দেশ কি গৃহযুদ্ধের দিকে এগুচ্ছে? এমন প্রশ্নের উত্তর কি হতে পারে? আমাদের স্বাধীনতা অর্জনের ৪০ বছর পর প্রশ্নটা সম্প্রতি শঙ্কিত করে তুলেছে সচেতন নাগরিকদের। প্রধান দু’টি রাজনৈতিক দলের সাম্প্রতিক মুখোমুখি অবস্থান এ বিষয়ে ভাবিয়ে তুলেছে দেশের বুদ্ধিজীবীদেরও।
সাম্প্রতিক রাজনীতিতে একটা বিষয় স্পষ্ট হয়ে উঠেছে, বিরোধী দলের যে কোনো কর্মকাণ্ডে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পাশাপাশি সরকার দলীয় ক্যাডাররা সরাসরি বাধা প্রদান করছে কিংবা সরকারি দল পাল্টা কর্মসূচি দিয়ে দেশজুড়ে একটা উত্তপ্ত পরিস্থিতি সৃষ্টি করছে। স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশের ইতিহাসে বিরোধীদের কর্মকাণ্ডে সরকার দলীয়দের এমন সরব প্রতিবন্ধকতা পাওয়া যায়নি।
কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে বিরোধীদলকে দমন করতে বা তাদের আন্দোলন-সংগ্রামকে স্তব্ধ করে দিতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পাশাপাশি সরকার দলীয় বিভিন্ন সংগঠনের ক্যাডারদের সরাসরি ‘অ্যাকশনে’ যেতে দেখা যাচ্ছে। ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার বদৌলতে সারা দেশের মানুষ এ সকল সচিত্র প্রতিবেদন খুব সহজেই অবলোকন করতে পারছে।
১২ মার্চে বিরোধী দল ‘ঢাকা চলো’ কর্মসূচির ডাক দিয়েছে। এ নিয়ে ইতোমধ্যে সকল প্রস্তুতিও সম্পন্ন করেছে দলটি। শেষ মুহূর্তে চলছে তৃণমুল পর্যায়ে গণসংযোগ। বিরোধী দলের কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিতে সরকারের অগণতান্ত্রিক বাধা প্রদানের আশঙ্কা করছেন। বিভিন্ন গণমাধ্যমে এ আশঙ্কায় বক্তব্য-বিবৃতিও দিচ্ছেন। দলের কেন্দ্রীয় হাইকমাণ্ড ইতোমধ্যে বাধা আসলে প্রতিরোধ গড়ে তোলার আহবান জানিয়েছে। ‘যেখানে বাধা- সেখানেই প্রতিরোধ’ এমন বক্তব্য ইতোমধ্যে তৃণমুল পর্যায়েও বেশ জোরেশোরেই ধ্বণিত হচ্ছে।
অপরদিকে কর্মসূচির নামে নাশকতা সৃষ্টির আশঙ্কায় সরকারের দায়িত্বশীল মন্ত্রী-এমপিরা বিরোধীদের দমনে প্রশাসনের পাশাপাশি দলীয় নেতাকর্মীদের অংশগ্রহণ করার আহবান জানিয়েছেন। সরকার দলের পক্ষ থেকেও তৃণমুল নেতাকর্মীদের প্রস্তুত থাকার নির্দেশনা দেয়া হচ্ছে। ঢাকা চলো কর্মসূচি ঠেকাতে সারাদেশে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে সজাগ রাখা হয়েছে।
অধিকার আদায়ে আন্দোলন-সংগ্রাম, সরকারের সমালোচনা, মতামত প্রকাশ নাগরিকের গণতান্ত্রিক অধিকার। দলীয় কর্মীসমর্থকদের প্রতি সরকারের দায়িত্বশীলদের ‘খবর আছে’ ‘বিরোধীদের ঠেকাতে আওয়ামী লীগই যথেষ্ট’ ‘ঢাকায় অপরিচিত লোক দেখলেই ধরিয়ে দিন’ ইত্যাদি জাতীয় নির্দেশ গণতান্ত্রিক অধিকার হরণের সুস্পষ্ট ইঙ্গিত।
রাষ্ট্রের প্রতি নাগরিকদের অনেক দায়িত্ব কর্তব্য রয়েছে। কিন্তু নাগরিকের প্রতি নাগরিককে লেলিয়ে দেয়া কোনেওক্রমেই সরকারের কাজ হতে পারে না। সরকারি দল ও বিরোধী দল উভয় দলের নেতাকর্মী-সমর্থকরা এদেশেরই নাগরিক। দেশের নাগরিকগণ সবাই একই আদর্শে বিশ্বাসী নাও হতে পারে। ভিন্ন আদর্শে বিশ্বাসীরা তাদের আদর্শের স্বপক্ষে দাবি উত্থাপন করতেই পারে। অধিকার আদায়ে রাজপথে আন্দোলন করারও অধিকার রাখে তারা।
আর আন্দোলন সংগ্রামের সুবাদে যদি নাশকতার কোনো আশঙ্কা থেকেই থাকে তবে তা দেখার জন্য আমাদের রয়েছে প্রশিক্ষিত সুগঠিত আনসার, পুলিশ, র্যাবসহ বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থা। এসব শক্তিশালী বাহিনী থাকতে নাশকতা ঠেকাতে দলীয় বাহিনীকে মাঠে থাকার আহবান কতটা বিবেচনাপ্রসূত তা আজ দেশের সচেতন জনগোষ্ঠীকে ভাবিয়ে তুলছে।
বিরোধীদের প্রতিরোধ গড়ে তোলা আর সরকার দলীয়দের প্রতিহত করার ঘোষণায় আপাততঃ একটা ‘যুদ্ধের’ আভাস পাওয়া যাচ্ছে। বিরোধী দলের সুরে দ্রোহ আর সরকার দলের সুরে অনেকটাই হিন্দি ফিল্মের মতো দাদাগিরিভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে। বিরোধীদের বক্তব্যে শিহরিত-আন্দোলিত হচ্ছে দলীয় নেতাকর্মী-সমর্থকরা, সরকার দলীয় নেতাদের বক্তব্যে বিরোধীদলকে প্রতিহত করতে তৈরি হচ্ছে দলীয় নেতাকর্মী-সমর্থকরা।
সবমিলিয়ে ১২ মার্চ নিয়ে শুরু হয়েছে যুদ্ধ যুদ্ধ খেলার প্রস্তুতি। একটা লঙ্কাকাণ্ড ঘটে যেতে পারে যদি এখনই উভয়দল সংযত না হয়। আর তেমন কিছু যদি ঘটেই যায় তখন সব দায় বর্তাতে পারে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ঘাড়ে।
প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের মুখোমুখি অবস্থানের ঘোষণায় সারাদেশ ১২ মার্চকে ঘিরে উত্তেজনায় ভাসছে। বিরোধীদলের ঘোষণা অনুয়ায়ী যদি সত্যিই যেখানে বাধা-সেখানেই প্রতিরোধ গড়ে তোলা হয়, আবার সরকার দলের ঘোষাণানুযায়ী যদি সত্যিই প্রতিহত করার চেষ্টা করা হয় তবে সংঘর্ষ সারাদেশে ছড়িয়ে যেতে পারে- এমন আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
বিগত কয়েক দিনে শাসক দলীয় মন্ত্রী-এমপিদের বক্তব্য মোটেই সুবিবেচনাপ্রসূত বলে মনে হচ্ছে না। একে অনভিজ্ঞতার ফসলও বলা যায়। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে বিরোধীদের আন্দোলন সংগ্রামের কর্মসূচি থাকতেই পারে। আর এ গুলোকে শক্তি খাটিয়ে নয়, বরং রাজনৈতিক এবং প্রশাসনিকভাবে মোকাবেলা করাটাই সর্বোত্তম পন্থা।
বর্তমান সরকারের কাছে মানুষের প্রত্যাশা ছিলো অনেক। কিন্তু কখনোই দাদাগিরিসুলভ আচরণ প্রত্যাশা করেনি। সংকট উত্তরণে সরকারের দায়িত্বশীল মন্ত্রী-এমপিদের বেফাঁস বক্তব্য বন্ধ করে দায়িত্বশীল বক্তব্য ও আচরণ আশা করে জনগণ। এমনিতেই সমসাময়িক বৈশ্বিক পরিস্থিতি আর মিত্রদের বিরূপ আচরণে একটা সংকটময় সময় পার করছে দেশ। এ অবস্থায় নতুন করে সংকট সৃষ্টি কারো কাম্য নয়।
নাট্যকার এসএম সুলায়মানের ইঙ্গিত নাটকের একটি সংলাপ দিয়ে শেষ করতে চাই। ‘....স্লিপ অব টাং, আরে মশায়, যে দেশে ঠ্যাং দুটো অনবরত স্লিপ করছে সে দেশে জিহ্বা ব্যালেন্স করবো কিভাবে! আবার ব্যালেন্স না করলেও বিপদ...’। সরকারের দায়িত্বশীলদের প্রতি আমাদেরও দাবি, ...ব্যালেন্স করুন। নইলে হয়তো ফখরুল ইসলাম আলমগীরের বক্তব্য ‘শেষে সামাল দিতে পারবেন না’ সত্য হয়ে যেতে পারে।
খায়রুল আলম বাদল, সংবাদকর্মী, কিশোরগঞ্জ
E-mail:- badal.khairul@gmail.com
বাংলাদেশ সময়: ২১১৪ ঘণ্টা, ০৭ মার্চ, ২০১২