২০০৯ সালে লাহোরে শ্রীলংকান ক্রিকেট টিমের ওপর মৌলবাদী জঙ্গি হামলার পর থেকে ক্রিকেট ভুবনে নিষিদ্ধ এক গন্তব্যের নাম পাকিস্তান। ওই ঘটনার পর দুনিয়ার কোনও ক্রিকেট দল আর খেলতে পাকিস্তান যায়নি।
অথচ ফেডারেশন অব ইন্টারন্যাশনাল ক্রিকেটার্স অ্যাসোসিয়েশন (ফিকা) মনে করছে ভেন্যু হিসাবে পাকিস্তান এখনো মোটেই নিরাপদ না। ফিকার নির্বাহী প্রধান টিম মে আমেরিকা থেকে ‘মিড ডে’ ট্যাবলয়েডকে দেয়া ইন্টারভ্যুতে বলেছেন, এমনকি শ্রীলংকার ওপর হামলার সময়ের তুলনায়ও বিপদজ্জনক এখন পাকিস্তানের অবস্থা। নিজ দেশের ভেন্যুকে নিরাপদ করতে পাকিস্তানকে আরও কাজ করার তাগিদ তিনি দিয়েছেন। টিমের আশংকা-হুশিয়ারিকে গুরুত্ব দিয়ে বিসিবি এবং বাংলাদেশ সরকারকে অনুরোধ করে বলছি, জাতীয় দলকে কারও গিনিপিগ বানাতে জীবনঘাতী বিপদ ও ঝুঁকির দিকে ঠেলে দেবেন না। ইদানিং দেশে-বিদেশে আমাদের গৌরব করার মতো খুব বেশি কিছু নেই। গৌরবের যা আছে এর মাঝে জাতীয় ক্রিকেট টিমটি গুরুত্বপূর্ণ। দেশবাসীর প্রিয় টাইগার বাহিনিই দেশে-বিদেশে প্রতিনিধিত্ব করছে আমাদের প্রাণের পতাকার। আমাদের সাকিব আল হাসান এখনও আইসিসি স্বীকৃত বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার। শুধুমাত্র পাকিস্তানের স্বার্থে বিসিবি এবং বাংলাদেশের যারা এ দলটিকে নিয়ে জুয়া খেলার ফন্দি আঁটছে তাদের থামান, নিবৃত্ত করুন। ক্রিকেটদলকে পাকিস্তান পাঠানোর সিদ্ধান্ত বাতিল করুন, অতিদ্রুত!
বিসিবির সভাপতি, আওয়ামী লীগ দলীয় এমপি আ ন হ মুস্তফা কামালের নিয়তের কথা বলছিলাম। ইনি যতোটা না ক্রিকেটবোদ্ধা, রাজনীতিক, বলা হয় এর চেয়ে বেশি ব্যবসায়ী! শেয়ার বাজার থেকে শুরু করে ক্রিকেট সবকিছুতেই ব্যবসাটাকেই বড় করে দেখেন! তিনি যে দলের রাজনীতি করেন, সে দল আর দেশের কী অবস্থা-বাস্তবতা কিছুই তিনি যেন জানেন না বোঝেন না! বা তা যেন তার জানার-বোঝার দরকারও নেই! তার দলের তথা আওয়ামী লীগ নেতৃ্ত্বাধীন মহাজোট সরকারের এখন মূল রাজনৈতিক কর্মসূচি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, এ বিচারকে কেন্দ্র করে শীতল একটি সম্পর্ক যাচ্ছে পাকিস্তানের সঙ্গে। বিচার বানচালে দেশে-বিদেশে মরিয়া চেষ্টা করে যাচ্ছে যুদ্ধাপরাধীদের দল জামায়াত-শিবির, তাদের দোসররা। পাকিস্তানেও কিন্তু এ দলটির ভ্রাতৃ সংগঠন তথা জামায়াতে ইসলামী পাকিস্তানি বিশেষ সক্রিয় অবস্থায় আছে।
যুদ্ধাপরাধীদের চলমান বিচার প্রক্রিয়ার সঙ্গে পাকিস্তানি ঘাতকদের সম্পৃক্ত করার একটি দাবি সক্রিয় আছে দেশে-বিদেশে । পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনি থেকে শুরু করে সরকারি লোকজনের সঙ্গে পাকিস্তানি যেখানে যার দেখা হচ্ছে, তাদের একাত্তরের গণহত্যার জন্য ক্ষমা চাইতে বলছেন, আর সেখানে লোটাস কামাল ক্রিকেট না তার কোনও ব্যবসার স্বার্থে বিশেষ বিডি ক্রিকেট দলকে পাকিস্তান নিয়ে যাবেনই যাবেন, পণ করেছেন, তা নিয়ে তদন্তের দাবি উঠতে পারে। যেখানে ফিকা বলছে ভেন্যু হিসাবে পাকিস্তান এখনও নিরাপদ না, লাহোরে শ্রীলংকার ওপর হামলার ঘটনার সময়ের চাইতেও বেশি বিপদজ্জনক, আর লোটাস কামাল ইসলামাবাদে প্রেস কনফারেন্স করে উল্টো কথা বলে এসেছেন! এখন দেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ব্যাহত ও বানচাল করতে যেখানে বিমান ছিনতাই থেকে শুরু করে নানা পরিকল্পনার কথা শোনা যাচ্ছে, সেখানে যুদ্ধাপরাধীদের পাকিস্তানি পেয়ারা দোস্ত-ইয়াররা এর শোধ নিতে বাংলাদেশি ক্রিকেটারদের ওপর যে হামলা চালাবে না, এর গ্যারান্টি কে দিয়েছে বিসিবি সভাপতি তথা লোটাস কামালকে? এর জবাব তাকেই দেশের মানুষকে সাফ ভাষায় দিতে হবে।
সাম্প্রতিক আরও কিছু কারণে পাকিস্তানের টালমাটাল অবস্থা! অ্যাবোটাবাদের বাড়িতে তাদের লাদেন আব্বাকে হত্যার পর থেকে পাকিস্তানি মৌলবাদীরা তেতে আছে। লাদেন হত্যার পর সারা পাকিস্তান জুড়ে যে প্রতিবাদ হয়েছে, সে ঘটনা আবার সবাইকে মনে করিয়ে দিয়েছে যে মৌলবাদের শেকড় প্রোথিত দেশটির কত গভীরে! আফগানিস্তানে মার্কিন বাহিনির হাতে কোরান পোড়ানোর ঘটনার প্রতিবাদের ঢেউ সম্প্রসারিত হয়েছে পাকিস্তান পর্যন্ত। পাক-আফগান সীমান্তে মার্কিন নেতৃ্ত্বাধীন ন্যাটো বাহিনির ড্রোন বিমান হামলায় হতাহতের ঘটনায়ও ক্ষোভের অনল প্রবাহ বইছে গোটা পাকিস্তান জুড়ে। সবশেষ জানা গেল, পাকিস্তানি লস্কর-ই-তৈয়বার মতো বিপদজ্জনক মৌলবাদী জঙ্গি সন্ত্রাসী বাহিনীর মোকাবেলায় প্রশিক্ষণ মিশনে দক্ষিণ এশিয়ার কয়েকটি দেশের সঙ্গে বাংলাদেশেও আছে মার্কিন বিশেষ বাহিনি। এসবের যোগফল দাঁড়ায়, এমন একটি পরিস্থিতি বাংলাদেশ ক্রিকেট দলকে পাকিস্তান পাঠানোর মোটেই অনুকূল নয়। এটা জেনেশুনে দেশবাসীর প্রিয় দলটাকে আগুনে ঝাঁপ দিতে বলার সামিল!
একইসঙ্গে শ্রীলংকান ক্রিকেট দলের ওপর হামলার প্রেক্ষাপট ভুলে গেলে চলবে না। শ্রীলংকার সঙ্গে পাকিস্তানের এমন কোন দা-কুমড়ো সম্পর্ক কখনোই ছিল না। যা নানা কারণে বাংলাদেশের সঙ্গে আছে। পাকিস্তানি জঙ্গিরা যেখানে সেই শ্রীংলকার ওপর হামলার সুযোগ হাতছাড়া করতে পিছপা হয়নি, চলতি পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের মতো দল সেখানকার মৌলবাদী জঙ্গিরা থাবার মধ্যে পেলে তাদের নিয়ত কামিয়াবের সুযোগ হাতছাড়া করতে চাইবে, এমন বিশ্বাসী খুঁজতে বেগ পেতে হবে। আর মৌলবাদী সন্ত্রাসী যারা ক্রিকেটের মতো আসরে হামলা চালায়, তারা এসব আয়োজনকে কুফরি হিসাবে দেখে, এ ধরনের আসর বা খেলোয়াড়দের ওপর হামলার মাধ্যমে সওয়াব অর্জনের পাশাপাশি তারা আন্তর্জাতিক প্রচারও চায়। আমাদের সাকিব, মুশফিক, মাশরাফিসহ সোনার ছেলেদের এসব বিপদজ্জনক মৌলবাদী জঙ্গীর টার্গেটে পরিণত করতে দেবেন না প্লিজ! সেই ২০০৯ সাল থেকে পাকিস্তানি জঙ্গিরা এমন একটি সুযোগের আশায় রক্তলোলুপ-ক্ষুধার্ত হয়ে আছে। এ অবস্থায় ক্রিকেট দলের পাকিস্তান যাত্রা বাতিল করতে লোটাস কামাল নয়, ক্রিকেটপ্রেমী খোদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হস্তক্ষেপ কামনা করছি।
কারণ লোটাস কামালের কাছে ব্যবসা বড়। সে কারণে তার সরকার যখন যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করছে, তিনি তখন বিশ্বকাপ ক্রিকেট উপলক্ষে তাদের টাকশাল ইসলামী ব্যাংকের টাকায় ঢাকা শহর সাজান। পাকিস্তানিদের কোন অফারের লোভে এই পরিস্থিতিতে তিনি বাংলাদেশ দলকে পাকিস্তান নিয়ে যেতে উঠেপড়ে লেগেছেন, তা সরকার অথবা দুদক তদন্ত করে দেখতে পারে। অতএব প্রিয় ক্রিকেটদলকে পাকিস্তানি জঙ্গিদের থাবা থেকে বাঁচাতে সে দেশে পাঠানোর বিপদজ্জনক সিদ্ধান্তটি বাতিলের দ্রুত সিদ্ধান্ত দিন প্রিয় প্রধানমন্ত্রী। এব্যাপারে বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের ভক্ত-ক্রীড়ামোদী বিরোধীদলের নেত্রী বেগম খালেদা জিয়াসহ দেশবাসীর জোরালো ভূমিকা আশা করছি।
ফজলুল বারীঃ সিডনিপ্রবাসী সাংবাদিক