ঢাকা, রবিবার, ৭ পৌষ ১৪৩১, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

মুক্তমত

কোন পথে দেশের রাজনীতি?

জসীম সিদ্দিকী, অতিথি লেখক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪৩০ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৪, ২০২২
কোন পথে দেশের রাজনীতি?

রাজনীতির সুবর্ণ দিন হারিয়ে গেছে। প্রায় সবাই এখন রাজনীতির নামে নিজের আখের গোছাতে ব্যস্ত।

এই ‘নষ্ট সময়’ সমাজনীতিতে ফেলছে বিরূপ প্রভাব। ফলে সমাজনীতিও এখন ‘ধান্দাবাজির’ অন্ধকার জগতে পরিণত হতে চলেছে। শুধু গুটিকয়েক ভালো মানুষের কাজের গুণে এখনও কিছুটা আলোকিত রয়েছে সমাজ। শঙ্কার বিষয় এ ভালো মানুষের সংখ্যা দিনে দিনে কমতে থাকলে একসময় সমাজ ব্যবস্থা নষ্ট হয়ে পড়বে। যেহেতু এখানে রাজনৈতিক বিষয় ওতপ্রোতভাবে জড়িত।

তাই রাজনৈতিক দলগুলোকে হতে হবে আদর্শিক। দলগুলো তার নীতি-আদর্শ থেকে চ্যুত হয়ে পড়লে ঘটবে বিপত্তি। আর তখনই আসে বিপ্লবের পর্ব। ইতিহাসের পাতা কিন্তু তাই বলে। যুগে যুগে বিপ্লবের মাধ্যমেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে নীতি-আদর্শ। কোনো সম্প্রদায়, গোষ্ঠী বা রাষ্ট্র যখনই তার নীতি-আদর্শ থেকে চ্যুত হয়েছে তখনই একজন ত্রাতার আবির্ভাব ঘটেছে। নীতি-আদর্শ ফিরে পেয়েছে তার অস্তিত্ব।

রাজনীতি এখন কোন পথে
আমাদের রাজনীতিতে এখন ঘূণ ধরেছে বলা যায়। জনগণের অধিকার আদায়ে যেখানে রাজনীতি মুখ্য ভূমিকা রাখে― সেখানে দেখা যায় রাজনীতিই এখন জনগণের অধিকার খর্ব করছে। এর অন্যতম কারণ ছাত্র রাজনীতিতে চলমান অচলাবস্থা। অচলাবস্থা বলার কারণ হচ্ছে, আগে শিক্ষার্থীদের অধিকার সংক্রান্ত কোনো বিষয় উপেক্ষিত হলে বা জাতীয়-রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে জনগণের কোনো অধিকার লঙ্ঘিত হলে সর্বপ্রথম ছাত্র রাজনীতির মঞ্চ থেকে প্রতিবাদ হতো। এখন তা একেবারে অনুপস্থিত বলা যায়।

এছাড়া ছাত্র রাজনীতি থেকে সৃষ্ট নেতৃত্ব যুগে যুগে রাষ্ট্র রাজনীতিতে রেখেছে ভূমিকা। ফলে জনগণের অধিকার আদায়ে রাজনীতির ভূমিকাই অনস্বীকার্য। আর এখন দুর্বৃত্তরা রাজনীতির পতাকাতলে এসে আশ্রয় নিয়েছে। তাদের অংশগ্রহণে রাজনীতি কলুষিত হয়ে পড়ছে। রাজনীতির প্রতি মানুষের ঘৃণা সৃষ্টি হচ্ছে। রাজনীতিবিদদের প্রতি সৃষ্টি হচ্ছে চরম অনাস্থা, যা জনগণের অধিকার রক্ষা বা রাষ্ট্রের তথা সার্বভৌমত্ব রক্ষায় মারাত্মক হুমকি হয়ে দাঁড়াচ্ছে। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে এখন নতুন নেতৃত্ব সৃষ্টি হচ্ছে না বা নতুন নেতৃত্ব সৃষ্টি করা হচ্ছে না। নেতৃত্ব হারানোর ভয়ে অন্তর্কোন্দল থেকে মারামারি―এমন কি হত্যার ঘটনাও ঘটছে।

এছাড়া দলগুলোর কেন্দ্রীয় কমিটিতে স্থান পাওয়া নেতারাও নেতৃত্ব হারানোর ভয়ে পরবর্তী সময়ে সম্মেলন ও কাউন্সিলের মতো ধারাবাহিকতা রক্ষা করতে আগ্রহ দেখান না। এতে করে রাজনীতিতেও সৃষ্টি হচ্ছে একনায়কতন্ত্র; আর একনায়কতন্ত্র মানে স্বেচ্ছাচারিতা, যা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থার জন্যও মারাত্মক হুমকি বটে। এজন্য রাজনৈতিক দলগুলোর স্থায়িত্ব রক্ষায় নেতৃত্বের বিকাশ দরকার। আর নেতৃত্বের বিকাশ ঘটাতে দরকার গঠনতন্ত্রের ধারাবাহিকতা রক্ষা করা। যেখানে নির্দিষ্ট সময় শেষে সম্মেলন ও কাউন্সিল অধিবেশনের আয়োজন করতে হবে। অথচ যেটা বাধ্যতামূলক―সেটা এখন বাস্তবায়নই করছে না দলগুলো, যা পরিশুদ্ধ রাজনীতি চর্চার পথে বিরাট প্রতিবন্ধকতা।

আর নির্বাচন এলে দেখা যায়- সম্পূর্ণ অনভিজ্ঞ, ব্যবসায়ী, অরাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের মনোনয়ন দেওয়া হচ্ছে, যা লাখ বা কোটি টাকায় কিনতে হচ্ছে তাদের। যার ফলে ক্ষমতায় গিয়ে ওই ব্যক্তি সম্পূর্ণ বাণিজ্যিক হয়ে পড়েন। এতে ক্ষতির পাল্লা জনগণের দিকে ভারী হয়ে ওঠে। পক্ষান্তরে জনগণের ক্ষতি মানে তো রাষ্ট্রেরই ক্ষতি।  

একসময় বাংলাদেশের রাজনীতিতে নেতৃত্ব সৃষ্টির নানা উদ্যোগ ছিল। এখন দলগুলোতে সেই উদ্যোগ একেবারেই নেই। এর প্রধান কারণ হচ্ছে―দলগুলোতে পুরনো যারা নেতৃত্বে আছেন তারা ক্ষমতা হারাতে চান না। নিজেদের তারা দলের জন্য অপরিহার্য করে রাখেন। নতুন নেতৃত্ব সৃষ্টিতে এরাই সবচেয়ে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছেন। মূলত এরাই দলের জন্য বড় ধরনের ‘দুর্বৃত্ত’। এরা মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে গেলেও নিজেদের অপরিহার্য ভাবেন। দলকে নিজের ব্যবসা কেন্দ্র বানিয়ে রাখেন। নিজের নেতৃত্বের সুযোগকে ব্যবসায়িক ডিলারশিপের মতো রাজনৈতিক ডিলারশিপ ভাবছেন। এর জন্য ক্ষতি হচ্ছে মূলত দলেরই। কারণ মেয়াদোত্তীর্ণ পণ্য যেমন বোমা বা বিষের মতো ক্ষতিকর, তেমনি রাজনৈতিক দলের মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটিগুলো সংশ্লিষ্ট দলের জন্য বোমা স্বরূপ বা নির্ভেজাল বিষ।

মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ বা পণ্য ব্যবহার নিষেধ করতে যেমন অভিযান চালায় ভোক্তা অধিকারসহ দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থাগুলো, তেমনি রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যেও এমন মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটি বা নেতৃত্বকে স্বাধীন নির্বাচন কমিশনের মাধ্যমে অভিযান চালিয়ে জেল-জরিমানার বিধান করা যেতে পারে। আমাদের দেশের স্বাধীনতা আন্দোলন বা ভাষা আন্দোলন; মোট কথা জনতার অধিকার আদায়ের সব আন্দোলনই রাজনৈতিক দলের ধারাবাহিক কর্মসূচির মাধ্যমেই হাসিল হয়েছিল। অথচ এখন সে দেশটির রাজনৈতিক দলগুলোতে সম্মেলন-কাউন্সিল কিছু নেই। হলেও দেখা যায় লোক দেখানো এবং সেখানেও মারামারি-হানাহানি।

দেখা যায়, টাকার বিনিময়ে নেতৃত্ব পরিবর্তন বা নেতৃত্বের বেচাকেনা। বিশেষ করে ছাত্র রাজনীতি বা যুব রাজনীতির সংগঠনগুলোতে এসব অপকর্ম ইতোমধ্যে পরিলক্ষিত হয়েছে। এরপর নির্বাচন এলে তো মনোনয়ন বিক্রির মতো ঘৃণ্যতম অভিযোগও অহরহ। অথচ আমাদের দেশ স্বাধীনতা পেয়েছিল রাজনৈতিক দলের কর্মসূচির মাধ্যমে। তাই যে দেশটি রাজনৈতিক কর্মসূচিতে স্বাধীনতা পেয়েছে, সে দেশের রাজনীতি কোনো অবস্থাতেই দুর্বৃত্তদের আশ্রয়স্থল হতে পারে না। কুলষিত হয়ে পড়া রাজনৈতিক দলগুলোতে সংস্কার বা শুদ্ধি অভিযান চলুক। মেয়াদোত্তীর্ণ নেতৃত্বগুলোর মূলোৎপাটন দরকার। নয়তো মেয়াদোত্তীর্ণ নেতৃত্বের বিষক্রিয়ায় রাজনৈতিক দলগুলোর গৃহীত কর্মসূচি সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক দল বা জনগণের স্বার্থে কাজে আসবে না। আর রাজনীতি যদি জনগণের স্বার্থে না আসে, তবে সেসব দলও একসময় কালের অতল গহ্বরে হারিয়ে যাবে।

লেখক: সাংবাদিক

বাংলাদেশ সময়: ১৪২৯ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৪, ২০২২
নিউজ ডেস্ক

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।