শহীদ মিনার যেন বীর বাঙালিদের অহংকার। তাই তা ছড়িয়ে পড়েছে দেশ থেকে দেশান্তরে, যেখানে বাঙালিরা সেখানেই।
কিন্তু ওল্ডহ্যাম শহীদ মিনার! এ এক বিস্ময়, এখানে ইতিহাস সৃষ্টি হয়েছিলো ১৯৯৫ সালে। বাংলাদেশের বাইরে ভাষা আন্দোলনে নিহতদের স্মরণে এটিই প্রথম শহীদ মিনার। এরপর লন্ডনের আলতাব আলী পার্কে তৈরি হয়েছে বাঙালিদের আরেক শহীদ মিনার। খুব স্বাভাবিকভাবেই এই মিনারকে ঘিরে লন্ডনের বাঙালিরা একত্রিত হয়। সময়ে সময়ে। এখানে বাংলাদেশের মানবিক বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে উচ্চারিত হয় নানা কথা, হয় মানববন্ধন। তাইতো স্থানীয় কাউন্সিলও গুরুত্ব দেয় এই আলতাব আলী পার্ক কিংবা আমাদের শহীদ মিনারকে। সম্প্রতি টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিল প্রায় ছয় লাখ পাউন্ড দিয়ে এটি পুনঃসংস্কার করছে। শহীদ মিনার হয়ে উঠছে আরও ঝলমলে আরও দৃষ্টিনন্দন। লন্ডনের শহীদ মিনারেই ব্রিটেনের সবচেয়ে বড় জমায়েত হয়। হাজারো মানুষ উপচে পড়ে শহীদ বেদীতে ফুল দিতে। প্রতি বছর এখানেও ফুল দিতে আসে মানুষ। সাংস্কৃতিক অঙ্গনের ও সামাজিত সংগঠনগুলোর প্রতিনিধিরা আসে একুশের গান গেয়ে গেয়ে। হাজারো মানুষের হৃদয় নিংড়ানো ভালোবাসায়-জাগরণে উজ্জীবিত হয় অনাবাসী বাঙালি আগামীর জন্যে। কিন্তু শহীদ মিনার বাংলাদেশের মতো যেন প্রাণ নিয়ে আসে না। বাংলাদেশে যেখানে হাজার হাজার মানুষ শৃঙ্খলিত থাকে, একের পর এক দিয়ে যায় শ্রদ্ধার অর্ঘ্য, সেখানে লন্ডন কিংবা ওল্ডহ্যামের শহীদ মিনার শুধু শুধু জেগে উঠে নেতার আত্মাকে সালাম দিতে দিতে। রাজনৈতিক কর্মীদের এক কণ্ঠ থেকে অন্য কণ্ঠ, বহু কণ্ঠের বজ্র নিনাদে ভরে ওঠে শহীদ মিনার।
তবুও লন্ডনের শহীদ মিনার এবারে লড়াকুদের আস্ফালন ছিল কম। কারণ প্রতিপক্ষ ছিল ম্রিয়মান। লন্ডনের একটি কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার কমিটি আছে। এবার এই কমিটির আয়োজন ছিল আগের বছরগুলোর তুলনায় ভালো। আর এ কথাটি জানালেন প্রতিবছরই আলতাব আলী পার্কের শহীদ মিনারে উপস্থিত থাকা লন্ডনের একটি পত্রিকার সম্পাদক। তার মতে এবার কিছুটা হলেও শৃঙ্খলা ছিল আলতাব আলী পার্ক। যেহেতু প্রতিপক্ষ খুব একটা গলা উঁচু করেনি, তাই নিজেদের মধ্যেই ফাটাফাটি করেছে একটা রাজনৈতিক দলের দু’টো গ্রুপ।
ওল্ডহ্যামের শহীদ মিনারেও নর্থ-ওয়েস্টে বিভিন্ন শহর থেকে এসেছিল মানুষ। সারাদিনের গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি মাথায় নিয়ে শত শত মানুষ জমায়েত হয়েছিল সেখানে। যেহেতু সব মানুষেরই একটি ধারণা আছে, তাই এখানে কারও কোনও উচ্চাশা কিংবা আকাঙ্ক্ষা থাকে না। এখানে প্রতিবছরের মতোই অপ্রতুল আলোর মাঝে ফুল নিয়ে উপস্থিত হয় মানুষ। শহীদ মিনার ঘিরে নেই কোনও ব্যারিয়ার। সব দিক খোলা। মাইকিং ব্যবস্থাও থাকে না ভালো। উপস্থাপক সবসময়ই তার নিয়ন্ত্রণ হারান। মাত্র দু’তিনটা পুষ্পস্তবক অর্পণের পরই শহীদ নেতাদের সৈনিকেরা নিয়ন্ত্রণ নেন শহীদ মিনারের। শহীদ মিনার পেছনে রেখে ব্যানার টাঙিয়ে হাস্যোজ্জ্বল কর্মীরা এখানে দাঁড়িয়ে ব্যঙ্গ করেন একুশের শহীদদের। প্রথমে ছবি তোলা, তারপর ফুলের অর্ঘ্য। অসংখ্য সামাজিক সংগঠনের কর্মীরা তখন অসহায়ের মতো তাকিয়ে থাকেন। সৈনিকরা নেমে গেলে সামাজিক সংগঠনগুলোর কর্মীরা উঠে ফুল দেন। আর তখনই সত্যিকারের শ্রদ্ধার অর্ঘ্যে ভরে উঠে মিনার।
অথচ সামান্য উদ্যোগ নিলে এ ব্যাপারটি এড়ানো যেতো ওল্ডহ্যামের শহীদ মিনারেও। এখানে একটা শহীদ মিনার কমিটি করা যেতো। নর্থ-ওয়েস্টের চার-পাঁচটি ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের প্রতিনিধিদের পাশাপাশি আরও দু’একটি সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনের সমন্বয়ে ওল্ডহ্যামেও একটি শহীদ মিনার কমিটি গঠন করা যেতো। যেটা দিয়ে আয়োজন গোছানো সম্ভব। প্রায় সতেরো বছর হয়ে গেছে এ শহীদ মিনারের, অথচ এখানে কোনও সংস্কার হয় না। স্থানীয় কাউন্সিলে প্রভাবশালী বাঙালি কাউন্সিলররা আছেন। তারা এ ব্যাপারটাকে আরও গুরুত্ব দিতে পারতেন। কিংবা ওয়েলফেয়ারের নেতৃবৃন্দের মাধ্যমে শহীদ মিনারের সংস্কারে উদ্যোগী হতে পারে বর্তমান রক্ষণাবেক্ষণ কমিটি। লন্ডনে যেমন প্রাথমিক অবস্থায় ৫৪টি সংগঠন মিলে ২৬ হাজার পাউন্ড সংগ্রহ করেছিল, ঠিক সেভাবে বিভিন্ন সংগঠনের কাছ থেকে কিছু অর্থ সংগ্রহ করে কাউন্সিলের সহায়তা নিয়ে সংস্কার করা যেতে পারে ওল্ডহ্যামের শহীদ মিনার।
যেহেতু এখানে নেই কোনও ভালো আয়োজন, সে কারণে স্বাভাবিকভাবেই রাতের পুষ্পার্ঘ্য অর্পণের সময় এখানে থাকে না কোনও নিরাত্তা ব্যবস্থা। লন্ডনের শহীদ মিনারে প্রয়োজনীয় সিকিউরিটি ব্যবস্থা থাকে, তাই গোলযোগ এড়ানো সম্ভব হয়। অথচ ওল্ডহ্যাম শহীদ মিনারে এ কাজটি করতে পারে না কর্তৃপক্ষ। আর সেজন্যেই গোলযোগ এখানে যেন প্রতিবছরের অনিবার্যতা।
ওল্ডহ্যাম শহীদ মিনারে আসে না নতুন প্রজন্মের কোনও কিশোর-তরুণ। বরং অনেক অভিভাবককে তার সন্তানদের কাছ থেকে শুনতে হয় ‘এই-ই কি আপনাদের পেছনে ফেরা শেকড়!’ ওল্ডহ্যাম শহীদ মিনারে চার-পাঁচ বছর আগেও মহিলারা ফুল দিতে আসতেন, এবার সহকারী হাইকমিশনার শুধু সস্ত্রীক এসেছিলেন। আর কোনও নারী আসেন না। যে শহীদ মিনারে ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও কোনও নারী আসতে পারে না, সেটাকে কর্তৃপক্ষ আর যাই বলেন না কেন, অন্তত এখানে যে নিরাপত্তার বালাই নেই তা আর চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিতে হবে না। অথচ শহীদ মিনারতো কারও নিজস্ব সম্পত্তি কিংবা সম্পদ ভাবার মতো ব্যাপার নয়। একটা জাতির বীরত্বের প্রতীক এ মিনার। শহীদ মিনারে সর্বসাধারণের প্রবেশাধিকার নেই, এটা সভ্য সমাজে চিন্তা করাও যায় না।
ওল্ডহ্যাম শহীদ মিনারকে সর্বসাধারণের জন্যে গড়ে তোলা এখন অন্তত সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোর দাবী। বাংলাদেশের বাইরে ইতিহাস সৃষ্টি করা এই মিনার শুধুমাত্র একটা গ্রুপের নিজস্ব গণ্ডির মাঝে আবদ্ধ রাখার কারণে শহীদ মিনারটির প্রতি বাঙালিদের এক ধরনের নেতিবাচক ধ্যান-ধারণা গড়ে উঠছে। মানুষের জনসমাগম কমছে প্রতিবছর। অথচ একসময় ছিল, যখন কনকনে শীত উপেক্ষা করে বৃষ্টি মাথায় নিয়ে হাজারো মানুষ উপস্থিত হতো শহীদ মিনারে, গাইতো একুশের গান। রাজনৈতিক ডামাঢোলের কাছে সাধারণ মানুষের আবেদন এখানে ঢাকা পড়ছে প্রতিদিন, প্রতিবছর।
আমরা প্রত্যাশা করছি শুভবোধের উদয় হবে কর্তৃপক্ষের। একুশের মিনারকে ঘিরে আবারও জেগে উঠবে ওল্ডহ্যাম। রাজনৈতিক আর সাংস্কৃতিক কর্মীদের উপস্থিতিতে আবারও প্রাণবন্ত হয়ে উঠবে ওল্ডহ্যামের শহীদ মিনার। লন্ডনের শহীদ মিনারের মতোই এখানেও সময়ের প্রয়োজনে নর্থওয়েস্টে ইংল্যান্ডের বাঙালিরা জমায়েত হবে, করবে মানববন্ধন কিংবা জাতীয় বিপর্যয়ে করবে সাহসী উচ্চারণ।
ফারুক যোশী: যুক্তরাজ্যপ্রবাসী সাংবাদিক ও কলাম লেখক
faruk.joshi@gmail.com