ঢাকা, সোমবার, ৮ পৌষ ১৪৩১, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

মুক্তমত

আজও আদালতের হৃদয় স্পর্শ করেনি সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ড!

অশোক চৌধুরী, হেড অব নিউজ, বৈশাখী টেলিভিশন | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬৫৮ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২৫, ২০১২
আজও আদালতের হৃদয় স্পর্শ করেনি সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ড!

আর্থিক, রাজনৈতিক, সামাজিক ও ধর্মীয় ক্ষমতাধরদের অবাধ বিচরণস্থল এই দেশে অরাষ্ট্রীয় গণমাধ্যমের পাশাপাশি রাষ্ট্রের উচ্চ আদালতই বিভিন্ন সময়ে সাধারণ মানুষের নির্ভরতার প্রতীক হয়ে উঠেছে। দলীয়করণ, বাণিজ্যিকীকরণের পরও মানুষ এখনও বিশ্বাস করে উচ্চ আদালতেই কিছুটা বিচার মিলবে।

বিশেষ করে বিগত কয়েক বছরে অসহায়, নির্যাতীত মানুষের পাশে আদালত স্বপ্রণোদিত হয়ে দাঁড়িয়ে যেমন আলোড়ন তৈরি করেছে, তেমনি মানুষের এই আস্থাও অর্জন করেছে।

বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষ কাছ থেকে আদালতের প্রতি জানানো হয়েছে কৃতজ্ঞতা। আদালতের এই ভূমিকার সমালোচনাও রয়েছে। তারপরও এখনো দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ঘটে যাওয়া সব আলোচিত ঘটনা কোনো না কোনোভাবে আসছে আদালতের দ্বারে। তবে সাগর সরওয়ার ও মেহেরুন রুনি হত্যাকাণ্ড এখনো এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম রয়ে গেলো।

আজও আদালতের হৃদয় স্পর্শ করতে পারেনি এ সময়ের সবচেয়ে বেদনাদায়ক ও চাঞ্চল্যকর হত্যাকাণ্ডটি। সারাদেশের মানুষ প্রতিবাদে সোচ্চার, দেশের চৌকস গোয়েন্দারা ঘটনার দু’ সপ্তাহ পরেও কেন হত্যাকারীদের সন্ধান পেলো না, তা জানতে চাইলো না আদালত। উচ্চ আদালতের মানবাধিকার আইনজীবীরাও নীরব। অথচ আদালতের অনেক স্বপ্রণোদিত আদেশ ও মানবাধিকার আইনজীবীদের আনা জনগুরুত্বসম্পন্ন বিষয়ের ওপর রিটের খবর মেহেরুন রুনির কণ্ঠে প্রচার হয়েছে টেলিভিশনে। সাগর সরওয়ারের লেখনিতে পত্রিকার পাতায় ছাপা হয়েছে যত্ন সহকারে।

এ রকমও আমরা দেখি, পত্রিকার ভেতরের পৃষ্ঠার শেষ দিকের কোনো কলামে ছাপা হওয়া ছোট একটি খবর আদালতের দৃষ্টিতে আসার পর তা বড় খবরে পরিণত হয়েছে। খবরে যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়, তাদের আদালতে ডেকে এনে কখনো কৈফিয়ৎ তলব আর কখনোবা শাস্তির আদেশ দেওয়া হয়েছে। এ ধরনের ঘটনায় সাধারণ জনগণের মনেও আশার সঞ্চার হয়। এনিয়ে আমি নিজেও কত রিপোর্ট করেছি। কিন্তু তখন খুবই কষ্ট লাগে, যখন দেখি মানুষের আস্থার আরেক জগত গণমাধ্যমে কাজ করা এক দম্পতি রুনি-সাগরের বিষয়টি নিয়ে আদালত স্বপ্রণোদিত রুল দেয় না বা মানবাধিকার আইনজীবীরা এগিয়ে আসেন না কোনো রিট আবেদন নিয়ে।

অথচ সাংবাদিকরা এই মানবাধিকার আইনজীবীদের কতভাবেইনা  সহযোগিতা করেছে। আমার বন্ধুদের মধ্যে অনেক সময় প্রতিযোগিতাও আমরা দেখেছি। কে কত বেশি জনস্বার্থ মামলা আদালতের দৃষ্টিগোচরে আনতে পারবেন তা নিয়ে। সাংবাদিকদের কাছে (বিশেষ করে প্রিন্ট মিডিয়া) অনুরোধ করতো, আপনাদের পত্রিকায় এধরনের কোনো ঘটনা ছাপা হলে প্রথম আমাকে জানাবেন। তাদেরকে উদ্দেশ্যে করে শুধু বলতে চাই সাগর-রুনি হত্যাকারীদের গ্রেফতারের আবেদন আর কতবার পত্রিকায় ছাপালে আপনাদের নজরে আসবে।

রুনি-সাগর হত্যাকাণ্ডের একদিন পরে অর্থাৎ ১১ ফেব্রুয়ারি রাতে বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদের নাতিকে পুলিশের পেটানোর খবর পত্রিকায় প্রকাশিত হওয়ার পর আদালতকে সোচ্চার হতে দেখেছি। স্বপ্রণোদিত হয়ে রুল জারি করে ডেকে পাঠানো হয় পুলিশ কর্মকর্তাদের। পরে আদালত পুলিশের তদন্ত কমিটির প্রতি আস্থা রাখতে না পেরে মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যানকে প্রধান করে নতুন তদন্ত কমিটির পাশাপাশি পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করে। এর আরো ৫দিন পর গত ১৭ ফেব্রুয়ারি নওগাঁর রাণীনগর এলাকায় এক গৃহবধূ ও তার স্বামীর বন্ধুকে ১০১ দোররা মারার খবর ৫দিন পর পত্রিকায় দেখে আদালত স্বপ্রণোদিত হয়ে রুল জারি করে সংশ্লিষ্ট থানার ওসিসহ সালিসে অংশ নেয়া লোকদের আদালতে হাজির হওয়ার নির্দেশ দেন। অথচ এতবড় এক চাঞ্চল্যকর হত্যা মামলায় আদালতের কোনো উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা দেখিনা। এখানেই প্রশ্ন জাগে আদালত কি সাংবাদিকদের অপছন্দ করেন অথবা সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের ঘটনাটা আদালতের দৃষ্টিগোচর হওয়ার মত নয়?

আমার এই লেখা পড়তে গিয়ে কারো মনে প্রশ্ন জাগতে পারে, যে মামলা তদন্তাধীন, সে ব্যাপারে আদালত কি নির্দেশনা দেবেন? সেটি কতখানি উচিত? এখানেই মূলতঃ আমার বক্তব্য। র‌্যাবের হাতে পঙ্গু লিমনের কাহিনী নিশ্চয়ই আমরা ভুলে যাইনি। ভুলে যাইনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পুলিশের হাতে নির্যাতিত ছাত্র আবদুল কাদেরের কথা। এই দু’টি ক্ষেত্রেই আদালতের নির্দেশে সঠিক তদন্ত করে প্রকৃত দোষীদের চিহ্নিত করা গেছে। আদালত স্বপ্রণোদিত হয়ে হস্তক্ষেপ না করলে কোনো দিনই লিমন ও কাদের সঠিক বিচার পেতো না। জাতি আসল ঘটনা জানতে পারতোনা। আদালত থেকে পাওয়া এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ২০১১ সালে সুপ্রিমকোর্টের হাইকোর্ট বিভাগে মানবাধিকার আইনজীবীরা জনস্বার্থে ২৬টি মামলা করেছে। অথচ একই সময়ে আদালত স্বপ্রণোদিত হয়ে গ্রহণ করেছে ৪১টি মামলা। আর ২০১২ সালের জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসে মানবাধিকার আইনজীবীদের করা মামলার হিসাব পাওয়া না গেলেও আদালত স্বপ্রণোদিত হয়ে ২২টি মামলা গ্রহণ করেছে। অথচ সাংবাদিকদের এতই দুর্ভাগ্য, আমাদের চরম দুঃসময়ে আমরা কোথাও খুঁজে পাইনা আমাদের সুহৃদদের। মানবাধিকার আইনজীবীরা চলে যান ধরাছোঁয়ার বাইরে। পুলিশ ভাব নেয় অসহায়ত্বের। অনেক ঘটনার মতো আদালতও স্বপ্রণোদিত হয়ে দাঁড়াতে চায় না আমাদের পাশে।

সাগর-রুনির হত্যাকাণ্ডের সব ৪৮ ঘন্টার মধ্যেই প্রকাশের কথা ছিলো। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছিলেন। ঐ স্থানে উপস্থিত গোয়েন্দা কর্মকর্তারা আশা করছিলেন ৪৮ ঘন্টার আগেই ঘটনা বেরিয়ে আসবে। কিন্তু কত ৪৮ ঘন্টা পার হয়ে, দিনের পর দিন পার হয়ে গেলো কিছুই জানা গেলোনা।

সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের পর নানারকম সন্দেহ, জল্পনা-কল্পনা চাউর হয়েছে। এ ঘটনায় প্রভাবশালী মহলের হাত রয়েছে এমন কথাও উঠেছে। এতকিছুর পরে এখনতো অনেকের মনে ওই সন্দেহই জোরদার হয়ে উঠছে, ঘটনাটিতে হয়তো উপরের প্রভাবশালী মহলের কারো হাত আছে, যে কারণে তদন্ত কর্মকর্তারা ঠিকমত কাজ করতে পারছেন না। একের পর এক ক্লু তাদের সামনে থেকে মিলিয়ে যাচ্ছে।

তদন্ত কর্মকর্তাদেরও গাফিলতিও স্পষ্ট। তারা এখন বলছেন, বহু জনসমাগমে আলামত  নষ্ট হয়ে গেছে। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন করতে হয়, আপনারা ঘটনাস্থলে থাকার পরেও কেন বহু জনসমাবেশ হতে দিলেন ক্রাইমসিনে? আপনারা সেখানে কি করছিলেন? ময়না তদন্ত হলেও পুলিশ ভিসেরা রিপোর্ট চায়নি। কেন চায়নি? সব মিলিয়ে বিচিত্র সন্দেহ মানুষের মনকে ভারাক্রান্ত করছে। এখানেই উচ্চ আদালত পারেন একটা নির্দেশনা দিতে। এখানেই উচ্চ আদালত পারেন, সত্য উদঘাটনে পুলিশকে বাধ্য করতে। উচ্চ আদালতই পারেন, ক্ষমতার কাছে ম্রিয়মান মানবতাকে বিজয়ী করতে।

বাংলাদেশ সময় : ১৬৪৮ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২৫, ২০১২

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।