মানবাধিকারের সার্বজনীন ঘোষণায় যে ২৫টি অধিকার দেওয়া হয়েছে তার মধ্যে বাংলাদেশের সংবিধানে ১৮টি নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার মৌলিক অধিকার হিসাবে স্বীকৃত। আমাদের সংবিধানের ৩য় অধ্যায়ের ২৬ থেকে ৪৪ অনুচ্ছেদে মৌলিক অধিকারগুলো সন্নিবেশিত হয়েছে।
আমাদের সংবিধানের ২য় ভাগের ৮ অনুচ্ছেদে মূলনীতিগুলো বর্ণনা করা হয়েছে। এগুলো হলো- ‘(১) জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা- এই নীতিসমূহের এবং তৎসহ এই নীতিসমূহ হইতে উদ্ভূত এই ভাগে বর্ণিত অন্য সকল নীতি রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি বলিয়া পরিগণিত হইবে। (২) এই ভাগে বর্ণিত নীতিসমূহ বাংলাদেশ-পরিচালনার মূলসূত্র হইবে, আইন-প্রণয়নকালে রাষ্ট্র তাহা প্রয়োগ করিবেন, এই সংবিধান ও বাংলাদেশের অন্যান্য আইনের ব্যাখ্যাদানের ক্ষেত্রে তাহা নির্দেশক হইবে এবং তাহা রাষ্ট্র ও নাগরিকদের কার্যের ভিত্তি হইবে, তবে এই সকল নীতি আদালতের মাধ্যমে বলবৎযোগ্য হইবে না। ’
এ ছাড়া ১১ নং অনুচ্ছেদে গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের কথা স্পষ্ট উল্লেখ করা হয়েছে। এই অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘প্রজাতন্ত্র হইবে একটি গণতন্ত্র, যেখানে মৌলিক মানবাধিকার ও স্বাধীনতার নিশ্চয়তা থাকিবে, মানবসত্তার মর্যাদা ও মূল্যের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ নিশ্চিত হইবে এবং প্রশাসনের সকল পর্যায়ে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে কার্যকর অংশগ্রহণ নিশ্চিত হইবে। ’
এছাড়া সংবিধানের ১৫(গ), ১৫(ঘ), ১৭ এবং ১৯ অনুচ্ছেদের অধিকার মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃত। মৌলিক অধিকার পাবার অধিকার হলো একটি রাষ্ট্রের নাগরিকদের অবিচ্ছেদ্য অধিকার। বিচারপতি হেদায়েত উল্লাহ বলেছেন, ‘The declarations of the fundamental rights of the citizents are the inalienable rights of the people ........ the constitution enables an individual to oppose ssuccessfully the whole community and the state to claim his rights.’
মহামান্য বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগকে সংবিধানের ৩য় ভাগের ৪৪ অনুচ্ছেদের মৌলিক অধিকার বলবৎকরণ করার জন্য অনুচ্ছেদ ২৬ এবং ১০২(১) দফায় মামলা গ্রহণের অধিকারের নিশ্চয়তা দেওয়া হয়েছে।
মঙ্গলবার মহামান্য হাইকোর্ট, অ্যাডভোকেট মনজিল মোর্সেদের দায়েরকৃত সাগর-রুনি হত্যা মামলায় ন্যায় বিচারের স্বার্থে মৌলিক অধিকার বলবৎ চেয়ে সরকারের বিরুদ্ধে করা রীট মামলা গ্রহণ করে শুনানির পর দেওয়া আদেশে সংবিধানের ৩৯ অনুচ্ছেদে বর্নিত মৌলিক অধিকারের উপর নির্দেশনা দিয়েছেন।
সংবিধান বিশেষজ্ঞ ব্যারিস্টার আব্দুল হালিম তার লেখা Constitution, Constitutional law and politice; Bangladesh perspective বইয়ের ১০০ পৃষ্ঠায় লিখেছেন, The independent fundamental right is guaranteed in Article 44 and the High Court Division of the Supreme Court is empowered to enforce fundamental rights under Article 102 of the Bangladesh Constitution.
ফলে সংবিধানের ১০২(১) অনুচ্ছেদের প্রদত্ত ক্ষমতা বলে মহামান্য হাইকোর্টের আদেশের নির্দেশনায় মৌলিক অধিকার বলবৎ করতে গিয়ে মৌলিক অধিকার খর্ব হয়েছে কি না তা জানতে আপিল বা উচ্চ আদালত স্বপ্রণোদিত হয়ে রুল জারি করলে এবং তা নিষ্পত্তি হলে স্পষ্ট বোঝা যাবে। আমরা বিজ্ঞ আদালত এবং আদালতের রায়ের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে বলতে চাই, এই নির্দেশনায় সংবিধানের মৌলিক অধিকার ক্ষুন্ন হওয়ার দাবি নিয়ে সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১০৩ এর প্রদত্ত ক্ষমতা বলে আপিল বিভাগে আপিল করা যায়।
বাংলাদেশ একটি প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানকে আধুনিক ও যুগোপোযোগী করা হয়ে থাকলে মিডিয়ার স্বাধীনতা খর্ব করা অসাংবিধানিক হবে। গণতন্ত্রের পূর্ব শর্ত হল মৌলিক ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা করা যা আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত। সংবাদপত্রের স্বাধীনতা সংরক্ষণ মৌলিক অধিকার- বিধায় এই অধিকার যাতে কোন ভাবে খর্ব না হয় তা নিয়ে দেশপ্রেমিক প্রত্যেক নাগরিককে সচেতন ও যতœবান হওয়া উচিত।
একটি স্বাধীন সার্বভৌম ও সংসদীয় গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে একটি উদীয়মান দেশপ্রেমিক সাংবাদিক দম্পতির নিরাপত্তা দিতে আমরা ব্যর্থ হয়েছি। বাংলাদেশের এই ঘটনায় বহির্বিশ্বে আমাদের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল না অনুজ্জ্বল হয়েছে তা বলার প্রয়োজন মনে হয় নেই। সাংবাদিক সমাজ যখন ক্ষতবিক্ষত হৃদয়ে মর্মাহত অবস্থায় সহকর্মী দম্পতি হত্যাকারীদের গ্রেপ্তার ও ন্যায় বিচারের জন্য দ্বারে দ্বারে ঘুরছে ঠিক তখন সাংবাদিকদের পেশার উপর যে কোন আক্রমন বা আক্রমনের সম্ভাবনা সম্পূর্নভাবে অযৌক্তিক ও অমানবিক।
আমরা আশা করি সরকার আমাদের চাহিদা বুঝে কাটা ঘায়ে লেবুর ছিটা দেবেন না। মনচাইলে আম ও গাছ দুটোই নিয়ে যেতে পারেন।
এ কে এম রিপন আনসারী
সাংবাদিক ও মানবাধিকারকর্মী
বাংলাদেশ সময়: ০৬২৩ ঘণ্টা, মার্চ ২, ২০১২