প্রিয় টুনটুনিকে নিয়ে কিছু একট লিখবো ভাবছি আট-নয় দিন ধরে, কিন্তু লিখতে গেলেই হাতটা কেন যেন অবশ হয়ে আসছে। অথচ অন্য কোন লেখা লিখতে আমার এরকম হচ্ছে না।
যতদিন আমি রুনিকে দেখেছি আমার কখনোই মনে হয়নি রুনি উৎশৃঙ্খল, ঝগড়াটে, বদমেজাজী বা আরো খারপ বিশেষণের কেউ। লেখাটা লিখতে গিয়ে আমার চোখের সামনে ভেসে উঠেছে কাজের প্রতি রুনির একাগ্রতা, কাজের ফাঁকে সুযোগ পেলেই সহকর্মীদের সাথে গল্পে মেতে উঠা, হঠাৎ করে অট্ট হাসিতে অফিস কাপিয়ে দেয়া, খাওয়ার গন্ধ পেলেই সেখানে ঝাপিয়ে পড়া, অফিসে কারো জন্মদিনের কেক কাটা হলে ভাবখানা এমন যেনো পুরোটাই খেয়ে ফেলবে, এসাইনমেন্ট না দেওয়া হলে গাল ফুলিয়ে নাকের ওপর ১৯টা ভাজ তুলে অভিমান করে বসে থাকা এবং কারো কোন দুঃসংবাদ শুনলে চোখের পানির কলটা ছেড়ে দেওয়া। সেই রুনিকে স্বামীসহ খবরের প্রথম শিরোনাম হতে হলো, এটা ভাবতেই কষ্ট লাগে। আর এই কষ্টের পরিধিটা আরো বেড়ে যায়, যখন আমরা সহকর্মী সাংবাদিকরা আমাদেরই কলমে রুনিকে নিয়ে এমন অনেক ঘটনা তুলে ধরছি, যার সাথে সত্যের কোন মিল আছে বলে অন্ততঃ আমার মনে হয়না।
জার্মানি থাকা অবস্থায় টুনটুনি ফেইসবুকে আমাকে অনলাইনে দেখলেই বলতো, দাদা বিদেশে আর ভালো লাগছেনা। দেশে চলে আসবো। এখানে (জার্মানি) যারা থাকে, তাদের কেউ কারো সাথে তেমন কোন সম্পর্ক রাখেনা। মাঝে মাঝে খুব একাকী মনে হয়। কথা বলার জন্যও কাউকে খুঁজে পাওয়া যায় না। শেকড়ের টানে, নিজ দেশের মানুষের ভালবাসার টানে রুনি- সাগর জার্মানীকে চিরবিদায় জানিয়ে দেশে ফিরলো ঠিকই। কিন্তু বাঁচতে পারলো না। খুন হলো দু’বার। একবার আততায়ীর ছুরিকাঘাতে আরেকবার সাংবাদিক সহকর্মীদের কলমে।
আমি জানিনা আমার সাংবাদিক সহকর্মীদের কে এমন তথ্য সরবরাহ করছে। আবার কেউ তথ্য দিলেই কি আমরা তা ছাপিয়ে দেব বা প্রচার করে দেব কোন যাচাই বাছাই না করে? আর এটা করতে গিয়ে আমরা সাংবাদিকরা নিজেদের যে কত বড় ক্ষতি করে ফেলেছি, তা কি একবারের জন্যও ভেবে দেখেছি! আর ভাবিনি বলেই আমাদের এই কল্প কাহিনী প্রচার না করার বিবৃতি দিতে হয়েছে দেশের বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবীসহ অনেককে। এতে কি আমরা লাভবান হয়েছি?
এই অন্যায় কর্মকা-ের জন্য আমাদের সাংবাদিকতা তিন জায়গায় কলংকিত হয়েছে বলে আমার ধারনা। এক. অতি আবেগের কারণে রুনি-সাগর হত্যাকান্ড যারা তদন্ত করছেন, তাদের সামনে অনেকগুলো কল্পকাহিনী নিয়ে এসে আমরা গোয়েন্দাদের বিভ্রান্তিতে ফেলে মূল আসামিদের পালিয়ে থাকার সুযোগ করে দিয়েছি। দুই. আমাদের সহজ সরল দুই সহকর্মী রুনি-সাগরের মর্মান্তিক হত্যাকা-ের রক্তের দাগ মোছার আগেই আমরা তাদেরকেই অপরাধী বানিয়েছি। প্রকৃত হত্যাকারীদের গ্রেফতারের ব্যাপারে তাদের পরিবার আমাদের কাছ থেকে যে সহযোগিতা পাওয়ার কথা তা না পেয়ে তারা কি দেখলো? দেখলো আমরা প্রতিদিন কোনো না কোনোভাবে তাদের চরিত্রহনন করার চেষ্টা করছি। আর এগুলো দেখেই হয়তো মেহেরুন রুনির পরিবার একটি জাতীয় দৈনিকের সাথে আলাপকালে বলেছে “খুনিদের গ্রেফতার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি, নইলে আত্মাহুতি”। তাদের এই ভাবনা আর উদ্বেগ উৎকন্ঠা যে শুধু সাংবাদিকদের কারণেই, তা কি আমরা বুঝতে পারছি? তিন. দেশের আপামর সাধারণ মানুষ যারা যে কোন বিষয়ে আমাদের সাংবাদিকদের উপর আস্থা রাখে, বিশ্বাস করে আমাদের লেখনিকে; আমরা তাদের বিশ্বাস ভঙ্গ করেছি। দর্শক ও পাঠকরা কি আমাদের ক্ষমা করবেন অথবা তারা কি আমাদের সত্য ও নির্ভীক সাংবাদিক হিসেবে গ্রহণ করবেন ভবিষ্যতে?
সবমিলিয়ে আমরা অনেকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হলাম। আমরা যারা দীর্ঘদিন ধরে তার সাথে কাজ করেছি, আমরা আপনাদের কাছে করজোড়ে মিনতি জানাই, একটু ধৈর্য্য ধরুন। আমাদের গোয়েন্দারা এরচেয়েও অনেক চাঞ্চল্যকর ঘটনার সূত্র খুঁজে বের করে প্রকৃত অপরাধীদের গ্রেফতারে সমর্থ হয়েছে। আমরা যেন রুনি- সাগর হত্যাকা- নিয়ে মুখরোচক গল্প না বানিয়ে তাদের পরিবার ও একমাত্র শিশু সন্তানের পাশে থাকি। যেন তাদের পরিবারের ভাবনা থেকে হারিয়ে যায় আত্মাহুতির বিষয়টি।
আমি কিছুতেই মানতে পারিনা, টুনটুনি নেই। ফেসবুক খুললে কেবলই মনে হয়, এখনই বলবে, দাদা আপনারা এভাবে আমাদের অপমান করতে পারলেন! আমি কি লিখবো! প্রিয় টুনটুনি আমাদের ক্ষমা করিস!
বাংলাদেশ সময় ১৯০৮ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২০, ২০১২