ঢাকা : সাংবাদিকরা হল জাতির দর্পণ। তাদের দায়িত্ব জাতির ভালো-মন্দ শাসকদের কাছে তুলে ধরবেন।
খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি যখন প্রথম ক্ষমতায় আসে সে সময়ও সাংবাদিকদের ওপর দমন-নিপীড়ন চলে। সে সময় এর একটিরও বিচার হয়নি।
তখন একই প্লাট ফর্মে সাংবাদিকরা আন্দোলন করতে পারেনি। কারণ, সে সময় তারা দু’ ভাগে বিভক্ত ছিলো। এখনো রয়েছে। আর এই সুবিধাটুকু ভোগ করেছে শাসকগোষ্ঠী। এই বিভক্ত করার পেছনে শক্ত ভূমিকা রেখেছিলো শাসকগোষ্ঠীর উসকানি।
১৯৯৬ থেকে ২০১২ পর্যন্ত অনেক সাংবাদিক নিহত হয়েছেন। এর একটিরও বিচার আমরা পাইনি। একটি হত্যাকাণ্ড ঘটলে আমরা কিছুদিন প্রতিবাদ করি। এরপর আবার একটি ঘটনা ঘটলে সেই ঘটনাটি ধামাচাপা পড়ে যায়।
এখন পাঠকদের সামনে গত ১৫ বছরে সাংবাদিক হত্যার একটি পরিসংখ্যান তুলে ধরছি-
১৯৯৬ থেকে ২০০০ সাল :
১৯৯৬ সালের ৮ জুন সাতক্ষীরার পত্রদূত সম্পাদক শ.ম আলাউদ্দীন খুন হন।
১৯৯৮ সালের ৩০ আগস্ট যশোরের দৈনিক রানার সম্পাদক সাইফুল আলম মুকুল খুন হন।
২০০০ সালের ১৬ জুলাই দৈনিক জনকণ্ঠের যশোর প্রতিনিধি শামছুর রহমান কেবল তার কার্যালয়ে সন্ত্রাসীদের হাতে খুন হন।
২০০১ থেকে ২০০৬ সাল :
২০০৪ সালের ১৫ জানুয়ারি খুলনা প্রেসক্লাবের সামনে সন্ত্রাসীদের বোমা হামলায় নিহত হন দৈনিক সংবাদের খুলনা ব্যুরো প্রধান ও প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি মানিক সাহা।
২০০৪ সালের ২ মার্চ কেরানীগঞ্জে দি নিউএজের সাংবাদিক আবদুল লতিফ পাপ্পু নিহত হন।
২০০৪ সালের ২৭ জুন নিজের অফিসে নিহত হন খুলনার দৈনিক জন্মভূমির সম্পাদক হুমায়ূন কবির বালু।
২০০৪ সালের অক্টোবর মাসে বগুড়া থেকে প্রকাশিত দৈনিক দুর্জয় বাংলার নির্বাহী সম্পাদক দীপাংকর চক্রবর্তী নিজ বাসায় নিহত হন।
২০০৪ সালে খুন হন দৈনিক সংগ্রামের খুলনা প্রতিনিধি বেলাল হোসেন।
২০০৫ সালের ২৯ মে কুমিল্লার দৈনিক মুক্তকণ্ঠের রিপোর্টার গোলাম মাহমুদ নিহত হন।
ঠিকাদারী চক্রের বিরুদ্ধে লাগাতার রিপোর্ট করে ২০০৫ সালের ৫ নভেম্বর দৈনিক সমকালের ফরিদপুর ব্যুরো প্রতিনিধি গৌতম দাস খুন হন।
২০০৯ থেকে ২০১২ সাল :
২০০৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ঢাকায় খুন হন এনটিভির ভিডিও এডিটর আতিকুল ইসলাম আতিক।
২০০৯ সালের জুলাই মাসে ঢাকার পাক্ষিক মুক্তমনের স্টাফ রিপোর্টার নূরুল ইসলাম ওরফে রানা খুন হন।
২০০৯ সালের আগস্ট মাসে গাজীপুরে সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক সময়-এর নির্বাহী সম্পাদক এমএম আহসান হাবিব বারি খুন হন।
২০০৯ সালের ডিসেম্বরে রূপগঞ্জে দৈনিক ইনকিলাব পত্রিকার সংবাদদাতা ও রূপগঞ্জ প্রেসক্লাবের সহ-সভাপতি আবুল হাসান আসিফ খুন হন।
২০১০ সালের ২৮ এপ্রিল খুন হন বিশিষ্ট সাংবাদিক সাপ্তাহিক ২০০০-এর সিলেট প্রতিনিধি ফতেহ ওসমানী।
২০১০ সালের ৯ মে গুপ্তহত্যার শিকার হন বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল এটিএন বাংলার সিনিয়র ক্যামেরাম্যান শফিকুল ইসলাম টুটুল।
২০১০ সালের ২৩ ডিসেম্বর প্রকাশ্যে খুন হন বরিশালের মূলাদী প্রেসক্লাবের সভাপতি মনির হোসেন রাঢ়ী।
২০১১ সালের ২৮ জানুয়ারি পল্টনে নিজ বাসায় খুন হন প্রবীণ সাংবাদিক দৈনিক জনতার সহ-সম্পাদক ফরহাদ খাঁ ও তার স্ত্রী রহিমা খাতুন।
২০১১ সালের ৭ এপ্রিল চট্টগ্রামের পোর্টকলোনি এলাকায় দৈনিক আজকের প্রত্যাশা, সাপ্তাহিক সংবাদচিত্র ও আজকের সূর্যোদয় পত্রিকার সাংবাদিক মাহবুব টুটুলকে হত্যা করা হয়।
২০১১ সালে একইদিন উত্তরার ৪ নম্বর সেক্টরের ১১ নম্বর সড়কের ১০ নম্বর বাসার বাসিন্দা সাপ্তাহিক বজ্রকণ্ঠের সাংবাদিক আলতাফ হোসেনের লাশ উদ্ধার করা হয়।
২০১১ সালের ৭ ডিসেম্বর গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ কুকরাইল এলাকায় গলা কেটে হত্যা করা হয় দৈনিক ভোরের ডাকের গোবিন্দগঞ্জ জেলা প্রতিনিধি ফরিদুল ইসলাম রঞ্জুকে।
২০১২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি নিজ বাসায় খুন হলেন এটিএন বাংলার সিনিয়র রিপোর্টার মেহেরুন রুনি ও মাছরাঙা টেলিভিশনের বার্তা সম্পাদক সাগর সরওয়ার।
এছাড়া আরো অনেক সাংবাদিক নিখোঁজ হয়েছেন। সাংবাদিকরা এর বিচার আজও পায়নি। কিন্তু কতদিন আমাদের সাংবাদিক ভাইরা জীবন দিয়ে যাবেন?
সাংবদিকরা প্রতিদিন সাধারণ মানুষের পক্ষে কথা বলেন। তাদেরই যদি এমন অবস্থা হয়- তাহলে সাধারণ মানুষের কি হবে? গত এক দশকে কেন আমাদের সরকার সাংবাদিক হত্যার বিচার করতে পারেনি এর জবাব রাষ্ট্রকে একদিন দিতেই হবে।
সাংবাদিক যখন খুন হয় তখন তাৎক্ষণিকভাবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বা ক্ষমতাসীন সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে- খুনি যত শক্তিশালী হোক না তাদের গ্রেফতার করা হবে।
অথচ ২০০০ সালে ১৬ জুলাই শামসুর রহমান খুন হন। পরেরদিন ১৭ জুলাই তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম যশোর টাউন হলে এক সমাবেশে বলেন, আমি জানি কারা সাংবাদিক শামছুর রহমানকে হত্যা করেছে।
যারা আত্মসমর্পণকে মেনে নিতে পারেনি। যারা দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে শান্তি চায়নি। তারাই শামসুর রহমানকে হত্যা করেছে। সাত হাত মাটির নিচ থেকে বের করে তাদের বিচার করবো।
কিন্তু আজ পর্যন্ত সাংবাদিক শামসুর রহমানের বিচার করতে পারেনি কোনো সরকার। আমাদের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যাডভোকেট সাহারা খাতুন এবার সাগর ও রুনির লাশ দেখতে গিয়ে বলেন, ৪৮ ঘন্টার মধ্যে খুনিদের বের করে আনা হবে।
সাগর ও রুনি হত্যার ১২ দিন অতিবাহিত হচ্ছে। কাউকে হাজির করতে পারেনি আমাদের গোয়েন্দারা। পাঠকদের ওপর ভার ছেড়ে দিলাম- আপনারাই বলুন যদি সরকার আন্তরিক না হয় তাহলে খুনিদের বিচার করা সম্ভব? আর সাংবাদিক হত্যা হলে বিরোধীদল তাদের স্বভাবসুলভভাবে বলে থাকেন এটা সরকারের তীব্র ব্যর্থতা।
কিন্তু তাদের আমলে যে সাংবাদিক হত্যা হয়েছিলো এবং তার বিচার পর্যন্ত তারা করেনি তা তারা চিন্তা করে না। যারা যখন ক্ষমতায় থাকে তখন তারা সাংবাদিকদের কোনো পাত্তা দেয় না।
আর বিরোধী দলে গেলে সাংবাদিকদের জন্য মায়াকান্না শুরু করেন। এই মায়াকান্না বন্ধ করতে হবে। শাসকগোষ্ঠীর উদ্দেশ্য বলতে চাই- সাংবাদিক সমাজ এক হচ্ছেন। সাগর-রুনিসহ সব সাংবাদিক হত্যার বিচার করতে হবে।
সাংবাদিক নেতাদের বিভক্তির কারণে সবাই এখন বলাবলি করছেন তাদের অবহেলায় হত্যাকাণ্ডে আমরা এক হয়ে তীব্র প্রতিবাদ গড়ে তুলতে পারছি না। কিন্তু আমার কথা হলো- সাংবাদিক নেতারা কাদের সঙ্গে বিভক্তি করছেন?
তারা তো একজন সাংবাদিকদের সঙ্গেই রেষারেষি করছেন? কিন্তু কেনো? এমন অবস্থা এখনি পরিহার করতে হবে। তা না হলে এই হত্যার বিচার করার জন্য আমরা সাংবাদিকরা তীব্র আন্দোলন গড়ে তুলতে পারবো না। তাই সাংবাদিক নেতাদের বিভক্তি এখনি পরিহার করতে হবে। তাদের এক হবার এখনি সময়।
লেখক : সাংবাদিক
বাংলাদেশ সময় : ১৭৫৫ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২২, ২০১২