জলিলের ট্রাম কার্ডের কথা কেউ হয়তো ভুলে যাননি। সেই সময়ে জলিলের ট্রাম কার্ড নিয়ে এপ্রিলের ৩০ তারিখ পার হওয়ার আগ পর্যন্ত সারা দেশ জুড়ে ছিল টানটান উত্তেজনা।
কিছুদিন বিরতির পরে আল্টিমেটামের খেলা আবারো শুরু হয়েছে। শুধু পার্থক্য জার্সি বদল। ততকালীন সরকারী দল আজ বিরোধী অবস্থানে, বিরোধী দল সরকারী দলে। খেলার মাঠও সেই ঢাকা। আয়োজনে যার যার অবস্থান থেকে উভয় দলের প্রতিক্রিয়াও আগের মতোই। তবে সব কিছুতে চমক লাগানোর মতো এবারও আওয়ামী লীগ থাকার হোটেল এবং খাবার হোটেল বন্ধ করে বিরোধী দলের আন্দোলন নিয়ন্ত্রণের নতুন পদ্ধতি দেখিয়েছে। অবশ্য স্বৈরাচারী এরশাদ সরকারের আমলেও এ রকমটি একবার করা হয়েছিল।
আওয়ামী লীগের ট্রাম কার্ডের সময়কাল এবং ‘ঢাকা চলোর’ সময়কাল এবং প্রেক্ষাপট অনেক দিক থেকে ভিন্ন। প্রথমতঃ বিগত এক বছর ধরে সারা বিশ্বে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের একটা মৌসুম যাচ্ছে। জনগণ সার্বিকভাবে অগণতান্ত্রিক সরকারগুলোর বিরুদ্ধে স্বতঃস্ফুর্তভাবে রাস্তায় নেমে এসেছে। শত শত মানুষের আত্মাহুতিতেও পিছিয়ে আসেনি। সেই আন্দোলনের ঢেউ পার্শ্ববর্তী মালদ্বীপেও আছড়ে পড়েছে। দ্বিতীয়তঃ আরব বসন্তের নামে যে আন্দোলনে পুরো আরব বিশ্ব কেঁপে উঠেছে সেখানে ফেইসবুক এবং ব্লগ জন সচেতনায় প্রবল ভূমিকা রেখেছে। এই দুটো প্রেক্ষাপট ‘ঢাকা চলো’কে কতোটুক চলতে সহায়তা করে দেখা যাবে।
এতো সব মিল থাকা সত্ত্বেও অমিলও রয়েছে প্রচুর। আরব বসন্ত নামে মধ্যপ্রাচ্যে যে সকল আন্দোলন হয়েছে, সেখানে নেতৃত্ত্বে ছিল বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সুশীল সমাজ কিংবা সেই সব রাজনীতিক যাদেরকে জনগণ কখনো ক্ষমতায় দেখেনি। কাজেই তাদের সম্পর্কে জনগণের নেতিবাচক ধারণাও তেমন নেই। কিন্তু বাঙলাদেশের বেলায় সেটা ভিন্ন। যারা ‘ঢাকা চলো’ আন্দোলন করছে তাদের শাসনের স্বাদ অতীতে জনগণ বেশ কয়েকবার পেয়েছে। সাধারণ জনগণ সেদিকটা বিবেচনা করে কতোটুকু সম্পৃক্ত হয় বলা যাচ্ছে না। বিগত দিনগুলোতে দেখা গেছে, নিরব থাকা ব্যপক সাধারণ জনগোষ্ঠীকে রাজপথে টানতে না পারা পর্যন্ত কোন আন্দোলনই সফল হয়নি। কাজেই সেই কাজটা বিরোধী দলগুলো কতোটুকু করতে পারে তার সাফল্যের উপরেই নির্ভর করবে ’ঢাকা চলোর’ সফলতা বা ব্যর্থতা। আজকের বিরোধী দল কিংবা সরকারী দলের শাসনকাল নিয়ে জনগণের মোটের উপরে সন্তুষ্ট থাকার কথা নয়। কিন্তু বর্তমানের সাথে নিকট অতীতের তুলনামূলক আলোচনার মাধ্যমে জনগণ হয়তো সিদ্ধান্ত নেবে দুই দলের মধ্যে কাকে বেছে নেবে।
আরব বসন্তের সাথে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ পার্থ্যক্য হলো, ওখানে আন্দোলনের পিছনে পশ্চিমাদের ইন্ধন ছিল। টাকা পয়সাসহ আরো অনেক রকমের সহযোগিতা ছিল। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের নামে পশ্চিমারা আসলে চেয়েছিল তাদের আজ্ঞাবহ কাউকে শাসন ক্ষমতায় দেখতে। তাই সেখানকার জন অসন্তোষকে কাজে লাগিয়ে তারা নিজেদের পক্ষে ‘বাতাস ঘোরানোর’ চেষ্টা করেছে। তবে কোথাও যদি পশ্চিমাদের সাহায্য ছাড়াই বাতাস ঘুরতে থাকে, তবে সেই বাতাস বিপক্ষে যাবার আগেই বাতাস অনুযায়ী ঘুরে যেতেও তাদের সময় লাগবে না। সন্ত্রাসবিরোধী আন্দোলনের নামে সারা বিশ্বকে পশ্চিমারা যেভাবে নিজের কব্জায় রাখতে চাচ্ছে, আমাদের দেশও সেক্ষেত্রে ব্যতিক্রম নয়। জামায়াতকে সংগে রেখে প্রধান বিরোধী দল সেই সমর্থন কিভাবে আদায় করতে পারে দেখার বিষয়। তবে ঐ যে বললাম, নিজ স্বার্থে বাতাস অনুযায়ী ঘুরে যেতেও পশ্চিমাদের সময় লাগবে না। বাঙলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে বাতাস তারাই ঘোরাবে নাকি তারা নিজেরাই বাতাস অনুযায়ী ঘুরে পরিস্থিতিকে নিজেদের অনুকূলে রাখার চেষ্টা করবে সময়ই বলতে পারে সেটা।
একটু আগেই বলেছি ফেসবুক এবং ব্লগের ভূমিকার কথা। ফেসবুক এবং ব্লগ জনসচেতনা তৈরীতে কতোটুকু কার্যকরী ভূমিকা রাখতে পারে বাঙলাদেশে সেটা এখনো পরীক্ষিত নয়। তাছাড়া যে কোন আন্দোলনে যাদের সম্পৃক্ততা থাকে সব চেয়ে বেশি, সেই গরীব এবং মধ্যবিত্ত জনগোষ্ঠীর কতোজনের এই দুইটি অন লাইন মাধ্যমে সম্পৃক্ততা আছে তারও কোনও পরিসংখ্যান নেই। যদিও আজকাল ফেসবুকে এবং ব্লগে আন্দোলনের পক্ষে কেউ কেউ জোরালো প্রচারণা চালানোর চেষ্টা চালাচ্ছেন, কিন্তু সেটার ভূমিকা কতোটুকু কার্যকরী হচ্ছে বোঝা দায়। তাছাড়া বাঙলাদেশের রাজনীতি মানেই হচ্ছে, নেতাদের দৃষ্টিকাড়া। অনেকেই মনে করছেন, ফেইসবুকে প্রচারণা চালানো অনেককেই হয়তো শেষ পর্যন্ত মাঠে দেখা যাবে না। কারণ তাদের যে মূল উদ্দেশ্য নেতৃবৃন্দের নজরকাড়া সেটাতো আন্দোলনের পক্ষে ফেসবুকের ওয়ালে বড় বড় পোস্টিং দিয়ে হয়েই গেছে (নেতাদেরও যথারীতি ট্যাগ করা হয়ে গেছে)। ফেসবুক থেকে লগ আউট করে রাজপথে ছিল কিনা, এতো লোকের ভিড়ে কে যাবে কাকে খুঁজতে।
অন্যদিকে, কেউ কেউ মনে করছেন, আন্দোলনের জন্য যে ক্ষেত্র সেটাতো সরকারী দলই একের পর এক ইস্যু তৈরি করে বিরোধী দলের হাতে তুলে দিয়েছে। বিরোধী দল সেই ইস্যু নিয়ে কতোটা সুন্দরভাবে খেলতে পারে তার উপরে নির্ভর করবে বাদবাকীগুলো। সীমান্তে মানুষ হত্যা আর আমাদের মন্ত্রীদের গণবিরোধী মন্তব্য, সড়ক দুর্ঘটনায় মানুষ মরে অথচ মন্ত্রীদের তাচ্ছিল্যপূর্ণ বিবৃতি, বিভিন্ন সময়ে সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতৃবৃন্দের বিরোধী দল এবং বিরোধী নেতাদের সম্পর্কে তাচ্ছিল্যপূর্ণ এবং কুরুচিপূর্ণ বক্তব্যের সাথে যোগ হয়েছে সাম্প্রতিক সাংবাদিক দম্পতির হত্যাকান্ড-পরবর্তী নানা বেফাঁস মন্তব্য। এর সাথে নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের আকাশছোঁয়া দাম এবং শেয়ারবাজারে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের সর্বস্বান্ত হবার পাশাপাশি পুলিশের নির্যাতন, অপহরণ এবং গুমের মতো একের পর এক ঘটনা সরকার সম্পর্কে জনগণের মনকে বিষিয়ে তুলেছে। সারা দেশটাকে অনেকেই দরজা জানালাহীন একটা ঘরের সঙ্গে তুলনা করছেন। মানুষের যেখানে নাভিশ্বাস!
তবে সব হিসেবকে ছুড়ে ফেলে শেষ পর্যন্ত ১২ই মার্চের সমাবেশ হতে পারে কিনা সেই সন্দেহও অমূলক নয়। কেননা দিন যতোই যাচ্ছে সরকার বিরোধী দল দমনের ক্ষেত্রে নতুন নতুন চমক সৃষ্টি করছে। আমি এর আগে আরেকটি সংবাদপত্রে লিখেছিলাম যে, বিরোধী দলের আন্দোলন দমনের জন্য সরকার নতুন “ছন্দপতন কৌশল” হাতে নিয়েছে। এজন্য তারা অতি সুকৌশলে ধরি-মাছ-না-ছুঁই-পানি টাইপের ভূমিকায় নেমেছে। এর আগেও সেটা ঘটিয়েছে। বিরোধী দলের সাথে একই সময়ে সরকারী দল কর্মসূচি ডেকে দেশকে অস্থিতিশীল পরিবেশের দিকে ঠেলে দেওয়ার চেষ্টা এইতো সেদিনও হয়েছে। পাতানো ও পরিকল্পিত পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি ডেকে, সরকার প্রশাসনকে সুকৌশলে ব্যবহার করেছে। গোলযোগের আশংকার ধুয়া তুলে, উভয় পক্ষের কর্মসূচিকে বাতিল করে প্রকারান্তরে প্রশাসন বিরোধী দলের কর্মসূচিকেই বাধাগ্রস্ত করতে সরকারকে সহায়তা করেছিল।
সরকারী দলের এই ‘ডামি’ কর্মসূচির লক্ষ্য বিরোধী দলের আন্দোলনকে বাধাগ্রস্ত করা। এবারও সেই পথেই হাটছে। গুজব আছে হঠাৎ করেই ১২ তারিখের আগে প্রশাসন গোলযোগ সৃষ্টির ধুয়া তুলে ১২ তারিখের বিরোধী দলের এবং ১৪ তারিখের জোটের মহাসমাবেশ বাতিল করে দিয়ে তথাকথিত নিরপেক্ষ আচরণের মাধ্যমে প্রকারান্তরে বিরোধী দলের আন্দোলনকে বাধাগ্রস্ত করবে। একবার দীর্ঘ সময় ধরে চলমান কোনও প্রস্তুতিতে ভাটা পড়লে আন্দোলনে যে ‘ছন্দ পতন’ ঘটে পরবর্তী সময়ে সেই একই কাজের জন্য শত চেষ্টা থাকলেও যুৎসই গতি পাওয়া যায় না।
তবে এখনো পর্যন্ত ১২ তারিখ নিয়ে প্রশাসন, সরকারী দল এবং বিরোধী দলের মধ্যে সাজ সাজ রব চলছে। যে যার অবস্থান থেকে আওয়াজ তুলছে। কোন আওয়াজটা যে আসল আর কোনটা যে ‘জলিলকন্ঠ’ (অর্থাৎ ভুয়া আওয়াজ) সেটা ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। আসলেই ১২ তারিখে কি হতে যাচ্ছে সেটা বিরোধী দলগুলোর শীর্ষ নেতৃত্বও ঠিকমতো জানেন কিনা বলা যায় না। তাদের অবশ্যই নিজস্ব কিছু নির্দিষ্ট পরিকল্পনা আছে। কিন্তু বর্তমানে বিভিন্ন কারণে রাজনীতি যে পরিমাণে জটিলতা লাভ করেছে, তাতে এতো লোকের সমাগমকে কে কিভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে চায় সেটার উপরেই নির্ভর করবে সম্ভবতঃ এই বিপুল সমাবেশের ভবিষ্যত। সরকারের আচরণও খানিকটা প্রভাব ফেলবে এর উপরে। যদি বিরোধী দল যথেষ্ট পরিমাণে লোক ঢাকায় জড়ো করতে পারে এবং সরকার সেখানে জোর জবরদস্তি খাটায়, তাহলে গণ বিক্ষোভ কোনদিকে বাক নেয় সময়ই শুধু সেটা বলে দেবে।
বিএনপির বড় নেতাদের সবাই যদিও বারবার বলে আসছেন যে, সরকার বাধা না দিলে তেমন কিছু হবে না। তারা শান্তিপূর্ণ রোডমার্চের উদাহরণ টানছেন। সরকারকে তত্ত্ববধায়ক সরকার বহাল করার আল্টিমেটাম দিয়ে রাজপথ ছেড়ে দেওয়া হবে। কাজেই, উল্লেখযোগ্য সংখ্যক নেতা কর্মীদের বিরোধী দল ঢাকায় সমাবেত করতে পারলেই তারা মান রক্ষার ঢাকা চলো কর্মসূচিতে উত্তীর্ণ হতে পারবে। কিন্তু সেটা করতে না পারলে কিংবা লোক জড়ো করেও আইন শৃঙ্খলা বাহিনী এবং সরকারী দলের কর্মীদের প্রতিরোধে লেজ গুটিয়ে রণে ভঙ্গ দিলে এতোদিনের সব অর্জন ভেস্তে যাবে।
অন্যদিকে, বিরোধী দলের সফলতা সরকারী দলকে যথেষ্ট চাপের মধ্যে ফেলে দেবে সেটা সরল অঙ্কের চেয়েও সোজা। এই দুয়ের মাঝে মাঝামাঝি কোনও পথ খুঁজে পাওয়া না গেলে আগামীতে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গন আমি না বললেও সবাই বুঝতে পারছেন যে, ভয়াবহ সংঘাতপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে।
১২ তারিখের ‘ঢাকা চলো’ কর্মসূচি নিয়ে বিএনপি অনেক প্রচারণা এবং কর্মীদের অনেক আশা দেখিয়েছে। ঢাকাবাসীসহ পুরো দেশবাসী আগ্রহ নিয়ে চেয়ে আছে কি ঘটে সেদিন ঢাকায় সেটা দেখার জন্য। সরকারী দলের পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি এবং প্রশাসনের বাড়াবাড়ি বাড়তি হিসেবে আতঙ্ক যোগ করেছে। সব কিছু মিলিয়ে বিরোধী দল এখন ট্রামকার্ডের সেই ‘জলিল পয়েন্টে’ অবস্থান করছে। জলিলের কপালে হাস্যরস জুটলেও আজকের বিরোধী দলের জন্য কি অপেক্ষা করে আছে সেটা জানতে আরো কয়েকটা দিন অপেক্ষা করতে হবে দেশবাসীকে। তবে সেই অপেক্ষা বড়ই আতঙ্কের। দুই হাতীর নর্তন কুর্দনে মুরগীর মতো ক্ষুদ্র জনগণের প্রাণ ওষ্ঠাগত!
সেই চুটকিটার কথা মনে আছে আপনাদের! একবার কোনও এক মসজিদে নামাজ পড়তে গিয়ে এক ব্যক্তির নতুন জুতো চোরে নিয়ে যায়। নামাজ শেষে সে তো মহা চিৎকার, চেঁচামেচি। রাগে ভয়ানক ফুঁসতে ফুঁসতে ব্যক্তিটি উপস্থিত সবাইকে সাবধান করে দিয়ে বলেন, মাত্র ১০ মিনিট, ১০ মিনিট সময় দিলাম। এর মধ্যে আপনারা জুতোটা জোগাড় করে দেবেন। না পারলে খবর আছে।
সেবার চাটগাঁয়ে যেটা ঘটিয়ে ছিলাম, এবারও সেটা এখানে ঘটাবো। আমার নাম রুস্তম, রুস্তম শেখ।
হুংকার শুনে মুসুল্লি কেন, সারা পাড়া ভয়ে তটস্থ। কে এই রুস্তম? সেই বীর সোহরাব রুস্তমের রুস্তম নয়তো! সবাই খুব তোড়জোড় করে ভয়ে তাকে জুতোটা খুঁজে দিল।
এরপর হঠাৎ করে এক চ্যাঙড়া ছেলে জিজ্ঞেস করে বসল, ভাই বেয়াদবি নিবেন না। সেবার চাটগাঁয়ে জুতো না পেয়ে কি করেছিলেন?
এদিক ওদিক তাকিয়ে মাথা নিচু করে রুস্তম শেখ বলে, কী আর করা! লজ্জায় মাথা হেঁট করে খালি পায়ে হেঁটে বাড়ি চলে গিয়েছিলাম।
mahalom72@yahoo.com
বাংলাদেশ সময় ১৪৩১ ঘণ্টা, মার্চ ০৮, ২০১২