ।
 
না ফেরার দেশে ভালো থাকুন প্রিয় ফয়েজ ভাই। মনে থাকবে বহু দিন, আপনার রূপান্তরের দিশা।

ফজলুল বারীঃ সিডনি প্রবাসী সাংবাদিক  

বাংলাদেশ সময় ১৩৪৬ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২০, ২০১২

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।