পত্রিকা পড়ার অভ্যাসটা বদলে যাচ্ছে! কথাটা ঠিক এমন নয়। তবে হাতে কাগজ নিয়ে চা পান করতে করতে পত্রিকা পড়া কমছে।
নিজের দিকে তাকিয়ে দেখি দিনের বড় সময় আমার চোখ থাকে অনলাইন বার্তা সংস্থাগুলোর দিকে কিংবা পত্রিকাগুলোর অনলাইন সাইটে এবং আমি খবর নিয়ে দেখেছি যে পত্রিকাগুলোর ওয়েব পাঠক প্রচলিত সার্কুলেশন পাঠকের চেয়ে অনেকগুণ বেশি।
তবে কি ধীরে ধীরে মানুষ খবর পড়বে শুধু অনলাইনে?
পশ্চিমা বিশ্বে ইন্টারনেটের ব্যাপক বিস্তারে পত্রিকার প্রিন্ট সংস্করণ অনেক কমছে। অনলাইনে বাড়ছে পত্রিকা পাঠ। তথ্য আজ শুধু কিছু নির্দিষ্ট মানুষের সম্পদ নয়। আর তাই বলা হচ্ছে এই নিউ মিডিয়া ট্র্যাডিশনাল মিডিয়ার চেয়ে অনেক বেশি গণতান্ত্রিক।
বিশ্বজুড়ে আলোচনা আর বিতর্ক জমে উঠেছে- তা হলে কি বহুদিনে গড়ে ওঠা বার্তাকক্ষ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছেন সাংবাদিকরা? খারাপ কিংবা ভালো .. এ বিতর্কে না গিয়েও স্বীকার করতে হবে নতুন ধারার এই সাংবাদিকতা অনেক বেশি প্রযুক্তিনির্ভর। প্রযুক্তি আজ মানুষের চাওয়া বদলে দিচ্ছে।
যা আজ ঘটলো, তার জন্য পরদিন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে চায় না মানুষ। টেলিভিশন আর রেডিও আসার পর পত্রিকা ধাক্কাটা সামলেছিল সম্পাদকীয় আর বিশ্লেষণী ক্ষমতার জোরে। কিন্তু নিউ মিডিয়া দ্রুততার সাথে শুধু তথ্যই দিচ্ছে না, সমাজের নানা স্তর থেকে নিয়ে আসছে বহুমুখি বিশ্লেষণও।
প্রিন্ট মিডিয়ার জয়জয়কার দেখে কথা উঠেছিল যে, সাংবাদিকতা হল `literature in hurry’ । এখনকার নিউ মিডিয়া নিয়ে তারা কি বলবেন এখনো জানি না। তথ্য পাওয়া, তথ্য দেওয়া আর তা নেওয়া সব ক্ষেত্রেই গতিটাই আসল।
এই যে বদলে যাওয়া সেটা কি শুধু সাংবাদিকদের বদলে যাওয়া? মানুষের তথ্য চাওয়ার ধরন বদলে যাওয়া? না, তা শুধু নয়। বদলে গেছে এর মালিকানার ধরনও। সবকিছু এখনই সবিস্তারে বলা হয়তো সম্ভব নয়।
কিন্তু একই সাথে প্রশ্ন উঠছে এই সাংবাকিতার গুণাগুণ নিয়ে। মানুষ দ্রুততার সাথে তথ্য পাচ্ছে, কিন্তু কমছে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা। সাংবাদিকতা এখন যেন অনেক বেশি ব্যবস্থাপনার কাজ, সেখানে কমছে সাংবাদিকের স্বাধীনতা। অনেক অপেশাদারের দাপট বাড়ছে এই পেশায়, এমনটাও বলছে কেউ কেউ। তবে সবক্ষেত্রে যে এটা ঠিক তা নয়।
আমি মনে করি এ সবই সাময়িক। বদলে যাওয়ার স্রোতে শুধু নেতিবাচক দিক নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার আগে ভাবতে হবে সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক আর আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট। একটি দেশের সামাজিক, রাজনৈতিক আর অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা অনেকাংশে পরিচালিত করে গণমাধ্যমকে। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাপনা যেখানে মজবুত, স্বভাবতই সাংবাদিকতা সেখানে অনেক স্বাধীন।
নিউ মিডিয়ার কথা এভাবে বললে হয়তো ভুল বলা হবে। সাংবাদিকতা আসলে বদলেছে বারবারই। সবসময়ই তা এক অবস্থা থেকে আরেক অবস্থায় উন্নীত হয়েছে।
নিউ মিডিয়ার ক্ষেত্রে একটি প্রশ্ন উঠে আসছে, আর তা হল এখানে সম্পাদকীয় প্রতিষ্ঠান কি প্রিন্ট মিডিয়ার মতো শক্তিশালী ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত? কিংবা প্রচলিত অর্থে যে গেট কিপার প্রথা থাকে, তা কি আছে এখানে? আর সিটিজেন জার্নালিজম বা নাগরিক সাংবাদিকতার কারণে কি সংবাদের কনটেন্ট-এর উপর সাংবাদিকদের নিয়ন্ত্রণ কমছে? এমন সব জিজ্ঞাসাও আছে অনেক ক্ষেত্রে।
এসব প্রশ্নের উত্তর দেবেন এই মিডিয়ার সম্পাদকেরাই। তবে এ কথাতো মানতেই হবে প্রচলিত মিডিয়ার চেয়ে নিউ মিডিয়ায় মানুষের অংশীদারিত্ব অনেক বেশি।
আরেকটি বিষয় ভাববার হল যে প্রায় সবগুলো অনলাইনের মাধ্যমে একই ধরনের সংবাদ দেয়ার প্রবণতা। পশ্চিমা বিশ্বে এ আলোচনা বেশি হচ্ছে। বাংলাদেশে অবশ্য আমরা দেখছি যে অনলাইন সাইটগুলো এই প্রবণতা থেকে দূরে। তারা যে কোনো সংবাদ দ্রুত, কিন্তু বিশ্লেষণের সাথে দেওয়ার চেষ্টা করছে।
উন্নত প্রযুক্তি আসছে, নিউ মিডিয়া আরো আধুনিক হচ্ছে। প্রশ্ন থাকছে একই সাথে কি সংবাদের বৈচিত্র্য বাড়ছে? যদি তা হয় তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যাবে সাংবাদিকরা মূলত নিউজ ডেস্ক কেন্দ্রিক হয়ে পড়ছে। নিউমিডিয়ার সংবাদ কর্মীদের অনেক বেশি সময় কাটে বার্তা কক্ষে।
সংবাদের পেছনে সাংবাদিকের যে ছুটে চলা তা দেখা যায় কম। তবে কি তা অফিস সাংবাদিকতা?
লেখক: সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা,পরিচালক (বার্তা), একাত্তর টেলিভিশন
ishtiaquereza@gmail.com