সাগর-রুনি হত্যা মামলা সম্পর্কে উচ্চ আদালতের নির্দেশনা সংবাদপত্রের সাংবিধানিক অধিকার ও সরকার-প্রণীত তথ্য অধিকার আইনের সাথে সাংঘর্ষিক নয়। সংবাদের বস্তুনিষ্ঠতা ও গোপনীয়তা বজায় রাখতে আদালত এই নির্দেশনা দিয়েছেন।
সংবিধানে মৌলিক অধিকার বলবৎকরণের জন্য উচ্চ আদালতকে যেকোনো সংক্ষুব্ধ ব্যক্তির দায়ের করা মামলা গ্রহণ করার অধিকার সংরক্ষিত আছে (অনুচ্ছেদ ৪৪)। মৌলিক অধিকার বলবৎ ও প্রয়োজনে মৌলিক অধিকার ক্ষুণ্ন করে এমন আইন ও সংবিধান হয়ে থাকলে সেগুলো বাতিল করার ক্ষমতা উচ্চ আদালতের রয়েছে {অনুচ্ছেদ ২৬ ও ৭(খ)}। সাগর-রুনি হত্যা মামলার তদন্ত চলছে। এই সময়ে তদন্ত কাজ ব্যাহত হয় এমন কোনো সংবাদ দেয়া যাবে না। কিন্তু তদন্ত চলাকালীন কোনো ব্যক্তি বা প্রজাতন্ত্রের কোনো কর্মচারী যদি কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর স্বার্থ চরিতার্থ করণে সুষ্ঠু তদন্তে ব্যাঘাত সুষ্টি করেন তখন ওই সম্পর্কে লিখলে উচ্চ আদালতের নির্দেশনার অবমাননা হবে কিনা সে সম্পর্কে আদালতের নির্দেশনা থাকলে আমাদের সুবিধা হত। কোনো তদন্ত পরিশুদ্ধ না হলে প্রকৃত অপরাধীরা আইনের আওতায় আসে না আর তখনই ন্যায়বিচার বাধাগ্রস্ত হয়। কোনো বিষয়ে এই ধরনের পরিস্থিতি যদি সৃষ্টি হয় তবে নাগরিকের মৌলিক মানবিক অধিকার খর্ব হয় এবং জান ও মালের নিরাপত্তা হুমিকর মাঝে পড়ে। এইসব ক্ষেত্রে সংবাদপত্র কোনো প্রতিবেদন দিয়ে আদালতকে ন্যায়বিচারের স্বার্থে সহযোগিতা করতে পারবে কিনা? সংবিধান ও আইনে থাকলেও এখন আমরা জানি না।
সম্প্রতি উচ্চ আদালত পত্রিকার প্রতিবেদনের ভিত্তিতে বেশ কয়েকটি রুল জারি করে জাতির দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। সুতরাং পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদনের আলোকে যদি ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত করার সুযোগ থাকে তবে একটি বিষয়ের ক্ষেত্রে এমনটি কেন হল তা বলতে পারব না।
আইনমন্ত্রীর বক্তব্য আইন ও সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক কি না সে বিষয়টি এখন ভেবে দেখার বিষয়। কারণ, সংবিধান ও আইনে মিডিয়াকে যে স্বাধীনতা দেয়া হয়েছে তা সব ক্ষেত্রে প্রযোজ্য না হলে অধিকার খর্ব হয়। বিজ্ঞ আদালত সংবিধান ও আইনের সংশ্লিষ্ট অনুচ্ছেদ ও ধারাকে অসঙ্গতিপূর্ণ বলে তা সংযোজন, বিয়োজন অথবা বাতিলের নির্দেশনা দেন নি।
সুতরাং এই ক্ষেত্রে আইনমন্ত্রীর বক্তব্য সঠিক। কিন্তু বাস্তবতার আলোকে আইনমন্ত্রীর বক্তব্যকে সাংঘর্ষিক বলতে হবে এই কারণে যে, মাননীয় আইনমন্ত্রী মিডিয়ার স্বাধীনতা খর্ব হয়নি মর্মে যে বক্তব্য দিলেন সেই বক্তব্য অনুসারে মিডিয়া স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারছে না। ফলে আইনমন্ত্রীর বক্তব্য সাংঘর্ষিক। কোনো বিষয়ে সংবিধান, আইন, আদালত আর আইনপ্রণেতার বক্তব্য যদি এক ও অভিন্ন হয় তবে সেই অধিকার পরিপূর্ণতা পাবে। সাগর-রুনি হত্যা মামলা তদন্তাধীন একটি বিষয়। এই বিষয়ে সকলের সহযোগিতা না থাকলে প্রকৃত সত্য উদঘাটন করা কষ্টসাধ্য হবে।
১৮৬০ সালের দণ্ডবিধি আইনের ১৮৭ ধারায় বলা হয়েছে, সাহায্যদানের জন্য আইনতঃ বাধ্য হওয়ার ক্ষেত্রে সরকারি কর্মচারীকে সাহায্য না করলে দণ্ডনীয় অপরাধ। এই ধারায় বলা হয়েছে, যে ব্যক্তি, কোনো সরকারি কর্মচারীকে তার সরকারি কর্তব্য সম্পাদনের ব্যাপারে সাহায্য দান বা সরবরাহ করার জন্য আইনতঃ বাধ্য হয়ে ইচ্ছাকৃতভাবে অনুরূপ সাহায্যদান না করে সেই ব্যক্তি বিনাশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবে। এই দণ্ডের মেয়াদ হবে ১ মাস বা অর্থদণ্ড যার পরিমাণ দু’শ’ টাকা পর্যন্ত হতে পারে বা উভয়বিধ দণ্ডে দণ্ডিত হতে হবে।
এই ধারায় আরো বলা হয়েছে, কোনো বিচারালয় কর্তৃক জারিকৃত কোনো প্রক্রিয়া কার্যকরি করার ক্ষেত্রে কোনো অপরাধের অভিযুক্ত বা দোষী সাব্যস্ত বা আইনানুগ প্রহরা থেকে পলাতক কোনো লোককে গ্রেফতার কাজে সহযোগিতা না করলে বিনাশ্রম কারাদণ্ড যার মেয়াদ ৬ মাস পর্যন্ত হতে পারে বা অর্থদণ্ডে যার পরিমাণ ৫শ টাকা বা উভয়বিধ দণ্ডে দণ্ডিত হবে।
রাষ্ট্রের মালিক জনগণ। জনগণের জন্য আইন। সংবিধান রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আইন। সংবিধান ও আইন শুধুই রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রের মালিক জনগণের জন্য। এই জনগণের মাঝ থেকে সরকারি কর্মচারীসহ রাষ্ট্রীয় দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের নিয়োগ করা হয়। সুতরাং সরকারি-বেসরকারি লোক যারা এই রাষ্ট্রে বসবাস করেন এবং নাগরিকত্ব আছে তাদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য সংবিধান ও আইন এর সুফল ভোগ করতে যেয়ে যদি দোলাচলে দোলতে হয় তবে স্বাধীনতা প্রশ্নবিদ্ধ হবে কিনা সে দায়িত্ব পাঠকদের উপর রইল।
বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে আমি আশা করি, আমাদের সংবিধান ও আইন আমাদের কল্যাণের জন্য অকল্যাণ্যের জন্য অবশ্যই নয়। এই বিষয়টিকে প্রাধান্য দিয়ে যার যার অবস্থান থেকে দায়িত্ব পালন করলে কোনো সমস্যাই সমস্যা হওয়ার কথা নয়।