সংবিধান মেনে সাংবাদিক দম্পতির খুন নিয়ে প্রতিবেদন লিখলে আদালত অবমাননা হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা আছে। আবার না লিখলে পুলিশ এই ফাঁকে নতুন নাটক সাজিয়ে ফেলবে, তখন আমরা সাংবাদিকরা বিবেকের দংশনে জর্জরিত হবো।
মাননীয় উচ্চ আদালত কি আমাদের জানাবেন, কাকে মানাটা এখন বেশি জরুরি? সংবিধান না আদালত?
আইন-আদালত আমাদের জন্য। আইন-আদালতের জন্য আমরা না। আমাদের আস্থার জায়গা, সেই আদালত কেনো এমন কাজ করবেন যে, তার প্রতি মানুষের আস্থা হারাবে?
আমার মতো ছাপোষা সাংবাদিক, যে তার তিন বছর রিপোর্টিং ক্যারিয়ারে মাত্র দুইটা আদালত বিষয়ক রিপোর্ট করেছিল, আইনের অ আ ক খ না জেনে, সেই দুই রিপোর্টের কোথাও হয়নি আদালতকে অবমাননা। মহামান্য আদালত, এবার ভুল-ত্রুটি মনে হলে ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।
বিভিন্ন সময় আদালত অনেক বড় বড় অপরাধ ক্ষমা করেছেন। বিচারপতিদেরও কারো কারো নিয়োগ নিয়ে জাল সনদপত্র পেশ করা হয়েছে। আর আইনজীবীরা খোদ বিচারপতিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলে আন্দোলন করেছেন, করেন। অনেকেই কলুষমুক্ত নন। কিন্তু আমরা চাই আদালত কলুষমুক্ত থাকুক।
যেকোনো বিষয়ের কারণ জানা তো আমাদের মৌলিক অধিকারের মধ্যে পড়ে। আমরা আমাদের মৌলিক অধিকার প্রয়োগ করায় কেন রুল জারি হবে? আর জজ মিয়া!!! সে তো মিডিয়ার সৃষ্টি নয়, পুলিশের সৃষ্টি। তাহলে জজ মিয়া নিয়ে লিখলে তদন্ত ব্যাহত হবে কেন, বুঝলাম না। বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরীকে ব্যক্তিগতভাবে না জানলেও তার কাজের ধারার কারণে তিনি আমার পছন্দের তালিকায় ছিলেন। তার বেঞ্চ এমন একটা রুল জারি করলেন, তাতে তার কাজের ধারা যারা জানেন, তারা অবাক হবেনই হবেন।
রুল জারির পর সারাদেশসহ বহির্বিশ্বেও প্রশ্ন উঠেছে, রুল জারির এই ফাঁকে পুলিশ কোন নাটক সাজাবে? কিসের প্রয়োজনে রুল জারির দরকার পড়লো? কাকে হেফাজত করবে পুলিশ এই ফাঁকে? আবার কোন নতুন নাটকের পর্দা ওঠাবে পুলিশ ও গোয়েন্দাবাহিনী?
আমার জানা মতে, গণতান্ত্রিক বাংলাদেশে জনগণের মুখপত্র হিসেবে মিডিয়া, সংবিধানের ৩৯নং অনুচ্ছেদ বলে চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা এবং বাক-স্বাধীনতার বহিঃপ্রকাশ মাত্র। সংবিধানের ৩৯নং অনুচ্ছেদে (ক) বলা হয়েছে, প্রত্যেক নাগরিকের বাক ও ভাব প্রকাশের স্বাধীনতার অধিকার এবং ৩৯(খ) এ সংবাদক্ষেত্রের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দান।
তবে তো আমার বাক স্বাধীনতায় তো আর হস্তক্ষেপ হচ্ছে না এবং আমার বলা কথা মিডিয়ায় ছাপা হলে আদালত অবমাননা হবার কারণ কিভাবে ঘটবে?
এছাড়াও জাতীয় সংসদে অবাধ তথ্য অধিকার আইন পাস করা হয়েছে এবং তথ্য কমিশন গঠিত হয়েছে। জাতীয় সংসদ অনুমোদিত আইন অনুযায়ী প্রেস কাউন্সিল কার্যকরও আছে। ফলে সাগর-রুনির হত্যার বিষয়ে লিখতে কোনো বাধা নাই। বাধা নাই যেকোনো বিষয়ে লিখতে।
আমরা কি আমাদের, ভাই-বোন, বন্ধু, মা-বাবা, আত্মীয়, সহকর্মী বা প্রতিবেশীর প্রতি অন্যায় দেখলে বা তাদের ওপর অবিচার হলে মুখ বুঝে থাকবো? আমাদের মৌলিক অধিকার নিয়ে আমরা কথা বলতে পারবো না বা লিখবো না, এটা কি করে হয়? লেখার ক্ষেত্রে আমাদের হাত বেঁধে ফেলা বা বাকরুদ্ধ করার চেষ্টা কতটা সঠিক, মাননীয় আদালত?
মাননীয় আদালত পুলিশের ওপর চাপ দিন। পুলিশের ওপর রুল জারি করুন। কেনো আমাদের খুনের বিচার চাইতে আমাদের পথে নামতে হবে? মাননীয় আদালত, রুল জারি করুন সরকারের ওপর। জানতে চান, কেন সরকার বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন কথা বলছে? কেনই বা পুলিশ লুকোচুরি খেলছে?
পুলিশের কাজের ধারা আমরা তথা সারাদেশবাসী জানি। আর আমরা জানি বলেই আমাদেরকে থামাবেন না। আমাদের শাঁখের করাতের মধ্যে দয়া করে আটকাবেন না।
মাননীয় আদালত, আপনি জানেন, পুলিশ অনেক কিছুতেই এই দেশে ব্যর্থ। কখনো রাজনৈতিক চাপে, কখনো টাকার চাপে, কখনো আবার সন্ত্রাসীদের চাপে। আমরা সাংবাদিকরা আসল ঘটনা বের করে এনেছি, যেখানে ব্যর্থ হয়েছে পুলিশ। সাভারের সিক্স মার্ডারের ঘটনা নিশ্চয় কেউ ভোলেননি।
আমাদের দেশের পুলিশ যুগে যুগে ব্যর্থ হয়েছে রাজনৈতিক চাপে। আর এই রাজনৈতিক চাপের কারণে অনেক মিথ্যা ও ভুয়া খুনি সাক্ষী জোগাড় করে পুলিশ আসল ঘটনার মোড় ঘুরিয়ে দেয়, এতো আর নতুন না। ক্ষমতাশালীদের বাঁচাতে পুলিশ পারে না, হেন কাজ নেই। তাই আমাদের বন্ধুদের আসল হত্যাকারীদের না ধরলে ঘটনার মোড় ঘুরবে আর বিচারের বাণী নিভৃতে কাঁদবেই। তাই মাননীয় আদালত, পুলিশের ওপর চাপ দিন।
সংবাদপত্র বা মিডিয়াকে সমাজের দর্পণ বা আয়না বলা হয়। মিডিয়া দেশের আনাচে-কানাচেসহ সারাবিশ্বের ঘটনাবলী তুলে আনে। সংবাদকর্মীরা অবাধ গতিতে রাতদিন ঝড় তুফান এক করে ছুটে চলেন সংবাদের সন্ধানে। সেই অবাধ গতির পথে গতিরোধক কোনো অবস্থায়ই কাম্য নয়।
খুনিদের গ্রেফতারে পুলিশের ব্যর্থতা নিয়ে একটি আবেদনে মঙ্গলবার আদালত বলেছেন, হত্যাকাণ্ড তদন্তে ভুল বা অবহেলা দেখা যায়নি। মহামান্য আদালত যখন জানেন, হত্যাকাণ্ড তদন্তে ভুল বা অবহেলা দেখা যায়নি, তাহলে রুল জারির কেন দরকার পড়লো? আদালত এও বলেছেন, কিছুসংখ্যক রাজনীতিবিদ তদন্তকে বাধাগ্রস্ত করতে দায়িত্বজ্ঞানহীন মন্তব্য করছেন। সেখানে সাংবাদিকদের কোনো হাত নেই। দোষ করলেন রাজনীতিবিদরা, রুল জারি হলো সাংবাদিকদের জন্য!’
মিডিয়া ছাড়া প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেত্রী, ব্যবসায়ী এবং বিভিন্ন পেশাজীবী চলতে পারেন না। এমনকি মহামান্য আদালতেরও প্রয়োজন মিডিয়াকে। আমরা সাংবাদিকরা সমাজের চালচিত্র তুলে ধরি। সেই আমাদের কাজের পথে যদি আইনি বাধা পড়ে, তাহলে তো আমাদের জন্য কাজ করাই হবে দুষ্কর। আমাদের কাজকে দুষ্কর করে দেবেন না, মাননীয় আদালত।
আমাদের সাংবাদিক নেতারা সব সময় বলছেন, আমরা আদালতের স্বাধীনতায় যেমন বিশ্বাসী, তেমনিভাবে যেকোনো অবস্থায় সংবিধান অনুযায়ী গণমাধ্যমের স্বাধীনতা রক্ষায় বদ্ধপরিকর।
তাছাড়াও মাননীয় আদালত সরকারের মন্ত্রী, বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কর্মকর্তাদের সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচারকে ব্যাহত অথবা ভিন্নখাতে প্রবাহিত করতে পারে এমন কোনো বক্তব্য, মন্তব্য না দেওয়ার জন্যও অনুরোধ জানিয়েছেন। তাহলে দোষ করলেন রাজনীতিবিদরা, পায়ে আইনি বেড়ি পরানোর সম্ভাবনা আমাদের কেন?
আমরা সাংবাদিকরা সমাজের চালচিত্র তুলে ধরি। সেখানে কেউ কেউ অতি উৎসাহে অতিরঞ্জিত কিছু করে ফেলেন, এটাও সত্য। যেমন কেউ কেউ সাগর-রুনির খুনের রিপোর্টকে মশলাদার, রগরগে করতে চেয়েছেন, তাদের জন্য ধিক্কার। তাদের দুই-তিন জনের জন্য পুরো সাংবাদিক সমাজ কেন রুলের মধ্যে পড়বে? তা মেনে নেওয়ার নয়।
পুলিশ কেন পুরো ঘটনাটিকে ধূম্রজালে রেখেছে? কেনই বা এতো লুকোছাপা? আর কেনই বা এতো দিন লাগছে, তা পরিষ্কার করে বলছে না? বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন তথ্য দিয়ে বিভ্র্যান্তি ছড়াচ্ছে? আইন-আদালত প্রমাণ ছাড়া কোনো কিছু মানতে চান না। হাজারো বড় বড় অপরাধী প্রমাণের অভাবে আইনের ফাঁক গলে বের হয়ে যায়। আমাদের বন্ধুদের হত্যাকারীরা কি প্রমাণ মুছে ফেলার এখনো যথেষ্ট সময় পায়নি? তাদের কি নিরাপদ স্থানে পৌঁছানো হয়নি?
মাননীয় আদালত, সাগর ও রুনির আসল হত্যাকারীরা যেন প্রমাণ মুছে ফেলতে না পারে আমাদের সজাগ থাকতে হবে। আমাদের বন্ধুদের হত্যাকারীরা অচিরে পার না পেয়ে যায়, সে জন্য আমাদের লিখে যেতেই হবে। আর সেই লেখার ওপর কোনো আইনি প্যাঁচ কেউ কষতে না পারে, তা আপনাকেই দেখতে হবে। আপনি কলঙ্কমুক্ত থাকুন, আর আমরাও আপনার ওপর অবিচল আস্থা রাখি।
ফারজানা খান গোধুলি: ওয়াশিংটন প্রবাসী সাংবাদিক
বাংলাদেশ সময়: ১৬১০ ঘণ্টা, মার্চ ০২, ২০১২