‘নিহত সাংবাদিক রুনিকে ব্যক্তিগতভাবে পছন্দ করতেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। কারণ বিরোধীদলে থাকতে আওয়ামী লীগের নানা কর্মসূচির রিপোর্ট খুব যত্ন সহকারে করতেন রুনি।
যারা রাজনীতিক, দেশকে নেতৃ্ত্ব দেন তাদের প্রতিটি বক্তব্য দেশের মানুষ মনোযোগ দিয়ে শোনে, মানুষের মনে রেখাপাত করে তাদের বক্তব্য, প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্য দেশের মানুষের মানস চেতনায় কি সজোরে আঘাত করেছে, ধাক্কা দিয়েছে, তা কি জানার-বোঝার কোনো অবস্থা-ব্যবস্থা ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের আছে? না মানুষ কি ভাবলো না ভাবলো তা তারা আজকাল থোড়াই কেয়ার করেন? ‘আল্লাহ’র মাল আল্লাহ নিয়া গেছেন’ জাতীয় বক্তব্যের সঙ্গে ‘বেডরুম পাহারা’ জাতীয় বক্তব্যের কোনো পার্থক্য থাকলো কি?
প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের পর রোকেয়া প্রাচী আর জাকিয়া আহমেদের দু’টি লেখা প্রকাশ হয়েছে বাংলানিউজে। মন ছুঁয়ে যাওয়া অনেক কথা লেখা দু’টিতে আছে। সাধারণত প্রিয়জন, যাদের কাছে মানুষ কিছু চায়, আশা করে, তার বা তাদের উদ্দেশেই এমন লেখা যায়। জাতির পিতার মেয়ে শেখ হাসিনাতো শুধু প্রিয়জনই না। দেশের নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী। দেশের দণ্ডমুণ্ডের কর্ত্রী। তার কাছে আশা করতে গিয়ে যদি উল্টো তীর্যক কথার গুতুনি খেতে হয়, মানুষ তার কাছে আর কিছু চাইবে না, আশা করবে না। দু’বারতো তিনি প্রধানমন্ত্রী হয়ে গেছেন। তিনি আর যদি দেশের প্রধানমন্ত্রী হতে না চান, তাহলেতো মানুষ আর জোরাজুরি করে বলবে না- আপা প্লিজ, আপা প্লিজ!
মানুষকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে যেভাবে কথা বলা শুরু হযেছে, তাতেতো মনে হচ্ছে তিনি এখন খুব ক্লান্ত। আর দেশের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে আসতে চাইছেন না। যেখানে খালেদা জিয়া এখন প্রায় অতীতের ভুল-ক্রটির জন্য মার্জনা চাইছেন, সেখানে শেখ হাসিনা এবং আওয়ামী লীগের গুরুত্বপূর্ণদের বক্তব্যে কেমন যেন একটি বেপরোয়া-ড্যামকেয়ার ভাব! এ দলের সভানেত্রী দেশের সাম্প্রতিক সবচেয়ে স্পর্শকাতর খুনের ঘটনা সম্পর্কে বলেন, কারও বেডরুম পাহারা দেয়া সম্ভব নয়। দলটির সাধারণ সম্পাদক বলেন, ‘অ্যাক্সিডেন্ট ইজ অ্যাক্সিডেন্ট, সড়ক দুর্ঘটনায় কারও মৃত্যু হলে প্রতিবাদ করার কিছু নেই’ অথবা ‘সীমান্তে হত্যার ঘটনা নিয়ে রাষ্ট্র চিন্তিত নয়’। সরকারিদলের নানাকাজে ত্যক্ত-বিরক্ত চৌদ্দদলের তেরদলও সম্প্রতি এসব নিয়ে আলাদা বৈঠক করেছে।
দুনিয়ার কোথাও কোনো সরকার কারও বেডরুম পাহারা দেয় না। দেশটাকে নিরাপদ করে। যাদের ট্যাক্সের টাকায় দেশ চলে, ভোটে সরকার গঠন হয় তাদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা সরকারের দায়িত্ব। এটা কোনো দয়া-দাক্ষিণ্যের বিষয় না। দায়িত্ব পালনে অপারগতা জানালে বা ব্যর্থ হলে জনতা তাকে ক্ষমতা থেকে বিদায় করে, অথবা চলে যেতে হয়। আবার বেডরুমে নিরাপত্তা ঘেরাটোপের মধ্যেও প্রধানমন্ত্রীর মা এবং পরিবারের অনেক সদস্যের করুণ মৃত্যু হয়েছে। কাজেই এমন স্বজন হারানোর বেদনা যার মাঝে, স্বজন হারানো অন্যরা কোন বক্তব্যে আঘাত-কষ্ট পাবে, এটাতো তার বেশি জানার কথা। দেশের দায়িত্বশীল মানুষের মুখে এমন বক্তব্যের পর নানান প্রতিক্রিয়া শুরু হয়েছে। একেকজন তালিকা করছেন কার জীবন কোথায় নিরাপদ। কোথায় থাকলে সরকার নিরাপত্তা দেবে। বেডরুমে দেবে না ড্রইং তথা লিভিংরুমে দেবে কিনা, এমন ক্রোধের বক্তব্যও এসেছে।
সাধারণত কোনো একটি দলের নিচের পর্যায়ে উল্টাপাল্টা বক্তব্য হলে শীর্ষ পর্যায়ের কাছে এর প্রতিবিধান চাওয়া যায়। শীর্ষ পর্যায়ে যদি তা ঘটে তাতে প্রতিবিধান চাইবার জায়গা থাকে না বলে মানুষ তা ক্ষোভে মনে মনে পোষে। নির্বাচনের দিন এর প্রকাশ ঘটে ব্যালট বাক্সে। আর্থাইটিসের কষ্টে থাকা খালেদা জিয়া কিছুদিন আগে সরকারকে ‘ল্যাংড়া লুলা করে দেবার’ কথা বলে সমালোচিত। ‘বেডরুম’ বক্তৃতার মাধ্যমে যেন নিজেকে তার সমতলে নিয়ে গেলেন শেখ হাসিনা!
ঢাকা শহরে এখন ডিবি’র দেড় হাজারের বেশি লোকবল আছে। ওয়াকিফহালরা জানেন গত দু’সপ্তাহ ধরে ডিবি সাগর-রুনি হত্যা মামলা ছাড়া আর কোনো কাজ করছে না। ৠাবের গোয়েন্দা ইউনিটও একই কাজে ব্যস্ত। এক মামলা নিয়ে যদি এত লোকবলকে পেরেশান-নিয়োজিত থাকতে হয়, তাহলে দেশের বাকি মানুষের মানুষের নিরাপত্তার কি অবস্থা তা বোধগম্য। এখানে পুলিশ অকুস্থলে গিয়ে মিডিয়া ইন্টারভ্যু অথবা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নিরাপত্তা নিয়ে ব্যস্ত থাকে। আলামতের সুরক্ষা নিয়ে ভাবে না কাজ করে না। এখন এই ঘটনার খুনিদের ধরলেও আলামতের অভাবে প্রসিকিউশন তা প্রমাণ করবে কি করে? পুলিশ আর তদন্ত সংস্থার লোকজনের এসব অ্যাফিসিয়েন্সির সমস্যা নিয়ে সরকারের কোনো মাথাব্যথা নেই, সরকার আছে তাদের তোষামোদি আর ভোটার জনগণকে শাসানিতে! তা আগামীতে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় আনবে পাবলিক না পুলিশ-ৠাব? লিমনের কাটা পা নিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীসহ সরকারের লোকজন যত উল্টাপাল্টা-নিষ্ঠুর কথা বলেছেন, নির্বাচনের সময় কিন্তু এসব প্রতিপক্ষের পোস্টারের ভাষা হবে। সেখানে জায়গা হয়ে যেতে পারে প্রধানমন্ত্রীর বেডরুম বক্তৃতাটিও। পুলিশ-ৠাব ইত্যাদি কিন্তু হাওয়ার সঙ্গে পাল্টাবে। দৌড়াবে নতুন হাওয়ার টানে।
আরেকটি বিষয় লক্ষ্যনীয়। আন্দোলনের ভিতর বড় হয়েছেন মুজিবকন্যা শেখ হাসিনা। ১৯৮১ সালে দেশে আসার পর থেকে আন্দোলনের মাধ্যমে গড়ে উঠেছেন। তিনি খালেদা জিয়ার আন্দোলন সহ্য করতে পারেন। কিন্তু নিজের মানুষের আন্দোলন সহ্য করতে পারেন না! সড়ক দুর্ঘটনায় তারেক-মিশুকের মৃত্যুর পর শহীদ মিনারে নাগরিকদের ঈদ কর্মসূচিতে ক্ষিপ্ত হয়ে তিনি সেলিনা হোসেনসহ অনেদের ট্যাক্স প্রোফাইল তদন্তের হুমকি দিয়েছিলেন। যাদের তিনি হুমকিটা দেন গত নির্বাচনে তাদের কিন্তু আওয়ামী লীগের চেয়ে ভালো কোনো বিকল্প ছিল না। তাই ভোটটা তারা সম্ভবত সবাই আওয়ামী লীগকেই দিয়েছিলেন। অতএব শেখ হাসিনার হুমকিতে তাদের মনে দাগ কাটা স্বাভাবিক। সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ড নিয়ে সাংবাদিক সমাজের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনে আওয়ামী ধারার সাংবাদিকরাও সামিল হওয়ায়, প্রেসক্লাবের সামনের সমাবেশে ইকবাল সোবহান চৌধুরী সভাপতিত্ব করাতে, এবিএম মুসা হাসপাতাল থেকে টেলিফোনে বক্তৃতা দেয়াতেই বুঝি তিনি ক্ষেপেছেন বেশি? এর কারণেই কি শেখ হাসিনার বক্তব্যটির পর আর সেই সাংবাদিক নেতৃবৃন্দ অথবা সংগঠনগুলোর কোনো প্রতিক্রিয়া নেই? দলীয় সাংবাদিকতা যারা করবেন, তাদেরও বুঝি এসব ঘটনা থেকে শেখার আছে। নইলে ইকবাল সোবহান চৌধুরী আর ফেনীর নমিনেশন পাবেন না। আব্দুর রাজ্জাক ইস্যু আর সংসদের বক্তৃতার পর যে কারণে মন্ত্রিত্ব বঞ্চিত তোফায়েল আহমদ! একবার ক্ষমতায় চলে যেতে পারলে সবার এমন শুধু তোষামোদকারী রাম-শ্যাম-যদু-মধু পছন্দ!
ফজলুল বারী : সিডনি প্রবাসী সাংবাদিক
বাংলাদেশ সময় : ১৩২১ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২৫, ২০১২