সমালোচনাকারীদের মুখে কুলুপ। কারণ প্রায় আট বছরের নির্মাণকাজ শেষে শনিবার (২৫ জুন) বহুল আকাঙ্ক্ষিত পদ্মা সেতুর শুভ উদ্বোধন হবে।
খরস্রোতা নদীর ওপর সেতুর প্রকল্প ব্যয় ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি ৩৯ লাখ টাকা। ২১ জুন পর্যন্ত ব্যয় হয়েছে ২৭ হাজার ৭৩২ কোটি ৮ লাখ টাকা। নদীর তলদেশে মাটির গভীরে পাইল বসানো ছিল সবচেয়ে কঠিন কাজ। আনা হয়েছিল পৃথিবীর বড় বড় ৩টি ড্রেজার। নদীতে অনেক ভারী পাথর, কংক্রিটের ব্যাগ এবং জিওব্যাগ ব্যবহার করা হয়েছে। যেসব পাথর ব্যবহার করা হয়েছে তার এক একটির ওজন ৮০০ কেজি থেকে এক টন। তলদেশে মাটির নিচে ২৩০ মিটার পর্যন্ত গেছে পিলারগুলো। এজন্য পরিবর্তন করতে হয়েছে সেতুর নকশাও।
বুধবার (২২ জুন) গণভবনে অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বললেন, ‘আমাদের দেশের অনেক অর্থনীতিবিদ ও জ্ঞানীগুণী পদ্মা সেতু হবে না বলে সমালোচনা করে বিভিন্ন বক্তব্য দিয়েছিলেন। তারা বলেছিলেন- পদ্মা সেতু আওয়ামী লীগের আমলে হবে না, সরকার যদি ভিন্ন অর্থ সংস্থানে পদ্মা সেতু নির্মাণ করতে যায়, তা হলে গুণগত মান ঠিক থাকবে না। যারা সমালোচনা করেছেন, তাদের আত্মবিশ্বাসের অভাব। সমালোচনাকারীদের আজ আমি বলব- পদ্মা সেতুর উদ্বোধন অনুষ্ঠানে আসেন, আমরা আমন্ত্রণ জানাব, জানালাম। পদ্মা সেতু ঘুরে দেখে যান। এই দোতলা সেতুর কাজের মান নিয়ে কেউ প্রশ্ন তুলতে পারবে না। এটি অত্যাধুনিক প্রযুক্তিতে নির্মাণ করা হয়েছে। আমি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের মেয়ে। আমি যেটা পারবো, সেটাই বলবো। যেটা বলবো, করবো। করে দেখাতে পারি, সেটা করেছি। এজন্য দেশবাসীর প্রতি কৃতজ্ঞ’।
পদ্মা সেতু নিয়ে ষড়যন্ত্র প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী আরও বলেছেন, ব্যক্তিস্বার্থে কেউ দেশের এত বড় ক্ষতি করতে পারে তা আমার জানা ছিল না। ব্যাংকের এমডি পদের লোভে একজন ব্যক্তি বিশ্বব্যাংকের অর্থায়ন আটকে দেন। তার সঙ্গে আরও কিছু ব্যক্তি সহায়তা করেছেন। তাদের ষড়যন্ত্রে ও মিথ্যা তথ্যে বিশ্বব্যাংক একটা পর্যায়ে পদ্মা সেতু প্রকল্প থেকে সরে যায়। ব্যাংকের একটা এমডি পদ এতটা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠে ওই ব্যক্তির কাছে। পদটা চলে যাওয়ায় তিনি দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র শুরু করলেন।
পদ্মা সেতু ইস্যুতে বিশ্বব্যাংক বা বিরোধিতাকারীরা দুঃখ প্রকাশ করেছে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘আমার কথা হলো, নিজের ভাড় ভাল না, গোয়ালার ঘির দোষ দিয়ে লাভ কী? বিশ্বব্যাংককে আমি কী দোষ দেব। তারা অর্থায়ন বন্ধ করল কাদের প্ররোচনায়। সেটা তো আমাদের দেশেরই কিছু মানুষের প্ররোচনায় তারা বন্ধ করেছিল। এটাই তো বাস্তবতা। আর যারা বিভিন্ন কথা বলেছেন, তাদের কিছু কথা আমি উঠালাম। কথা আরও আছে। সেখানে আমার তো কিছু বলার দরকার নেই। এটা তারা নিজেরাই বুঝতে পারবে, যদি তাদের অনুশোচনা থাকে। আর না থাকলে আমার কিছু বলার নেই। আমার কারও বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ নেই। বিশ্বব্যাংক সরে যাওয়ার পর আমি সংসদে দাঁড়িয়ে বলেছিলাম যে, দেশের টাকায় পদ্মা সেতু হবে। সব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে আজ পদ্মা সেতু দৃশ্যমান। পদ্মা সেতু আমাদের অহংকার, আমাদের গর্ব’।
নিজস্ব অর্থায়নে নির্মিত পদ্মা সেতু নিয়ে বাংলাদেশের সাহসের প্রশংসা করেছেন ঢাকায় নিযুক্ত ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) রাষ্ট্রদূত চার্লস হোয়াইটলি, অস্ট্রেলিয়ার হাইকমিশনার জেরমি ব্রুয়ার, দক্ষিণ কোরিয়ার রাষ্ট্রদূত লি জান কুউন, ইতালির রাষ্ট্রদূত এনরিকো নুনজিয়াতা, সৌদি রাষ্ট্রদূত ঈসা বিন ইউসুফ আল দুহাইলান, চীনের রাষ্ট্রদূত লি জিমিং, জাপানের রাষ্ট্রদূত ইতো নাওকো, ভারতীয় হাইকমিশনার বিক্রম কে দোরাইস্বামী প্রমুখ। তারা বলছেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দূরদৃষ্টি এবং রাজনৈতিক বিচক্ষণতার কারণে প্রথম পদ্মা সেতু নির্মিত হয়েছে।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, পদ্মা সেতুর প্রাথমিক প্রভাব পড়বে দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের কৃষি খাতে আর দীর্ঘমেয়াদী সুফল আসলে ভারী শিল্পখাতে। মোংলা বন্দর সচল হয়েছে। কাজ শুরু হয়েছে পায়রা বন্দরে। বড় গতিশীলতা আসবে কৃষিভিত্তিক অর্থনীতিতে। খুলনা ও বাগেরহাটের মাছ, যশোরের সবজি ও ফুল, বরিশালের ধান ও পান পুরো দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের কৃষি অর্থনীতির ভিত্তি। সেতুর কারণে সব ধরনের কৃষিপণ্য তাদের সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত বাজারে দ্রুত যেতে পারবে। শুধু ঢাকা নয়, বড় বড় জেলাশহরগুলোতেও তাদের পণ্য যাওয়ার সুযোগ পাবে।
পদ্মা সেতুর কারণে লাভবান হবে খুলনা বিভাগের খুলনা, বাগেরহাট, যশোর, সাতক্ষীরা, নড়াইল, কুষ্টিয়া, মেহেরপুর, চুয়াডাঙ্গা, ঝিনাইদহ ও মাগুরা। বরিশাল বিভাগের বরিশাল, পিরোজপুর, ভোলা, পটুয়াখালী, বরগুনা ও ঝালকাঠি এবং ঢাকা বিভাগের গোপালগঞ্জ, ফরিদপুর, মাদারীপুর, শরীয়তপুর ও রাজবাড়ী জেলা। দেশের প্রতিষ্ঠিত ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোর ওই অঞ্চলে বিনিয়োগ আরও বাড়িয়েছেন এই পদ্মা সেতুকে সামনে রেখেই।
পদ্মা সেতু প্রকল্পের বিশেষজ্ঞ প্যানেলের সদস্য, পানিসম্পদ ও জলবায়ুবিষয়ক বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. আইনুন নিশাত জানিয়েছেন,‘পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজের সঙ্গে আমি শুরু থেকেই ছিলাম। সেতুর ক্ষেত্রে এমন নকশা ভাবতে হয়েছে, যাতে সেতুর জীবদ্দশায় এর ক্ষতি না হয়। সেতুতে ভার পরিবহন (লোড ট্রান্সফার) হয় দুই স্প্যানের সংযোগস্থলে। সেখানে ১০০ টনের বিয়ারিং ব্যবহার করা হয়েছে। এ ধরনের বিয়ারিং পৃথিবীর কোথাও ব্যবহার হয় না, যা ভূমিকম্প প্রতিরোধক হিসেবে কাজ করবে। যত ধরনের দুর্যোগ হতে পারে, সেসব মাথায় রেখেই আমরা সেতুটি নির্মাণ করেছি। ঘূর্ণিঝড়ের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলা করার মতো সক্ষমতা অক্ষুণ্ন রেখেই এটি তৈরি করা হয়েছে। ’
তাঁর মতে, বিশ্বব্যাংক এই প্রকল্পে যে বিরোধিতা করেছে, তার পেছনে রাজনৈতিক কারণ ছিল। পদ্মা সেতু নির্মাণ বাংলাদেশের পক্ষ থেকে বিশ্বের জন্য একটা বড় রাজনৈতিক মেসেজ। বিশ্বব্যাংক যখন ঋণ দিতে আপত্তি করল, তখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশের ওপর বিশ্বাস রেখে কাজটি এগিয়ে নিয়ে গেছেন। তিনি শর্ত দিয়েছিলেন যে বিশ্বব্যাংক জড়িত থাকলে যে কোয়ালিটি কন্ট্রোল করা হতো, আমাদের তত্ত্বাবধানে নির্মাণকাজে গুণগত মানের ক্ষেত্রে যাতে কোনো ধরনের কম্প্রোমাইজ করা না হয়। তাই অর্জিত হয়েছে।
পদ্মা নদী পাড়ি দিয়ে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ১৯টি জেলায় যাতায়াতে ফেরিঘাটে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হতো। কিন্তু এখন সবকিছুই স্মৃতি হয়ে থাকবে। সেতুটি দিয়ে ঢাকা থেকে মাওয়া হয়ে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলোতে সরাসরি সড়ক যোগাযোগ স্থাপিত হচ্ছে।
২০০৮ সালের নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নির্বাচনি ইশতেহারে পদ্মা সেতু নির্মাণের অঙ্গীকার করা হয়। ২০০১ সালের ৪ জুলাই ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয় পদ্মা সেতুর। সরকার নিজস্ব অর্থায়নে ১৯৯৮-৯৯ সালে সেতুর প্রি-ফিজিবিলিটি সম্পন্ন করে। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পরই ফেব্রুয়ারি মাসে পদ্মা সেতুর জন্য ডিজাইন কনসালট্যান্ট নিয়োগ করে। কনসালট্যান্ট সেপ্টেম্বর ২০১০-এ প্রাথমিক ডিজাইন সম্পন্ন করে এবং সেতু বিভাগ প্রিকোয়ালিফিকেশন দরপত্র আহবান করে। মাঝখানের সময়টাতে জটিলতা কাটিয়ে সেতুটি এখন দৃশ্যমান, হয়ে উঠেছে সক্ষমতা-মর্যাদার প্রতীক।
বাংলাদেশ সময়: ১৩৩০ ঘণ্টা, জুন ২৪, ২০২২
টিসি