ঢাকা, শুক্রবার, ১৭ কার্তিক ১৪৩১, ০১ নভেম্বর ২০২৪, ২৮ রবিউস সানি ১৪৪৬

মুক্তমত

‘তালগাছটি কিন্তু তাহার!’

ফজলুল বারী, কন্ট্রিবিউটিং এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭২৩ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২১, ২০১২
‘তালগাছটি কিন্তু তাহার!’

দেশের এনজিও সংগঠন তথা বেসরকারি উন্নয়ন কর্মী-প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে বিএনপি তথা চারদলীয় জোটের সংগঠনগুলোর সম্পর্ক আমরা জানি।

বিগত চারদলীয় জোট আমলে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় এনজিও কর্মীদের সমাবেশে চারদলীয় বড় হুজুর বাহিনী হামলা ও তাণ্ডব চালায়।

সেদিন সেই তিতাস পাড়ের শহরে শার্ট-প্যান্ট পরা লোকজনকে দেখে দেখেও ধরে পিটিয়েছে বড় হুজুর বাহিনী!

এনজিও সংগঠনগুলোর মাধ্যমে নারীর ক্ষমতায়নের ঘোর বিরোধী চারদলীয় শরীক জামায়াত-ইসলামী ঐক্যজোট। তাদের অভিযোগ, এতে করে স্বাবলম্বিতার নামে বেপর্দা, বেগানা(!) হয়ে যাচ্ছে নারী।

আসল কথা, এতে গ্রামের সনাতন দাদন ব্যবসা, হুজুরদের পানিপড়া ও তাবিজপড়া ব্যবসায় টান পড়েছে।

এজন্যে ইসলামী ঐক্যজোট মার্কা চারদলীয় হুজুরদের ফতোয়ার টার্গেটও এনজিও সংগঠনগুলো। আবার এসব ফতোয়াবাজ মোল্লাদের মুরব্বি খালেদা জিয়াকে ফ্লোর দেবার এনজিওও দেশে আছে। গ্রামীণ ব্যাংকের ড. ইউনূসকে কেন্দ্র করে সরকারের ‘নেই কাজতো খই ভাজ’ ঝামেলা পাকানোর কারণে এ সুযোগটিও বেড়েছে। সে কারণে আমরা দেখলাম, সর্বশেষ ডা. জাফরউল্লাহ চৌধুরীর গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের কর্মসূচির উদ্বোধন করলেন ড. ইউনূস। আর সমাপনী টেনেছেন খালেদা জিয়া!

ড. ইউনূস সেখানে আবার রাজনৈতিক বক্তৃতাও দিয়েছেন! নব্বইয়ের দশকে ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউটে ড. কামালদের গণফোরাম সমুদ্র সৃষ্টির কনভেশনে(!) ‘পথের কাঁটা সরাতে হবে’ শিরোনামের বক্তৃতায় প্রথম রাজনৈতিক বক্তৃতা নিয়ে মাঠে নামেন ড. ইউনূস। খুব আলোচিত ছিল তার সেই বক্তৃতা। অনেক নতুন কথার ফুলঝুরি ছিল। কিন্তু সে সব কথামালার ফুলঝুরি পরে ড ইউনুসের কারণেই মাঠে মারা যায়। কারণ, সবাই দেখেন মুখে ভালো ভালো কথা বললেও ড. ইউনূসের কাছে বড় তার এনজিও ব্যবসার মুনাফা। এসব মুনাফায় যেখানে যখন টান পড়ে তখন তার বিরুদ্ধে সরকারকে ধমক দিতে-শায়েস্তা করতে বিদেশিদের ডেকে আনেন তিনি। সেই গণফোরামও তাই পরে আর সমুদ্র হয়নি। হয়ে যায় বদ্ধ পুকুর! ১/১১’র তত্ত্বাবধায়ক আমলে ইউনূসের রাজনৈতিক লক্ষ্যটি আরও প্রকাশিত হয়।

১/১১’র সরকারের পেছনের নিয়ামক সামরিক শক্তিকে নির্ভর করে রাজনৈতিক দল গড়ার চেষ্টা করেছিলেন ইউনূস। জেনারেল মইনদের দুই-আড়াই বছরের টার্গেট শুনে নিজে আর তত্ত্বাবধায়ক প্রধানের দায়িত্ব না নিয়ে ড. ফখরুদ্দিনকে সেখানে নিয়ে আসেন তিনি। তার রাজনৈতিক দল গড়ার চেষ্টাটিও মুখ থুবড়ে পড়ে।

গ্রামীণ ব্যাংকের মাধ্যমে ড. ইউনূসের বিশাল কাজটি এভাবে ব্যবসায়িক স্বার্থে বিদেশিদের তাবেদারি আর সামরিক শক্তিকে ব্যবহার করে রাজনৈতিক দল গড়ার মতলবি চেষ্টায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। গ্রামীণ ব্যাংকে তার অবদানকে খাটো করার সরকারি প্রচেষ্টাকে দেশের বেশিরভাগ মানুষ পছন্দ করেননি। যেমন পছন্দ করেন না ড. ইউনূসের রাজনৈতিক মতলববাজিও। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারসহ নানা ইস্যুতে তার অবস্থানও স্পষ্ট না।

গণস্বাস্থ্যের ডা. জাফরউল্লাহ চৌধুরী একজন স্বনামখ্যাত মুক্তিযোদ্ধা। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ত্রিপুরার বিশ্রামগড়ে মুক্তিযোদ্ধাদের জরুরি চিকিৎসা সেবায় বিশেষ একটি হাসপাতাল গড়ে চালিয়েছেন প্রায় একা। মুক্তিযুদ্ধের পর সেই হাসপাতালটিই গণস্বাস্থ্য নামে সাভারে স্থানান্তরিত হয়। গণস্বাস্থ্য হাসপাতালের ঢাকা নগর কেন্দ্রটিও রাজধানীর বুকে রোগেশোকে কম টাকায় সেবা পাবার অন্যতম প্রতিষ্ঠান।

এমনিতে দেশের রাজনীতিতে চীনপন্থীদের নৈকট্যের কারণে বরাবরই আওয়ামী বিরোধীদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ডা. জাফরউল্লাহ চৌধুরী। আবার শেখ হাসিনার প্রয়াত স্বামী ড. ওয়াজেদ মিয়াও এক সময় কিছুদিন গণস্বাস্থ্যের সঙ্গে কাজ করেছেন। সেটি কেন এবং কোন পরিস্থিতিতে করেছেন, এ নিয়ে তখন গণস্বাস্থ্যের কি কি সমস্যা হচ্ছিল, তাও ওয়াকিবহালরা জানেন। এখন গণস্বাস্থ্যের ট্রাস্টি সভাপতি হিসাবে দায়িত্ব পালন করছেন বিএনপিপন্থী শীর্ষ বুদ্ধিজীবী সাদেক খান। অতএব, গণস্বাস্থ্যের কর্মসূচি ড. ইউনূস শুরু করেছেন, খালেদা জিয়া শেষ করেছেন, এটি খুব স্বাভাবিকই হয়েছে।

যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে ড. ইউনূসের যেমন মাথাব্যথা নেই, তেমনি ডা. জাফরউল্লাহও দেখিয়েছেন, এ নিয়ে খালেদা জিয়ার ভূমিকায় তার কোনো সমস্যা নেই। সে কারণে তার উন্নয়ন কর্মীদের দিয়ে তিনি যুদ্ধাপরাধীদের রক্ষাকবজ খালেদা জিয়াকে সেলামও করিয়েছেন!

খালেদা জিয়া সেখানে দেশপ্রেমিক নাগরিকদের রাজনীতিতে আসতে বলেছেন। তরুণদের যে তিনি ক্ষমতা দিতে চান, সে কথাও বলেছেন আবার। আর বলেছেন, আগামীতে ক্ষমতায় গেলে তিনি প্রতিহিংসা দেখাবেন না। দেশপ্রেমিক নাগরিকদের আরও বেশি বেশি রাজনীতিতে আসা দরকার। কিন্তু কার নেতৃ্ত্বে? খালেদা জিয়ার? তিনিতো একইসঙ্গে যুদ্ধাপরাধী আর ফতোয়াবাজ মোল্লাদেরও নেত্রী! যাদের দেশপ্রেমের বিষয়টিতো পাকিস্তানপন্থী অথবা ঘরানার!

বাংলাদেশপন্থী দেশপ্রেমিকদের তিনি এভাবে পাকিস্তানপন্থীদের সঙ্গে মিলে যেতে বলছেন যে! তেলে আর জলে? এরপর কী পাকিস্তানের সঙ্গে সেই পুরনো কনফেডারেশন তত্ত্বটি আবার সামনে চলে আসবে? তরুণ নেতা কি সেই চিহ্নিত-পরীক্ষিত তারেক রহমান? যিনি বিদেশে টাকা পাচার করেছেন! মার্কিনিরা তদন্ত করে সিঙ্গাপুরের ব্যাংকে শুধু সে টাকা আটকানো নয়, ঢাকার কোর্টে এসেও স্বাক্ষী দিয়ে গেছেন! আর এখন বিলাতের মতো ব্যয়বহুল দেশে সপরিবারে  বছরের পর বছর থাকতে-চলতে তার কোনো চাকরি বা ব্যবসা করা লাগে না!

এসব তালগাছ নিজের হাতে-নিয়ন্ত্রণে রাখতেই কি খালেদা জিয়া ‘দেশপ্রেমিক নাগরিক’ আর তরুণ সমাজকে রাজনীতির গুটি হিসাবে ব্যবহার করতে চাইছেন? সরকার অনেক কিছুতে ব্যর্থ, এটা আমরা জানি। কিন্তু চল্লিশ বছর পরে হলেও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার যেটি তারা শুরু করেছে, খালেদা জিয়া আবার ক্ষমতায় আসতে পারলে সবার আগে এ বিচার যে পণ্ড করবেন তিনি! নিজামী-মুজাহিদ-সাকাদের গাড়িতে আবার মুক্তিযুদ্ধের শহীদের রক্তে রঞ্জিত পতাকা দেবেন, এতে কি কারও কোনো সন্দেহ আছে?

আর প্রতিহিংসা না দেখানোর বার্তাটি কাদের উদ্দেশ্যে? যারা তারেকের হাড়গোড় ভেঙ্গেছে তাদের উদ্দেশ্যে? সেনাবাহিনীর বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাবার সময় যাদের আগামীতে ‘চাকরি থেকে বের করে দেবার’ হুমকি দিয়ে এসেছিলেন, তাদের উদ্দেশ্যে? এসব কারণে তারাও যে নিজস্ব স্বার্থে বিশেষ জোটবদ্ধ, সে খবরটি তার কাছেও আসে নিশ্চয়!

তা ম্যাডাম, আওয়ামী লীগ ব্যর্থ হলে যেহেতু কোনো তৃতীয় পক্ষ নেই, তাই আপনিই যে ক্ষমতায় আসবেন তা বলতেতো এ দেশে রাজনৈতিক জ্যোতিষী লাগে না, একটু ধীরে চললে হয় না? যে বিচার আপনি করবেন না, বাংলাদেশের শহীদ পরিবারগুলোর প্রতি যেখানে আপনার মাঝে বিন্দুমাত্র কোনো সহানুভূতি-দায়বোধ নেই, এ বিচার পণ্ডের ঐতিহাসিক দায়ভার নেবার জন্য এতো উতলা হয়েছেন কেন? তারেককে ক্ষমতায় বসাবেন, আর এর সঙ্গে টানছেন দেশের মেধাবী পরিশ্রমী তরুণদের, এটা বুমেরাং হয়ে যাবে না! অতএব, সাধু সাবধান!
 
পুনশ্চ: যুদ্ধাপরাধী ঘাতককূল শিরোমনি গোলাম আযমের গ্রেফতারের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক বক্তব্য না দিলেও এ ব্যাপারে বিএনপির অবস্থান কারও কাছে লুকোছাপা নেই। বিএনপির লোকজন এসব নিয়ে কথা বলাও শুরু করেছেন। ‘সাঈদী যুদ্ধাপরাধী না’ এই বক্তব্য দিয়ে চিহ্নিত-কোনঠাসা আসিফ নজরুলের ‘মুরুব্বি’ ড. এমাজউদ্দিন আহমদ এবার মুখ খুলেছেন গোলাম আযমের পক্ষে। সোমবার ঢাকার একটি আলোচনা বৈঠকে গোলাম আযমকে ভাষাসৈনিক আখ্যা দিয়ে তার বিরুদ্ধে জুলুমের প্রতিরোধের ডাক দিয়েছেন খালেদা জিয়ার অন্যতম উপদেষ্টা ড. এমাজউদ্দিন আহমদ! বাংলাদেশের প্রগতিশীল মুক্তমনা তরুণরাই এই জ্ঞানপাপীদের প্রতিরোধ করবে। আমাদের কাজ শুধু এদের চিহ্নিত করে দেওয়া।

ফজলুল বারী: সিডনি প্রবাসী সাংবাদিক

বাংলাদেশ সময়: ১৮৩৩ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২১, ২০১২

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।