সাগরের এক ভাগ্নে দিগন্ত আমার ফেসবুক ফ্রেন্ড। তার নাম্বারটা কাছে ছিল।
এরপর সাহস করে সাগরের মা তথা আমাদের প্রিয় সালেহা খালাকে ফোন করে পরিচয় দিতেই বিলাপ কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। কিংকর্তব্যবিমূঢ় আমি। আমাকে বলছিলেন, আমার অনেক কষ্ট, শারীরিক অনেক সমস্যা, কিন্তু সাগর চিন্তা করবে কষ্ট পাবে মনে করে কখনো এসব তাকে বলতামনা। আমার এসব কষ্ট বলার আর লুকানোরও কেউ রইলোনা।
সালেহা খালা শুধু কাঁদেন আর বলেন, ওরা এখন আমার যাদুমনি মেঘকে পাগল করে ফেলবে। ওই ছোট্ট বাচ্চাটির সঙ্গে জিজ্ঞাসাবাদের নামে পুলিশ কথা বলে, সাংবাদিকরা কথা বলে, এই ছোট্ট বাচ্চাটি কী বোঝে, আজ তার মামা, রুনি’র ভাই ফোন করে বললো মেঘকে আর সামলানো যাচছেনা। সে শুধু বাবা-মা’র কাছে যেতে চাইছে। ওকে আমরা কি করে তার বাবা-মা’কে এনে দেবো, এ কথা বলে আবার হাউমাউ কাঁদেন সালেহা খালা। আমাকে বলেন, ‘পুলিশ কেন কিছু বের করতে পারেনা, আমি আল্লাহ’র কাছে আমার বিচার দিয়ে দিয়ছি’। আমি আর তার সঙ্গে কথা লম্বা করার সাহস করিনা। শরীরের দিকে খেয়াল রাখার, ঠিকমতো ওষুধ খাবার, খুব তাড়াতাড়ি আবার কথা বলবো বলে ফোন রেখে দেই।
এখন প্রতিদিন সকালের প্রথম কাজ হলো দেশের নানা পত্রিকায় ছাপা সাগর-রুনি হত্যা মামলার তদন্ত বিষয়ক রিপোর্টগুলা পড়া। বাংলানিউজসহ অনলাইন পোর্টালগুলোতেও চোখ থাকে সারাদিন। এসব পড়ে পড়ে মাথাটা খারাপও হয়। মনের ভিতর ভয়ও তৈরি হয়। তদন্ত কী তাহলে ব্যক্তিগত সম্পর্কের রেষারেষির দিকে গড়াচ্ছে? এক পত্রিকায় ছাপা হয়েছে রুনি একজনকে কী এসএমএস লিখে পাঠিয়েছে তার বিবরনী পর্যন্ত! এসব যাচাই-বাছাই’র সুযোগ কোথায়? যার নামে এসব লিখা হচ্ছে এর সত্যমিথ্যা কে বলবে? রুনি’কেতো খুন করা হয়েছে। সে কিছু বলার উর্ধে। তদন্ত কর্মকর্তা পুলিশ বলেছেন? তার নামটা কোথায়? যার কাছে সত্যমিথ্যা জানা যেত। তারেক নামের একজনের কথা এসেছে রিপোর্টে। রুনি’র বন্ধুদের একজন। খুন হবার রাতেও রুনি’র সঙ্গে তার কথা হয়েছে। আমাদের প্রত্যেকেরইতো এমন ব্যক্তিগত বন্ধুবান্ধব থাকে। রুনি মেয়ে বলে কী তার সাবেক ক্লাসমেট কারও সঙ্গে বন্ধুত্ব থাকায় তা আমাদের কারও কারও কাছে তা ভালো মনে হচ্ছেনা!
রুনি’র মোবাইলের কললিস্টে সেই তারেকের নাম্বারটি থাকায় শিশু মেঘ সেই সকালে ফোন চাপতেই সেটিতেই কল গেছে। মেঘ ঘটনা প্রথম বলেছে তারেককে। তারেক ফোন করে বলেছেন রুনি’র মা’কে। এখন রুনি’র মা প্রথম বলেছেন মেঘের কাছে ফোন পেয়ে এসেছেন, এখন বলছেন প্রথম ফোন করেছেন তারেক, এসব বৈসাদৃশ্যের বিষয় বলা হচ্ছে। রুনি’র মায়ের সঙ্গে আমার জানাশোনা নেই। ঘনিষ্ঠ একজনকে তিনি স্বীকার করে বলেছেন, ওই পরিস্থিতিতে কখন কাকে কী বলেছি, মাথা ঠিক ছিল নাকি। মায়ের সামনে মেয়ে, মেয়ে-জামাই’র কাটা রক্তাক্ত মৃত শরীর। কী করে তার কাছে আমরা স্বাভাবিক বৃত্তান্ত আশা করি? তারেক জড়িত থাকলে কী রুনি’র মা’কে ফোন করে খবর দেন?
‘প্রিয় টুনটুনি ক্ষমা করিস’ শিরোনামে প্রিয় অশোক চৌধুরীর লেখাটি আবার মনে পড়ে। মিডিয়ার মেয়ে রুনি আবার খুন হলেন একশ্রেনীর মিডিয়ায় হাতে! এই হত্যা রহস্য সুরাহার ব্যর্থতার প্রতিবাদে বিভক্ত সাংবাদিক সংগঠনগুলো এক হয়ে প্রতিবাদ করেছে। দু’দিনের কর্মসূচি দিয়েছে। কিন্তু হত্যা মামলার রিপোর্টের নামে কোন কোন মিডিয়ায় যা হচ্ছে তা কি সেই সমাবেশের কারও বক্তৃতায় এসেছে? জানা গেলোনা।
সাগরের মা সালেহা খালা কাঁদতে কাঁদতে একটাই কথা জানতে চাইছিলেন পুলিশ এতদিনেও ঘটনার কুলকিনারা করতে পারেনা কেন? এ প্রশ্ন শুধু একমাত্র অবলম্বন সেই ছেলেহারানো মায়ের না। সারাদেশের মানুষের। সাংবাদিক সমাজের। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশেষ সহকারি(মিডিয়া) শাকিল এক মিডিয়াকে বলেছেন, রুনি’কে ব্যক্তিগতভাবে জানতেন স্নেহ করতেন প্রধানমন্ত্রী। কারণ বিরোধীদলে থাকতে আওয়ামী লীগের নানা কর্মসূচির রিপোর্ট যত্মের সঙ্গে করতেন রুনি। সে কারনে এই হত্যার ঘটনার সত্য উদঘাটিত হোক, খুনিরা ধরা পড়ুক, শেখ হাসিনা তা ব্যক্তিগতভাবেও চান।
কিন্তু পুলিশ কিছুরই কূলকিনারা কেন করতে পারছেনা? এ প্রশ্নটি নিয়ে ঢাকায় অনেকের কাছে ফোন করে জানতে চেয়েছি উত্তর। ডিবি’র ঢাকা উত্তর, দক্ষিণ মিলিয়ে প্রায় দেড় হাজার সদস্য জনবল। ডিবি তার পুরো শক্তি নিয়ে এখন এই মামলার তদন্ত নিয়েই কাজ করছে। এখন আর কিছু করছেনা ডিবি। র্যাবের গোয়েন্দা ইউনিট কাজ করছে। কিন্তু কোন কুলকিনারা করতে পারছেনা কেন? উত্তরে বলা হয়েছে, হয়তো অতিরিক্ত সতর্কতা। পুলিশ যখন কিছু করতে পারেনা, দু’একজন ধরে পিটিয়ে ১৬৪ ধারা করিয়ে একটা গল্প বলে দেয়। কিন্তু এ ঘটনাটি মিডিয়ার আর স্পর্শকাতর হওয়াতে সেদিকে যাবার চেষ্টা করেনি। কিছু না পাওয়া গেলে সহজ নারী বিষয়ক কিছু জড়িয়ে বলারও চেষ্টা করে। এ ঘটনায় তেমন চেষ্টাও হয়েছিল। কিন্তু দুয়ে দুয়ে চার মেলাতে পারেনি। কারও সঙ্গে রুনি’র বন্ধুত্ব বা সম্পর্ক থাকলে তারা তাকে খুন করবে কেন? খুনের অকুস্থলে মিডিয়াসহ হাজার মানুষের ভিড়ে সম্ভাব্য সব আলামত নষ্ট হয়ে যাওয়ায় এই মামলার খুনি কোর্টে প্রমাণ করাও দুরুহ হয়ে পড়েছে?
এ লেখাটা শেষ করতে করতে সিলেটের আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের সমাবেশে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বক্তৃতা পড়ার সুযোগ হয়। সাগর-রুনি হত্যার ঘটনা মিয়ে সাংবাদিক আন্দোলনে প্রধানমন্ত্রী ক্ষিপ্ত হয়েছেন মনে হলো। অনেক কথা বলেছেন। শামছুর রহমানের খুনিদের বিচারেও সাংবাদিকরা এভাবে আন্দোলন করেনি, জনকন্ঠ পত্রিকাটি বিএনপি-জামায়াত আমলে পিষে মারার ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে সাংবাদিক সমাজ রুখে দাঁড়ায়নি, আমারদেশের মাহমুদুর রহমানকে গ্রেফতারের বিরুদ্ধে যে প্রতিবাদ হয়েছে, এর বিন্দুমাত্রও হয়নি জনকন্ঠ সম্পাদক আতিকউল্লাহ খান মাসুদের গ্রেফতারের প্রতিবাদে, এর সবই ঠিক আছে।
কিন্তু প্রধানমন্ত্রী কী বলবেন, তার আমলেও সেই সাংবাদিক হত্যামালাগুলোর বিচার ঝুলে আছে কেন? কারও ‘বেডরুম পাহারা দেওয়া সম্ভব নয়’ প্রধানমন্ত্রীর এ ধরনের বক্তব্যকে খুবই অমানবিক মনে হয়েছে! দেশের কোথায় এখন নিরাপদ? কিন্তু কেউ কি কারও বেডরুম পাহারা দিতে বলেছে? সরকারি আর প্রভাবশালীরা নিরাপত্তা ঘেরাটোপের মধ্যে থাকেন। কাজেই দেশের মানুষের প্রকৃত অবস্থা কী তাদের পক্ষে জানা সম্ভব? দেশের মানুষ এমন বেহেস্তে থাকলে তারা কেন এভাব থাকেন না? তবে কী আগামিতে কেউ বেডরুমে খুন হলে আমরা আর সে হত্যাকাণ্ডের বিচার চাইবোনা? পুলিশের ব্যর্থতার এসব দায়দায়িত্বের ভার তিনি কেন ঘাড়ে তুলে নিলেন? ৪৮ ঘন্টার আল্টিমেটাম দিয়ে এ মামলাকে যে মন্ত্রী এই অবস্থায় এনেছেন তাকে কী বরখাস্ত করা হয়েছে? পুলিশ এই হত্যা মামলার সুরাহা করতে পারলে কী কারও আন্দোলন করা লাগে?
এতদিন সবাই এই হত্যামামলা তদন্ত ব্যর্থতার জন্য পুলিশ ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বিরুদ্ধে বলেছে। এখন বলবে প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে! এখন কী প্রধানমন্ত্রীর এমন একটি বক্তব্য পেয়ে আরও বেয়াড়া-দিকহারা হয়ে যাবে সাগর-রুনি হত্যামামলার তদন্ত? এ কথার রেষও হয়তো অনেকদূর যাবে। আর সাংবাদিক নেতাদের অনেককেতো চিনি। তাদেরকে আর এ আন্দোলনের আশেপাশে পাওয়া যাবে কী?
ফজলুল বারীঃ সিডনি প্রবাসী সাংবাদিক
বাংলাদেশ সময় ১৮৩৬ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২৩, ২০১২