প্রিয় ফারজানা খান গোধুলির ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ’ শিরোনামে একটি লেখা ছাপা হয়েছে বাংলানিউজে। সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি হত্যা মামলার তদন্ত নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাম্প্রতিক একটি অহেতুক, অপ্রত্যাশিত, অমানবিক, বিতর্কিত বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ার তার কষ্ট-ক্ষোভ-আবেগের কথাগুলো লিখেছেন গোধুলি।
ফেসবুকে লেখাটির শেয়ার দেবার পর নানা প্রতিক্রিয়া এসেছে। গোধুলির আবেগকে সম্মান করি। কষ্টকে শেয়ার করি। কিন্তু দেশে না ফেরার সিদ্ধান্তকে সমর্থন করি না। কারণ, দেশটা আমাদের সবার। শুধু হাসিনা-খালেদার না। আজ শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী আছেন। দেশের মানুষ না চাইলে আগামীতে থাকবেন না। আবার তার বদলে খালেদা ক্ষমতায় ফিরলেই দেশে দুধের নহর বয়ে যাবে না। কিন্তু দেশ আমাদের আছে-থাকবে।
হাজারও সমস্যা নিয়ে হলেও পনের কোটির বেশি মানুষ দেশে আছেন। থাকছেন। উপায়ও যে তাদের নেই। শুধু জীবনের নিরাপত্তা না, টাকা দিয়ে নিরাপদ খাবার কিনে খাওয়ার, ওষুধ-পথ্যের নিরাপত্তা পর্যন্ত দেশের অভাগা মানুষজনের নেই। এখানে বিদেশ বিভূঁইয়ে যে কোনো সমস্যায় পড়লে ট্রিপল জিরোতে ফোন করলে সাহায্যের জন্য পুলিশ হন্তদন্ত ছুটে আসে। হার্টের অসুখ শুনলে পারলে হেলিকপ্টারে করে হাসপাতালে উড়িয়ে নিতে চায়। কেউ কোথাও কারও জীবন ঝুঁকির দায়িত্ব নিতে চায় না। দেশে এসবও সাধারণ মানুষের কাছে আকাশ কুসুম কল্পনা! তারপরওতো দেশে যেতে হবে।
বিদেশে আমাদের যাদের বিকল্প উপায় আছে, তাদেরও সারা সময় দেশের জন্য মন পোড়ে বলেই আমরা দেশ নিয়ে ভাবি-লিখি, সবকিছুতে শেয়ার করি। দেশে আমাদের স্বজন-নির্ভরশীলরা আছেন। আমাদের পাঠানো টাকাই দেশের বৈদেশিক মুদ্রার সবচেয়ে বড় অবলম্বন। এক কোটির বেশি পরিবার সরাসরি এসব টাকার ওপরই নির্ভরশীল। বিদেশে বসে একশ’ ভাগ হালাল কামাইয়ের যে টাকা-পয়সা পরিবারকে দিতে পারি, দেশে তা পারতাম না। বাস্তবে তা সম্ভবও না। আবার দেশে বিশেষ ভালো থাকার কপালও সবার হয় না। আল্লাহ সবাইকে সবকিছু দেন না। যেমন, অভাগা আমাদের দেননি দেশভাগ্য।
বিদেশে বসে সারাক্ষণ দেশের নানাকিছুতে শেয়ার করি-লিখি বলে, এসব অনেকে পছন্দও করেন না। এরপরও দেশটাকে ভালোবাসি বলেই ফিল করি। করে যাবো। ‘সতত হে নদ, তুমি পড়ো মোর মনে’ বলতে বলতে একদিন দেশে ফিরে যাবোও। যদিও চোখের সামনের দৃষ্টান্ত হচ্ছে, দেশকে ভালোবেসে দেশে ফেরার মাশুল করুণ মৃত্যুর মাধ্যমে দিয়েছেন সাগর-রুনি। বিদেশের নিরাপদ, আইনানুগ পরিবেশে থেকে এরপর দেশে ফেরা নিয়ে আমাদের সুবিধায় থাকনেওয়ালাদের মধ্যে এক ধরনের ভয়ও ধরেছে। মাসহ স্বজনদের আপত্তিও আছে। যেমন এর আগে ভয় হয়েছে তারেক মাসুদ-মিশুক মুনিরের করুণ মৃত্যুর পর। দেশকে ভালোবেসে কানাডা থেকে দেশে ফিরে গিয়েছিলেন মিশুক মুনীর। সেই মৃত্যুর প্রতিবাদকারীদের বিরুদ্ধেও অমানবিক মন্তব্য করেছেন শেখ হাসিনা ও তার পরিবহন নেতা মন্ত্রী শাহজাহান খান। খণ্ডকালীন দেশে থাকা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক কাম স্থানীয় সরকার মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলামও সবশেষে বলে দিয়েছেন, ‘এক্সিডেন্ট ইজ এক্সিডেন্ট’, এক্সিডেন্টে কারও মৃত্যু হলে প্রতিবাদ করার কিছু নেই।
আসলে প্রধানমন্ত্রী ও এসব মন্ত্রীরা এতো নিরাপত্তার ঘেরাটোপের মধ্যে থাকেন বলেই সাধারণ মানুষজনের নিরাপত্তাজনিত উদ্বেগ তাদের স্পর্শ করে না, বা করতে পারে না! বিদেশ প্রত্যাগতদের বিমানবন্দরে হয়রানি নিয়ে সিডনি আসা এক জাতীয় নেতাকে বললে, তিনি অকপটে বলেন, তাদেরকে লোকজন বরাবর এমন প্রটোকল দিয়ে রিসিভ করেন, বিদায় দেন যে, এসব তারা জানতেও পারেন না। তাদের সন্তানরাও নিরাপত্তা নিয়ে বিদেশে থাকেন। দেশে ফিরলে তাদের নিরাপত্তার বিষয়ে নিরুদ্বেগ রাখার বিষয়েও এখন আইনানুগ ব্যবস্থাও করা আছে। তারা যখন রাস্তা দিয়ে চলেন, আগে-পিছে এমন ব্যবস্থা থাকে, যে দেশের বাস্তব কোনো অবস্থাই তাদের স্পর্শ করতে পারে না।
জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর সন্তান ও তাদের উত্তরসূরিদের নিরাপত্তা আইনকে আমরা সমর্থন করেছি। কিন্তু দেশের মানুষের নিরাপত্তা, আবেগ-অনুভূতিকে কটাক্ষ করে যা খুশি ফ্রি-স্টাইল মন্তব্য করার লাইসেন্স কাউকে দেইনি। সাংবাদিকদের নিরাপত্তাহীনতার উদ্বেগটি অনেক বেশি হবার কারণ, দেশে আজ পর্যন্ত সাংবাদিক হত্যার যতগুলো চাঞ্চল্যকর ঘটনা ঘটেছে, এর একটিরও বিচার হয়নি। শেখ হাসিনার আমলেও কেন বিচারগুলো আটকে আছে, সে প্রশ্নের উত্তরতো তাকেই দিতে হবে। সাগর-রুনির হত্যাকারীদের পিকনিক পার্টিতে দেখার কথা বলেছিল খুনের প্রত্যক্ষদর্শী মেঘ। প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, ‘মেঘের ইন্টারভিউ টিভিতে প্রচার করায় হত্যাকারীরা আড়ালে চলে গেছে। ’ আর পুলিশ এখন বলার চেষ্টা করছে, এটা স্রেফ ডাকাতির ঘটনা! রিপোর্টার্স ইউনিটি অথবা মেঘের স্কুলের পিকনিকেও গিয়েছিল ডাকাতরা!
এবার আমাদের প্রিয় গোধুলিকে নিয়ে একটু লিখি, তাহলে তাকে যারা জানেন না তাদেরও বুঝতে সুবিধা হবে। ওয়াশিংটন ডিসির হোয়াইট হাউস কমপ্লেক্সের বাসিন্দা ফারজানা খান গোধুলি। সেখানে স্বামী-সন্তানকে নিয়ে তার সংসার। এএফপি’র সিনিয়র ফটো জার্নালিস্ট হিসেবে হোয়াইট হাউসে এখন পোস্টিং তার স্বামী, বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্মের অহঙ্কার জুয়েল সামাদের। প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার সঙ্গে এটাস্ট। প্রেসিডেন্টের সঙ্গে নানা জায়গায় ঘুরে বেড়ান। আফগান-ইরাক যুদ্ধসহ দুনিয়ার অনেক গুরুত্বপূর্ণ ইভেন্ট কভার করেছেন জুয়েল। ঢাকায় থাকতে জনকণ্ঠ ও এএফপি’র ঢাকা ব্যুরোতে কাজ করেছেন। গোধুলিও ফটো সাংবাদিক হিসাবে কাজ করেছেন দৈনিক সংবাদ ও এএফপি’র ঢাকা ব্যুরোতে। সর্বশেষ সিএনএন’র সঙ্গে কাজ শুরু করেছিলেন। কিন্তু শিশু সন্তান আইয়ানের জন্য সিএনএন’এর চাকরি ছেড়ে দিয়ে ফ্রি-ল্যান্সার হিসাবে কাজ করছেন।
কতো রকমের প্রতিকূলতা নিয়ে দেশে এই জুয়েল-গোধুলির সৃষ্টি হয়েছিল, তা আমরা ওয়াকিবহালরা জানি। বিশেষ করে পুরুষশাসিত দেশে-মিডিয়া ভুবনে ক্যামেরা হাতে গোধুলির উত্থান-বিকাশটি মোটেই কুসুমাস্তীর্ণ ছিল না। একবার সিলেটে এক প্রোগ্রামে ঢাকা থেকে যাওয়া ফটো সাংবাদিকদের নিয়ে একটি নৈশভোজ-আড্ডার ব্যবস্থা করতে গেলে দেখি, অনেকে গোধুলির ব্যাপারে বাধা দিচ্ছেন! কারণ, জানতে চাইলে বলার চেষ্টা হয়, মেয়েটা বেশি ফার্স্ট! সেই জুয়েল-গোধুলিতো নিজস্ব যোগ্যতাতেই থিতু হয়েছেন বিদেশে। এমন জায়গায় গিয়ে থিতু হয়েছেন, যেখানে এর আগে কোনো বাংলাদেশি পৌঁছতে পারেননি। আমাদের গর্বের নতুন প্রজন্মের নাম জুয়েল-গোধুলি।
সাগর-রুনিও নিজেদের যোগ্যতায় ঢাকার মিডিয়ায় জায়গা করে নেন। মেয়ে হিসাবে রুনির সংগ্রামটি ছিল অনেক বেশি। শুরু থেকে মাঠে-ময়দানে রুনির সুখে-দুঃখের সংগ্রামের শরিক ছিলেন গোধুলি। তাই রুনির এমন করুণ মৃত্যু খুব স্বাভাবিকভাবে গোধুলিকে বিশেষ স্পর্শ করেছে। আমাদের মতো তাকেও কাঁদিয়েছে। ভাবিয়েছে। আবার এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনা-তদন্ত নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর মতো দায়িত্বশীল ব্যক্তির দায়িত্বহীন মন্তব্য ক্ষুব্ধ-বিস্মিত করেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি তার ব্যক্তিগত অনুরাগের কথাও গোধুলি তার লেখায় উল্লেখ করেছেন। অনেক সময় কাছে ডেকে নিয়ে তার কাজের প্রশংসা করেছেন। রুনির প্রতি প্রধানমন্ত্রীর ভালোবাসার কথাও তিনি জানতেন। তাই সেই রুনির মৃত্যু নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর নির্মম-নিষ্ঠুর মন্তব্য তিনি কোনোভাবেই স্বাভাবিক মেনে নিতে পারেননি। তার লেখায় সে বিস্ময়-ক্ষোভ-ক্রোধের শব্দমালাও আছে। বাংলাদেশের সামাজিক-রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিরাপত্তার যে অবস্থা, সেখানে মার্কিন প্রেসিডেন্টের সঙ্গে সংযুক্ত ফটোসাংবাদিক হিসাবে জুয়েল সামাদ, তার স্ত্রী-সন্তানের নিরাপত্তা দেশে কতটা বাস্তব সে প্রশ্নতো আছে।
আমরা যারা যুদ্ধাপরাধী জামায়াত-শিবির ও তাদের দোসরদের বিরুদ্ধে, সরকারি দাপটে ক্ষমতার অপব্যবহারকারীদের ব্যাপারে অবিরাম লিখে চলেছি, তাদের নিরাপত্তার প্রশ্নও আছে। কতো মানুষ যে সারাদিন কুচিকুচি করে কোপানোর নিয়ত করেন! একই কারণে দেশের ভেতর বসে যারা কাজ করছেন, তাদের নিরাপত্তা ঝুঁকির বিষয়টিও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। দেশে যারা আছেন, তারাও জঙ্গলে থেকে বাঘের সঙ্গে লড়াই করে টিকে আছেন। আর আমরা বিদেশবাসীরা ভিন্ন একটি পরিবেশ-পরিস্থিতিতে থাকতে থাকতে তুলনামূলক ভীতু অথবা ভয়কাতুরে হয়ে পড়েছি। এটাই আমাদের সোজা-সাপটা সরল স্বীকারোক্তি।
কিন্তু এটি সত্ত্বেও সত্য বাস্তবটি হলো, কপালে যাই থাক, দেশেতো ফিরে যেতেই হবে। সেখানেই আমাদের শিকড়, মিডিয়া ক্যারিয়ার, বাবার কবর, মায়ের-স্বজনের অপেক্ষা সবকিছু। জুয়েল-গোধুলির মা-স্বজনরাও দেশে।
অকাল বৈধব্যের পর এই জুয়েলকে নির্ভর করেই নতুনভাবে বেঁচে থাকার স্বপ্ন সাজিয়েছিলেন তার মা। প্রধানমন্ত্রী দায়িত্বহীন কী বললেন না বললেন, তার ওপর রাগ করে ক্ষুব্ধ হয়ে আমরাতো আর দেশে যাবো না এমন শপথ করতে পারি না। তা সম্ভব নয়। উচিতও না। প্রধানমন্ত্রী আজ আছেন, একদিন থাকবেন না। কিন্তু দেশ আমাদেরও। চিরদিনের। তার ওপর রাগ করে দেশে যাবো না, তা কি হয়! বা যে যা ভাবুক, আচরণ দেখাক, দেশকেতো আমরা কারও কাছে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত দেইনি বা দেবোও না। তাই দেশে যাবোই। গোধুলি আপনিও যাবেন। আপনার ১৭ মাসের শিশু সন্তান আইয়ানকে মা-বাবার জন্মভূমি দেখাতে নিয়ে যাবেন। তাকে নিয়ে দেখাবেন মা-বাবার স্কুল, কলেজ, খেলার মাঠ, শৈশবে হেঁটে বেড়ানো ধানক্ষেত, নদীতীর, শহীদ মিনার। স্মৃতিসৌধ, পহেলা ফাল্গুন, পহেলা বৈশাখ, পৌষমেলা। দেশে নিয়ে শোনাবেন নজরুলগীতি, লালনগীতি, জারি-সারি, ভাটিয়ালী, পল্লীগীতি। প্রিয় সাগর-রুনির কবর তাকে নিয়ে দেখাবেন। মাথায় হাত বুলিয়ে শান্ত্বনা দেবেন মেঘকে। মেঘের জন্য আমরা কী করতে পারি তার একটা পরিকল্পনা করবেন।
আমাদের দেশে আমাদের নিরাপত্তা দেখভালের জন্য অনেক স্বজন আছেন। প্রধানমন্ত্রীর কাছে বেডরুমের নিরাপত্তা আমরা চাইতেও যাবো না। মৃত্যু যদি দেশের মাটিতে থাকে তাতো হবেই। বিদেশে মরার পরওতো সামর্থ্যবানরা শেষ শয্যাটি চান দেশের মাটিতেই। মায়ের কাছাকাছি।
ফজলুল বারী: সিডনি প্রবাসী সাংবাদিক
বাংলাদেশ সময়: ১৬৩০ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২৭, ২০১২