সাগর-রুনীর হত্যাকান্ড সম্পর্কে বক্তব্য দেওয়ার ক্ষেত্রে আইনের শাসন ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার বিষয়টি বিবেচনায় নিতে নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী ও জাহাঙ্গীর হোসেন সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ সম্প্রতি এক রুল জারি করার সময় এ কথা বলেছেন।
উচ্চ আদালত তার সন্তুষ্টি প্রকাশ করে আদেশে বলেছেন,সরকার সব ধরনের ব্যবস্থা নিয়েছে। একাধিক তদন্ত সংস্থা ওই ঘটনায় পুরো সত্য বের করে আনতে কাজ করছে। প্রধানমন্ত্রী ঘটনাটি তদারকি করছেন কিন্তু দুঃখের সঙ্গে আদালত লক্ষ্য করেছেন যে কিছুসংখ্যক রাজনীতিবিদ তদন্ত কাজ বাধাগ্রস্ত করতে ও নিজেদের স্বার্থ হাসিলের জন্য দায়িত্বজ্ঞানহীনভাবে মন্তব্য করছেন। তথ্য সচিব ও পুলিশের প্রতি এক নির্দেশে এ তদন্তে সুনির্দিষ্ট অগ্রগতি ছাড়া প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়াকে কোনো বক্তব্য না দেয়ার কথা বলেছেন আদালত। এ হত্যাকান্ড নিয়ে ‘মনগড়া সংবাদ প্রকাশ’ না করতে এবং এ রুল জারির ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ব্যবস্থা নিতে তথ্য সচিবকে উল্লেখিত নির্দেশটি কার্য্কর করতে বলা হয়েছে। এ নিয়ে আমাদের সাংবাদিক নেতৃবৃন্দ তাদের তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন।
বিএফইউজের এক অংশের সভাপতি ইকবাল সোবহান চৌধুরী ও অপর অংশের সভাপতি রুহুল আমিন গাজী, বিএফইউজের এক অংশের মহাসচিব আবদুল জলিল ভূঁইয়া ও অপর অংশের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব এম আবদুল্লাহ, ডিইউজের এক অংশের সভাপতি ওমর ফারুক ও অপর অংশের সভাপতি আবদুস শহিদ, ডিইউজের এক অংশের সাধারণ সম্পাদক মুহাম্মদ বাকের হোসাইন ও অপর অংশের সাধারণ সম্পাদক শাবান মাহমুদ, জাতীয় প্রেস ক্লাব সভাপতি কামাল উদ্দিন সবুজ ও সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আবদাল আহমদ, ডিআরইউ সভাপতি সাখাওয়াত হোসেন বাদশা ও সাধারণ সম্পাদক সাজ্জাদ আলম খান তপু সংবাদপত্রে এক বিবৃতির মাধ্যমে তা জানান দিয়েছেন।
সাংবাদিকদের মধ্যে এই একাত্মবোধ ও দলীয় রাজনীতির উর্ধ্বে ওঠার উল্লেখযোগ্য এ নজিরটি জনতার বিবেকের আদালতে কড়া নেড়েছে। এছাড়াও জনতার বিবেকে আরো কিছু ঘটনা ও বিষয় প্রশ্নের সৃষ্টি করেছে।
১। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী’র ৪৮ ঘণ্টার মধ্যেই খুনিদের গ্রেপ্তারের নির্দেশটি কার্যতঃ ব্যর্থ হওয়ার পর প্রধানমন্ত্রী এ বিষয়টি দেখছেন বলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যে মন্তব্য করেছেন তা মূলতঃ আত্মঘাতী এবং সরকার ও আওয়ামীলীগের জন্য একটি বিশাল রাজনৈতিক ঝুঁকি।
২। প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যকে উদ্ধৃত করে ‘সরকারের পক্ষে কারো বেডরুম পাহারা দেওয়া সম্ভব নয়’ এ মর্মে একটি খবর প্রকাশ পেয়েছিল, যা ছিলো খুবই সংবেদনশীল। গত ২৩ ফেব্রুয়ারি সিলেট জেলা আওয়ামী লীগের তৃণমূল নেতা-কর্মীদের সঙ্গে মতবিনিময় করতে গিয়ে তিনি এ মন্তব্য করেছিলেন।
৩। দেশে যেকোনো হত্যাকাণ্ড বা অপরাধ সংঘটনের পর খুনি বা অপরাধীদের ধরে এনে আইনে সোপর্দ করা, অপরাধের সঠিক তদন্ত এবং এর প্রভাবমুক্ত বিচারের ব্যবস্থা করা পুলিশের দায়িত্ব। সাগর-রুনী’র হত্যাকান্ড সম্পর্কে পুলিশ তাদের এ দায়িত্ব পালনে উল্লেখযোগ্য কোনও অগ্রগতি ও ফলাফল দেখাতে পারেনি। এ পরিস্থিতিতে দেশের মানুষের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়া খুবই স্বাভাবিক, যা সুরক্ষা সরকারের অবশ্য দায়িত্ব এবং কর্তব্য এবং যার ব্যত্যয় নিয়ে নালিশ করার সুযোগ রয়েছে।
৪। গাজীপুরে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট মিলনায়তনে আয়োজিত এক অনষ্ঠানে আইনমন্ত্রী শফিক আহমেদ (০৪-০৩-২০১২ ) ঘোষণা করেছেন যে, সাগর-রুনী’র হত্যাকান্ড সম্পর্কে সংবাদ প্রকাশের বিষয়ে আদালতের নির্দেশনাটি সঠিক।
তিনি বলেছেন, তদন্তের স্বার্থে তদন্ত কর্মকর্তাদের গোপনীয়তা রক্ষা করা উচিত। এ ব্যাপারে আদালতের নির্দেশনার সঙ্গে তথ্য অধিকার আইন সাংঘর্ষিক হয়নি। তার মতে, তথ্যভিত্তিক সংবাদ সব সময় প্রশংসিত হয়। সেখানে কোনো হস্তক্ষেপ চলবে না। এ দু’টি খুনের যাতে সঠিক তদন্ত হয় এবং সত্যিকারের খুনিরা বের হয়ে আসে, সে জন্য তথ্যভিত্তিক কোনো সংবাদ না হলে যেন তা পরিবেশন করা না হয়। সে জন্য আদালত ওই নির্দেশনা দিয়েছেন।
৫। খুনিদের গ্রেফতারে পুলিশের ব্যর্থতা সম্পর্কে আদালতের যে পর্যবেক্ষণ ‘হত্যাকান্ড তদন্তে ভুল বা অবহেলা দেখা যায়নি বরং কিছুসংখ্যক রাজনীতিক তদন্তকে বাধাগ্রস্ত করতে দায়িত্বজ্ঞানহীন মন্তব্য করছেন’। কিন্তু বিষয়টি মানুষের মনে প্রশ্ন তুলেছে- এখনো খুনের আলামত সংগ্রহে অসমর্থ্ পুলিশ ও আসামীদের গ্রেফতারে ব্যর্থ পুলিশ কি সত্যি আদালতের এ প্রসংশা ও কৃতিত্বের দাবিদার?
৬। নিরপেক্ষ বিচার ব্যবস্থা নিয়ে সাংবাদিকসহ সচেতন মানুষ অত্যন্ত সতর্কভাবে উচ্চ আদালতের সাম্প্রতিক কতগুলো রিটের সাহসী নিষ্পত্তি পর্যবেক্ষণ করেছে এবং এর জোরালো প্রশংসা করছে। কিন্তু সাগর-রুনী’র হত্যাকান্ড সম্পর্কে ও এ তদন্তকে বাধাগ্রস্ত করতে দায়িত্বজ্ঞানহীন বক্তব্য দেয়ার শুরু থেকে শেষ অবধি মূল্যায়ন করতে উচ্চ আদালত কি সত্যি ব্যর্থ হয়েছে?
বাস্তবে দুর্বৃত্তায়নের রাজনীতি থেকে যখন আমরা বের হবার নিরলস প্রচেষ্টা চালাচ্ছি তখনই এ আদেশ আমাদের দায়িত্বশীল স্বাধীন পেশার পায়ে শিকল পরিয়ে দিয়েছে। একটি কুচক্রী মহল বাংলাদেশ প্রেস কাউন্সিলকে মূলতঃ একটি কাগুজে প্রতিষ্ঠানে পরিণত করেছে। আইনের প্রতি পূর্ণ শ্রদ্ধা রেখেই এরশাদের সামরিক শাসনের সময় একটি সামরিক কোর্টের ব্যর্থতা নিয়ে লিখেছিলাম- ‘সামরিক কোর্টের আদেশ অমান্য, বিচার চাহিয়া আল্লাহর কাছে টেলিগ্রাম’। তৎসময়ে তথ্যপ্রমাণ দিয়ে একজন জজের বিরুদ্ধে একটি বায়োনিক মামলার রায় লেখা ও অভিযোগ প্রতিষ্ঠিত করেছিলাম। তথ্যপ্রমাণসহ বক্তব্য দেওয়া গেলে আদালত সাংবাদিক ও সংবাদপত্রের বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থাই নিতে পারবেন না। সর্বোপরি সাংবাদিকদের মধ্যে থাকতে হবে ইস্পাত কঠিন ঐক্য। তাহলেই সাগর-রুনীর হত্যাকান্ডসহ সকল হত্যাকাণ্ড ও অপরাধের বিচার হবে।
লেখক: কানাডাপ্রবাসী সাংবাদিক ও হিউমান রাইটস অ্যাডভোকেট
বাংলাদেশ সময়: ২০০৪ ঘণ্টা, ০৬ মার্চ, ২০১২