আমার প্রতিবেশী সালাম সাহেব। সম্পর্কে আমার কাকা।
সত্যিকারের, এ রকম বাস্তব চিত্র প্রতিবছর পবিত্র ঈদুল আজহা দেখা যায়। কারণ এসময় পশু কেনা হলেও তা যাচাই-বাছাই করার পারদর্শিতা থাকে হাতে গোনা কিছু মানুষের। এ সুযোগে কিছু অসাধু ব্যবসায়ী অল্পদিনের মধ্যে গরু মোটাতাজা করতে গো-খাদ্যের সঙ্গে বিভিন্ন ধরনের ট্যাবলেট ব্যবহার করে। মাংসপেশিতে প্রয়োগ করে নিষিদ্ধ ইনজেকশন, যা গরু ও জনস্বাস্থ্য উভয়ের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর।
মূলত আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য পশু কোরবানি করি আমরা। পশু তালিকায় গরু, মহিষ, ছাগল, ভেড়া ও খাসি রয়েছে। এর বাইরে সামর্থ্যবানদের অনেকে উট এবং দুম্বা দিয়েও থাকে। এ ক্ষেত্রে অবশ্যই কোরবানি পশুটা সুস্থ-সবল হওয়া চাই, যা ধর্মীয় বিধান আছে। তাইতো কোরবানির জন্য যে পশুটি আমরা কিনছি, সেটা কি সুস্থ ও নিরাপদ কিনা, তার মাংস খাওয়া নিরাপদ হবে কিনা- এসব বিষয়ে আমাদের ভাবতে হবে। যদিও বছরের একবার আমরা গরু কিনে থাকি। তাই পশু নির্বাচনের কিছু মৌলিক বিষয় আমাদের জানা থাকলে নির্বাচনের ভুল-ভ্রান্তি কম হবে এবং একটি উৎকৃষ্টমানের পশু ক্রয় করা সম্ভব হবে।
গরু হাটে গিয়ে প্রথমে দেখতে হবে গরু কান, লেজ নাড়ছে কি না। চোখ উজ্জ্বল ও তুলনামূলক বড় আকৃতির কি না। অবসরে পান চিবানোর মতো সব সময় জাবর কাটছে কি না। আর গরু গায়ে হাত দিলে চামড়াতে একটু কাঁপুনি দিয়ে মাছি তাড়ানোর মতো করে লেজ নাড়াচ্ছে কি না। বিরক্ত করলে প্রতিক্রিয়া দেখাবে, সহজেই রেগে যাবে। গোবর স্বাভাবিক থাকবে, পাতলা পায়খানার মতো হবে না। নাকের নিচে লোমবিহীন অংশে (মাজল) ভেজা ভাব থাকবে। এছাড়া গরুর মুখের সামনে খাবার ধরলে যদি সঙ্গে সঙ্গে জিহ্বা দিয়ে টেনে নেয় তাহলেও বোঝা যায় গরুটি সুস্থ কারণ অসুস্থ পশু খাবার খেতে চায় না।
অপরদিকে ওষুধ দেওয়া গরুর গা ‘পানি নামা’ রোগীর শরীরের মতো ফুলে থাকে। এই গরুর গায়ে আঙুল দিয়ে চাপ দিলে ওই স্থানের মাংস দেবে যায় এবং আগের অবস্থায় ফিরে আসতে অনেক সময় লাগে। কিন্তু প্রাকৃতিকভাবে মোটা করা পশুর গায়ে চাপ দিলে মাংস খুব বেশি দেবে যাবে না এবং যতটুকু দেবে যাবে, তা সঙ্গে সঙ্গে আগের অবস্থায় চলে আসবে। এসব গরু অসুস্থতার কারণে সব সময় নীরব থাকে। ঠিকমতো চলাফেরা করতে পারে না। খাবারও খেতে চায় না। এসব পশু কেনা থেকে বিরত থাকতে হবে। মুখে ক্ষত থাকলে, খাদ্যের বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হলে মুখ দিয়ে লালা পড়ে, মাথা নিচের দিকে রেখে ঝিমায় এবং কান নিচের দিকে ঝুলে থাকে।
তবে সব গরুই অবৈধভাবে মোটাতাজা করা নয়। গরু মোটাতাজা করার বৈজ্ঞানিক ও বৈধ পদ্ধতিও আছে। তা হচ্ছে ‘ইউরিয়া মোলাসেস’ পদ্ধতি। এ পদ্ধতিতে গরু প্রাকৃতিকভাবেই মোটাতাজা হয়ে ওঠে। অনেক খামারিই এ পদ্ধতি অবলম্বন করে থাকে। এবার প্রশ্ন হলো গরুকে ট্যাবলেট খাওয়ানো হয়েছে কি না তা নিশ্চিত হবে কিভাবে? এ জন্য গরুর শ্বাস-প্রশ্বাস দেখতে হবে। ট্যাবলেট খাওয়ানো গরুর শ্বাস-প্রশ্বাস দ্রুত হয়, মনে হয় যেন হাঁপাচ্ছে আর প্রচণ্ড ক্লান্ত দেখাবে এটিকে। রোগাক্রান্ত হলে তার কানের গোঁড়ায় হাত দিয়ে স্পর্শ করলে জ্বরের মতো অস্বাভাবিক গরম অনুভূত হতে পারে।
ট্যাবলেট দেওয়া গরুর গোশত খাওয়ার পর তাৎক্ষণিক কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা না গেলেও ধীরে ধীরে মানুষের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়। ফলে বিভিন্ন প্রাণঘাতী রোগের সৃষ্টি হয়। এসব পশুর গোশতের মাধ্যমে গ্রহণকৃত অতিরিক্ত স্টেরয়েডের প্রভাবে কিডনি ও লিভার নষ্ট হয়ে যায়। এ ছাড়া শিশু অল্প বয়সে মুটিয়ে যায় এবং অনেক ক্ষেত্রে তাদের চির বন্ধ্যাত্ব বরণ করতে হয়। এসব হরমোন এতটাই ক্ষতিকর যে, গোশত রান্না করার পরও তা নষ্ট হয় না। এমনকি তাপে পরিবর্তিত হয়ে জটিল রাসায়নিক পদার্থে পরিণত হয়ে স্বাস্থ্যের জন্য আরও মারাত্মক ক্ষতির কারণ হতে পারে। তাই গরু-ছাগল কেনার আগে যতটা সম্ভব যাচাই-বাছাই করে নিতে হবে।
মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের তথ্য মতে, এ বছর দেশের আটটি বিভাগের ছয় লাখ ৮১ হাজার ৫৩২টি খামার থেকে ৭৫ লাখ ৯০ হাজার ৬৪২টি গবাদি পশু আসবে। তার মধ্যে ঢাকা থেকে ছয় লাখ ৩৭ হাজার ১৯৬টি, চট্টগ্রাম থেকে ১৫ লাখ ১২ হাজার ১১৪টি, রাজশাহী থেকে ২৭ লাখ ২৮ হাজার ৪৬০টি, খুলনা থেকে আট লাখ ৭৯ হাজার ২৫১টি, বরিশাল থেকে তিন লাখ ৭৪ হাজার ৫৪৩টি, সিলেট থেকে এক লাখ ৬৬ হাজার ৩৫৩টি, রংপুর থেকে ১০ লাখ তিন হাজার ২৮১টি এবং ময়মনসিংহ থেকে আসবে দুই লাখ ৯ হাজার ৩৪৪টি পশু। আর গৃহপালিত গবাদি পশু আসবে ৪৫ লাখ ৩৩ হাজার ৭৪৭টি।
কোরবানির পশুর ক্ষেত্রে বয়স গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। গরুর ক্ষেত্রে বয়স কমপক্ষে দুই বছর হতে হবে। গরুটির দাঁত দেখে বয়স বোঝা যায়। সুস্থ, পূর্ণবয়স্ক গরুর দাঁত দেখে ৫ বছর পর্যন্ত বয়স শনাক্ত করা যায় নিখুঁতভাবে। দুই বছর বয়সী একটি সুস্থ গরুর দুইটি স্থায়ী কর্তন দাঁত থাকে। ৩ বছর বয়সে চারটি, ৪ বছর বয়সে ছয়টি ও ৫ বছর বয়সে পুরো মুখে সর্বমোট আটটি স্থায়ী কর্তন দাঁত থাকে। দাঁতগুলো অক্ষত এবং দেখতে সুন্দর হয়।
ছাগলের ক্ষেত্রে বয়স কমপক্ষে এক বছর হওয়া উচিত। উটের ক্ষেত্রে কমপক্ষে পাঁচ বছর, ভেড়ার ক্ষেত্রে কমপক্ষে এক বছর বয়স হতে হবে। তবে ছয় মাস বয়সী ভেড়া যদি বড়সড় হয়, অর্থাৎ যদি দেখতে এক বছর বয়সের মতো দেখায় তাহলে সেই ভেড়া কোরবানি করা যাবে।
হাট থেকে গরু কিনে বাড়ি নেওয়ার পর বেশির ভাগ গরু একবার বসলে আর দাঁড়াতে চায় না। কোনো কিছু খেতে চায় না। তখন অনেকেই মনে করে, পশুটি অসুস্থ। প্রকৃত অর্থে পশুটি তখন বেশ ক্লান্ত। তাই তাকে বিরক্ত না করে অথবা খাবার খাওয়ানোর জন্য জোর না করে ৮ থেকে ১০ ঘণ্টা বিশ্রাম দিতে হবে। এ সময় পশুর সামনে ঘাস ও পানি রাখা যেতে পারে। নিজের প্রয়োজনে পশু সেটি খাবে। তবে পশু কেনার সময় বিক্রেতার কাছ থেকে পশুর পছন্দের খাবার সম্পর্কে জেনে নেওয়া যেতে পারে। বাড়িতে পশু রাখার জায়গাটি হতে হবে শুকনা। কোরবানির ১২ ঘণ্টা আগে পশুকে শুধু পানি ছাড়া অন্য কোনোই খাদ্য না দেওয়া ভালো।
বর্তমান সরকার পশু উৎপাদনে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়ায় কয়েক বছর গবাদিপশু উৎপাদনে নীরব বিপ্লব ঘটেছে দেশে এবং বাংলাদেশ এখন স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে গরু ও ছাগল উৎপাদনে। অথচ পাঁচ বছর আগেও কোরবানির ঈদে বৈধ-অবৈধ পথে ভারত, নেপাল ও মিয়ানমার থেকে ২০ থেকে ২৫ লাখ গরু আমদানি করে দেশের চাহিদা পূরণ করা হতো। গত এক বছরে কোরবানির পশুর উৎপাদন বেড়েছে প্রায় তিন লাখ। এর মধ্যে গরুর উৎপাদন বেড়েছে ১ লাখ ৮৮ হাজার। আর ছাগল-ভেড়ার উৎপাদন বেড়েছে এক লাখ।
পরিশেষে আমাদের যাদের কোরবানির সামর্থ্য আছে বা কোরবানি দিচ্ছি আমাদের আশপাশে অনেকেই আছে যারা কোরবানি দিতে পারছে না। সবার সঙ্গে ভাগাভাগি করেই হোক আমাদের এই ঈদ আনন্দ। তবেই ঈদের আনন্দ গাঢ় হবে প্রকৃত ত্যাগের সঙ্গে।
লেখক: উপপরিচালক, শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়