ঢাকা : সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের খবর পেয়েছি অফিসে ঢুকে ইন্টারনেটে বাংলানিউজ২৪.কম-এ চোখ বুলাতে গিয়ে।
কয়েক মিনিট লেগেছে মন ও চোখকে স্থির করতে।
খুনের পর থেকে যতটা সম্ভব হয়েছে টেলিভিশন, ইন্টারনেট, সংবাদপত্রে আমি সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের খবর পিছু নিয়েছি- নিজেরসহ অনেকের প্রশ্নের জবাব পেতে।
গত ১২ দিনে এই হত্যাকাণ্ডকে ঘিরে যে তুঘলকী কাণ্ড ঘটেছে তাতে আমার মতো অনেকের শেষ করণীয় হবে মেঘ-এর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা। কারণ, একটি ফুলের মত নিষ্পাপ শিশু আজ এতিম। তার সামনেই তার বাবা-মার খুন হলেন।
বিচার তো দূরের কথা উল্টো রূপকথা প্রচারের অপেক্ষা। তাই মেঘ-এর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা এই কারণে যে রাষ্ট্রের সব ক্ষমতা থাকতেও তার বাবা-মার হত্যা মামলার কোনো অগ্রগতি নেই। তাই আমরা যারা বিবেকবান মানুষ, তারা প্রত্যেকেই মেঘ-এর কাছে ক্ষমা প্রার্থী।
হত্যাকাণ্ডের দিন সকালে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ৪৮ ঘন্টার হুংকার শুনে যতটা না ভাল লেগেছে তার চেয়ে বেশি উত্তেজনা বোধ করেছি পুলিশের সিনেমাটিক কথাবার্তা শুনে। প্রথম দু’দিন মনে হয়েছে সব কিছু নখদর্পণে। ৪৮ ঘন্টা পরে সাংবাদিক সম্মেলনে জানা যাবে।
নির্দিষ্ট সময় পার হয়ে যাওয়ার পরে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বললেন, তিনি পুলিশকে চাপে রাখার জন্য একটা টেকনিক হিসাবে বলেছেন। দায়িত্বশীল ব্যক্তির মুখে এমন কথা বলা কি শোভা পায়?
এরপর ৩-৪-৫ দিন করে ১১-১২তম দিনও পার হয়ে গেল। দিনে দিনে কাছের ছবি দূরে সরে যাচ্ছে। ফিকে হয়ে আসছে উত্তেজনা। চারপাশ থেকে ঘিরে ধরছে সন্দেহ, অনিশ্চয়তা আর হতাশার কুয়াশা।
সবকিছু ছাপিয়ে নিয়মিত খোঁজখবর নিয়ে জানতে পারি কিছু অগ্রগতির কথা। সাতদিন পরে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী দায়দায়িত্ব ঠেলে দিলেন প্রধানমন্ত্রীর কাঁধে! খুনের মামলার তদারকিও প্রধানমন্ত্রীকে করতে হয়?
তবে আর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী থাকার দরকার কি? পুলিশ সপ্তাহকাল পরে বলছে- সংগৃহীত হাত ও পায়ের ছাপ সনাক্তকরণে পর্যাপ্ত নয়। লাশ দেখতে অসংখ্য মানুষ যাতায়াত করায় ছাপ অস্পষ্ট হয়ে গেছে!
আমার প্রশ্ন হত্যাকারীরা তো রুনি ও সাগরকে হত্যা করা ছাড়াও ঘরের জিনিসপত্র তছনছ করেছে। তাতেও হত্যাকারীদের ছাপ আছে।
উৎসুক মানুষের সংখ্যা বেশি হওয়ায় পায়ের ছাপ ও আত্মীয়-স্বজনদের লাশ ধরে কান্নাকটিতে না হয় আঙ্গুলের ছাপ মুছে গেলেও, হত্যাকারীর তছনছ করা জিনিসপত্রে নিশ্চয় দশনার্থীরা হাত দেননি ও জিনিসপত্র থেকে আঙ্গুলের ছাপ মুছে যায়নি?
প্রথম থেকেই হত্যাকারী সম্পর্কে মেঘ-এর দেয়া বক্তব্য থেকে মোটামুটি নিশ্চিত হত্যাকারীর সংখ্যা দু’জন। তারা রুনি পরিবারের পরিচিত। তাহলে হত্যাকারীরা নিশ্চয়ই সিঁড়ি বেয়ে দরজা দিয়ে ঘরে প্রবেশ করেছে।
তবে গ্রিল কাটলো কে? কিংবা কেন? হতে পারে হত্যাকারীরা ঠাণ্ডা মাথায় পরিকল্পনা করে ঘটনাকে অন্যদিকে প্রভাবিত করতে ইচ্ছা করেই গ্রিল ভেঙেছে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে হত্যাকারীদের গ্রিল থিওরি ভালই হয়েছে।
কারণ, তদন্তকারীরাও এখন ঘটনাটিকে চুরি-ডাকাতিকালে হত্যাকাণ্ড ঘটেছে বলে সেদিকেই নিয়ে যাচ্ছে। কারণ, প্রথম দিকে ল্যাপটপ ও মোবাইল হারানোর কথা বললেও এখন ১০ দিন পরে রুনির মাকে দিয়ে লেখানো হয়েছে রুনির ১১ ভরি স্বর্ণ ও ১১শ ইউরো খোয়া গেছে।
বাংলাদেশ পুলিশ একটি নির্দিষ্ট সরকারি ফরম পূরণ করে কোনো লাশ পোস্ট মর্টেম করার আবেদন করে থাকে। ওই ফরমে ৫/৬টি কলাম থাকে- যাতে পুলিশকে লিখতে হয় ডাক্তারের কাছ থেকে তারা কি কি জানতে চান?
সাগর-রুনির পোস্টমর্টেমকালে ডাক্তারের কাছে সাহারা খাতুনের পুলিশ জানতে চেয়েছে মাত্র ২টি প্রশ্ন? একটি তারা কি কারণে মারা গেছেন? আরেকটি রুনি রেপড হয়েছিলেন কিনা? পুলিশ জানতে চায়নি সাগর ও রুনির মধ্যে কে আগে মারা গেছে।
জানতে না চাওয়ার কারণে চিকিৎসকও কারণটি সনাক্ত করেনি। অথচ এই লোমহর্ষক হত্যাকাণ্ডটি সুরাহা করতে এই প্রশ্নের উত্তরটি জানা থাকলে অনেক কিছু সহজে করা যেত।
কারণ, তখন জানা যেত- খুন কি একটার পরে আরেকটা হয়েছে? নাকি সাগর-রুনি দু’জনই একসঙ্গে আক্রান্ত হয়েছিলেন?
প্রথম থেকেই কি রকম একটি ধোয়াশার মধ্যে ঘটনাটি প্রবাহিত হচ্ছে। তাজ্জব হতে হয়- এতবড় চ্যাঞ্চল্যকর হত্যাকাণ্ডের ভিসেরা রিপোর্ট চাওয়া হয়নি। যেখানে থানা লেবেলের হত্যাকাণ্ডেও ভিসেরা রিপোর্ট করা হয়।
এখন শুনছি ভিসেরা রিপোর্টের জন্য লাশ কবর থেকে তোলা হবে। যদি এ রকমটা হয় তবে তা হবে সাগর-রুনির সঙ্গে চরম মসকরা। তাদের আত্মা কষ্ট পেতে পারে এই ভেবে যে দেশের প্রথম শ্রেণীর মানুষ হয়েও তাদের মৃত্যু কোনো ব্যাপারই নয়।
তাছাড়া সাগর-রুনির ব্যবহৃত মোবাইল রেকর্ড নিয়েও পর্যাপ্ত তদন্ত হয়েছে কি না, তা প্রশ্ন সাপেক্ষে?
সবচেয়ে বেশি প্রশ্নের জন্ম দিচ্ছে তদন্তকারীদের বক্তব্য। তারা বারবার বলছেন পরিস্থিতি তাদের নিয়ন্ত্রণে। সময় হলেই জানতে পারবেন। আর কতদিন পেরিয়ে গেলে সময় হবে? নাকি খবর আছে, বলতে পারছে না চাপের কারণে?
এখনতো অনেকে সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডে আরেক জজ মিয়ার আবির্ভাবের কথা ভাবছেন। পক্ষকাল পেরুতে বসেছে হয়ত আর কয়েকটাদিন পেরুতে পারলে অথবা যথারীতি আরেকটি নৃশংস ঘটনা কিংবা কোনো জাতীয় সঙ্কট সাগর-রুনিকে কেড়ে নেবে আমাদের স্মৃতি থেকে।
আমরা ব্যস্ত হয়ে পড়বো নতুন কিছু নিয়ে। ভুলে যাব ফুলের মতো শিশু মেঘ-এর কথা। যে ইতোমধ্যে পৃথিবীর সর্বোচ্চ বঞ্চনার শিকার। সব থাকার পরেও যার ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত।
মেঘ-এর বয়সী সন্তান আমারও আছে। আমি কিছুটা অনুভব করি এ বয়সের একটা বাচ্চা তার বাবা-মায়ের বুকে মাথা রেখে গুটি-সুটি মেরে শুয়ে থাকতে কতটা আনন্দ পায়।
মেঘ-এর কাছে তাই ক্ষমা প্রার্থনা। তার মত একটা নিষ্পাপ শিশুর অনিশ্চিত ভবিষ্যতের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা। তার পিতামাতার হত্যাকাণ্ড নিয়ে লুকোচুরির জন্য ক্ষমা প্রার্থনা। কিছুদিন পরে মেঘকে ভুলে যাব এ জন্য ক্ষমা প্রার্থনা।
লেখক : মাকছুদুল আলম খন্দকার খোরশেদ, সাধারণ সম্পাদক, নারায়ণগঞ্জ মহানগর যুবদল ওয়ার্ড কাউন্সিলর, নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশন। rkexporttrading@yahoo.com
বাংলাদেশ সময় : ১৫৫৫ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২২, ২০১২