বৃহত্তর খুলনার উচ্চশিক্ষার প্রথম বাতিঘর, দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সর্ববৃহৎ বিদ্যাপীঠ সরকারি ব্রজলাল কলেজ (বি,এল কলেজ) এর ১২০তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী আজ মঙ্গলবার।
খুলনা মহানগরী থেকে আট কিলোমিটার দূরে দৌলতপুরের ভৈরব নদের তীরে অবস্থিত এ কলেজটি ১৯০২ সালের ২৭ জুলাই কলকাতার হিন্দু কলেজের আদলে ‘হিন্দু অ্যাকাডেমি’ নামে এটি প্রতিষ্ঠিত হয়।
কলেজের প্রতিষ্ঠাতা বৃহত্তর খুলনার বাগেরহাটের বাউডাঙ্গার জমিদার ও তৎকালীন কলকাতা হাইকোর্টের আইনজীবী ব্রজলাল চক্রবর্তী (শাস্ত্রী)। তিনি ছিলেন সংস্কৃত, ইংরেজি সাহিত্য ও আইনে লেখাপড়া জানা মানুষ। এই বিদ্যানুরাগীর ঐকান্তিক প্রচেষ্টা এবং খুলনাসহ বিভিন্ন স্থানের মানুষের আর্থিক সহায়তা ও সমর্থনে কলেজটি প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয়েছিল।
১৯০২ সালের ৩ জুলাই কলেজের দাপ্তরিক কার্যক্রম শুরু হলেও পাঠদান শুরু হয় ২৭ জুলাই। শুরুতে প্রতিষ্ঠানটির নাম ছিল ‘হিন্দু অ্যাকাডেমি’। ১৯০৩ সালে চতুষ্পাঠী এবং ১৯০৭ সালে বি-গ্রেডের কলেজ হিসেবে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন লাভ করে। পরে চতুষ্পাঠী বন্ধ হয়ে গেলে শুধু কলেজের কার্যক্রম চলতে থাকে। প্রাথমিক পর্যায়ে ৪৯ জন ছাত্র নিয়ে এফএ (ফার্স্ট আর্টস) ক্লাস শুরু হয়। আবাসিক কলেজ হিসেবে এর যাত্রা শুরু হয়েছিল এবং এটি ছিল অবিভক্ত বঙ্গদেশের প্রথম আবাসিক কলেজ। তখন শিক্ষকের সংখ্যা ছিল অধ্যক্ষসহ চারজন। প্রথম সাত বছর এখানে শুধুমাত্র উচ্চবর্ণহিন্দু ছাত্ররা লেখাপড়ার সুযোগ পেয়েছে। শুরুতে এই হিন্দু অ্যাকাডেমিতে মুসলিম ও নিম্নবর্ণের হিন্দুদের ভর্তি হওয়ার সুযোগ ছিল না।
দৌলতপুর হিন্দু একাডেমি প্রতিষ্ঠার সময় এর জমির পরিমাণ ছিল মাত্র দুই একর। কিন্তু শিক্ষায়তনটি গড়ে তোলার ক্ষেত্রে যে পরিকল্পনা ছিল তার জন্য দুই একর জমি যথেষ্ট ছিল না। ভৈরব নদীর তীরবর্তী যে এলাকায় হিন্দু অ্যাকাডেমি গড়ে তোলা হয়েছিল তার সংলগ্ন বিশাল এলাকা ছিল দানবীর হাজী মুহম্মদ মুহসিন কর্তৃক দানকৃত সৈয়দপুর এস্টেটের ওয়াক্ফ ভূসম্পত্তি। কিন্তু কেবলমাত্র উচ্চবর্ণের হিন্দু অ্যাকাডেমির জন্য ওই সম্পত্তি দানের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয়।
১৯০৬ সালে সার্বজনীন শিক্ষার দাবিতে এই কলেজে লেখাপড়ার জন্য সকল সম্প্রদায়ের ভর্তি উন্মুক্ত করার সিদ্ধান্ত হয়। ১৯০৯ সালে এই কলেজে নিম্নবর্ণের হিন্দু ও মুসলিম ছাত্ররা ভর্তির সুযোগ পায় এবং ওই বছর আইএসসি কোর্স খোলার অনুমতি দেয় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়। তৎকালীন বৃটিশ ভারতে যুক্ত বাংলার এম এল এ, মন্ত্রী ও পার্লামেন্টের স্পিকার নড়াইল জেলার মির্জাপুর নিবাসী সৈয়দ নওশের আলী ও খুলনার আটরার মো. একরাম উদ্দিন প্রথম মুসলিম ছাত্র যারা এ কলেজে ভর্তি হন।
এরপর ১৯১২ সালে সৈয়দপুর স্টেটের তত্ত্বাবধায়ক খুলনা জেলা কালেক্টরেটের মাধ্যমে 'দানবীর হাজী মহম্মদ মহসীন ট্রাস্ট' তার ৪০ একর জমি এই প্রতিষ্ঠানে দান এবং মাসিক ৫০ টাকা অনুদান বরাদ্দ করা হয়। সেই থেকে এর পরিসর বৃদ্ধি পেতে থাকে।
১৯১৪ সালে দৌলতপুর হিন্দু একাডেমি প্রথম শ্রেণির কলেজ হিসেবে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যালেন্ডারে স্থান পায়। ক্রমান্বয়ে কলেজে শিক্ষার্থী বৃদ্ধি পায় এবং বিভিন্ন কোর্স চালু হতে থাকে। ১৯১৪ সালে বিএ ও বিএসসি পাস কোর্স খোলার অনুমতি পাওয়া যায়। ১৯২৫ সালে এই কলেজে ইংরেজি, দর্শন ও গণিত বিষয়ে অনার্স কোর্স চালু হয়।
১৯৪৪ সালের ৮ আগস্ট ব্রজলাল শাস্ত্রী মারা যান। ১৯৪৬ সালে তাঁর নামানুসারে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নাম হয় ব্রজলাল হিন্দু অ্যাকাডেমি। এরপর ১৯৫১ সালে হিন্দু ও অ্যাকাডেমি শব্দ দুটি বাদ দিয়ে প্রতিষ্ঠানটির নতুন নামকরণ করা হয় ব্রজলাল কলেজ বা সংক্ষেপে বি এল কলেজ।
কলেজ প্রতিষ্ঠার পরপরই অধ্যাপক সতীশ চন্দ্র মিত্রের আন্তরিক প্রচেষ্টায় কলেজে গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠিত হয়। তিনি নানা জায়গা থেকে বহু গুরুত্বপূর্ণ দুষ্প্রাপ্য গ্রন্থ, জার্নাল, পত্রপত্রিকা সংগ্রহ করে গ্রন্থাগারটি সমৃদ্ধ করেছিলেন। এছাড়া গ্রন্থাগারের এক কোণে তিনি একটি ছোট জাদুঘর গড়ে তুলেছিলেন। সেখানে বহু পুরোনো পাণ্ডুলিপি, ধাতব মুদ্রা, পাথরের মূর্তি ও নানাবিধ মূল্যবান প্রত্নবস্তু সংরক্ষিত ছিল। ১৯৩১ সাল পর্যন্ত আমৃত্যু তিনি শিক্ষকতার পাশাপাশি এই গ্রন্থাগারের দায়িত্ব পালন করে গেছেন। বর্তমানে বিএল কলেজের লাইব্রেরি একটি সমৃদ্ধ লাইব্রেরি হিসেবে পরিচিত।
১৯৩৮ সালে এই কলেজে প্রথম ছাত্র সংসদ গঠিত হয়। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন, ভাষা আন্দোলন, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধসহ বিভিন্ন গণতান্ত্রিক আন্দোলন-সংগ্রামে এই কলেজের ছাত্র-শিক্ষকের ভূমিকা উল্লেখযোগ্য।
প্রতিষ্ঠার পর থেকে ১৯৫৫ সালের পূর্ব পর্যন্ত কলেজে কোনো ছাত্রী ভর্তি করা হয়নি। ১৯৫৬ সালে হোসনে আরা বেগম (পরবর্তীতে ডাক্তার) ও হাসমত আরা হেলেন (শিল্পী) নামে দু’জন ছাত্রী ভর্তি হন। ১৯৭৩ সালের আগে এই কলেজে কোনো নারী শিক্ষক ছিলেন না। ওই বছর দর্শন বিভাগে যোগদান করেন অধ্যাপক মুক্তি মজুমদার।
বিএল কলেজ প্রতিষ্ঠার আগে নড়াইলে ১৮৮৬ সালে ভিক্টোরিয়া কলেজ প্রতিষ্ঠিত হলেও উচ্চশিক্ষা প্রসারের ক্ষেত্রে নানা কারণে সে সময় এই কলেজ তেমন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারেনি। এই অঞ্চলের মানুষ বিএল কলেজ প্রতিষ্ঠার আগে কলকাতায় গিয়ে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করেছে। তার অন্যতম কারণ খুলনা জেলাসহ এর আশপাশের এলাকার সঙ্গে কলকাতার ভৌগোলিক দূরত্ব কম ও যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজ ছিল।
বিএল কলেজ প্রতিষ্ঠার পর এই অঞ্চলের মানুষের কাছে উচ্চশিক্ষার দুয়ার খুলে গিয়েছিল। মাধ্যমিক পর্যায়ের লেখাপড়া শেষ করে যাদের কলকাতা গিয়ে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের সামর্থ্য ও সুযোগ ছিল না কিংবা কম ছিল, তাদের উচ্চশিক্ষা গ্রহণের পথ সুগম হয়েছিল। ১৯১৮ সালে প্রতিষ্ঠিত বাগেরহাট পিসি কলেজ ছাড়া বৃহত্তর খুলনা জেলায় আর কোনো কলেজ ছিল না।
১৯২৫ সালে এই কলেজে অনার্স কোর্স চালু হলেও দেশভাগের পর ছাত্র ও শিক্ষকের অভাবে অনার্স পড়ানো বন্ধ হয়ে যায়। ১৯৬০ সালে ১০টি বিষয়ে অনার্স এবং ১৯৭৩ সালে ৫টি বিষয়ে মাস্টার্স কোর্স খোলা হয়। ১৯৬৭ সালের ১ জুলাই বিএল কলেজকে সরকারিকরণ করা হয়। বর্তমানে উচ্চমাধ্যমিক, স্নাতক পাস, ২১টি বিষয়ে স্নাতক সম্মান এবং ২০টি বিষয়ে স্নাতকোত্তর কোর্স চালু আছে। শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৩৩ হাজারের বেশি। কর্মরত শিক্ষক ও কর্মচারী আছেন ২১৯ জন। শিক্ষার্থীদের জন্য আছে- ৫টি ছাত্রাবাস ও ২টি ছাত্রী নিবাস। রয়েছে প্রশাসনিক ও অ্যাকাডেমিক বিভিন্ন ভবন, অডিটোরিয়াম, আইসিটি প্রশিক্ষণকেন্দ্র, সাইবার সেন্টার, সাহিত্য ও সংস্কৃতিচর্চার জন্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বিএল কলেজ থিয়েটার, ডিবেটিং ক্লাব ও অন্যান্য সাংস্কৃতিক সংগঠন। এছাড়াও আছে সুবিশাল খেলার মাঠ, ব্যায়ামাগার ও সুস্থ সংস্কৃতিচর্চার চমৎকার পরিবেশ। রয়েছে পরিবহন ব্যবস্থা।
বিভিন্ন সময়কালে এই কলেজের কৃতি শিক্ষকদের মধ্যে ছিলেন- ছন্দগুরু প্রবোধ চন্দ্র সেন, অমূল্য কুমার দাশগুপ্ত, গণিতজ্ঞ চারুচন্দ্র বসু, বাউল গবেষক ড. এ.এস.এম আনোয়ারুল করিম, সুন্দরবনের ইতিহাস গ্রন্থের লেখক এ.এফ.এম আবদুল জলিল, অমূল্য ধন সিংহ, ড. নীলরতন সেন, মুনীর চৌধুরী, সুবোধ চন্দ্র মজুমদার, জিল্লুর রহমান, মো. আবদুল গণি, মুহম্মদ কায়কোবাদ, কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুল হক, বজলুল করিম (বিএল কলেজের ইতিহাস গ্রন্থের প্রণেতা), মুক্তি মজুমদার, সাধন রঞ্জন ঘোষ।
সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে ঐতিহ্যবাহী বি এল কলেজের নানান অনুষ্ঠানে বিভিন্ন সময়ে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম, পল্লীকবি জসীম উদ্দিন, ভাষাবিদ ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্, সাহিত্যিক রামেন্দ্র সুন্দর ত্রিবেদী, হুমায়ুন কবির, মনোজ বসু, চিত্রশিল্পী এস এম সুলতান, কবি সৈয়দ আলী আহসান, আবুল হোসেন, আল মাহমুদ প্রমুখের আগমন ঘটেছে।
বিএল কলেজের কৃতী ছাত্রদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন কবি গোলাম মোস্তফা, পন্ডিত ও লেখক ড. দেবীপদ ভট্টাচার্য, গল্পকার হাসান আজিজুল হক, গল্পকার কুন্তল চক্রবর্তী, ধর্মগ্রন্থ লেখক অদ্বৈতানন্দ মহারাজ, নাট্যকার কাজী আবদুল খালেক বিশিষ্ট পার্লামেন্টারিয়ান সৈয়দ নওশের আলী, ড. মোহাম্মদ এনামুল হক, অধ্যাপক মো. মোবাশ্বের আলী, স্থপতি এম শহীদুল্লাহ, ডা. এম এ মানাফ, ডা. এম আর খান, ডা. বেগ আব্দুল্লাহ আল মাসুদ, কমরেড আব্দুল হক, এএফএম আব্দুল জলিল, শ্রী শরৎ চন্দ মজুমদার, অ্যাডভোকেট আব্দুল জব্বার, সালাউদ্দিন ইউসুফ, এস এম আমজাদ হোসেন, মোমিন উদ্দিন আহমেদ, শেখ রাজ্জাক আলী ওএম মনছুর আলী।
১৯৪৮ এর ১১মার্চ প্রথম ভাষা আন্দোলনে খুলনার তৎকালীন বি এল কলেজের ছাত্ররা অসামান্য ভুমিকা পালন করেন। নতুন পাক সরকারের প্রবল বাধার মুখে ১৯৪৮ এর ২৭ ফেব্রুয়ারি দৌলতপুর বিএল কলেজে এক প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় ছাত্রনেতা আব্দুল হামিদের সভাপতিত্বে খুলনার ছাত্র ফেডারেশনের আনোয়ার হোসেন, স্বদেশ বসু, ধনঞ্জয় দাস, সন্তোষ দাসগুপ্ত, এম এ গফুর, মুসলিম ছাত্রলীগের তাহমিদ উদ্দিন আহমেদ, জিল্লুর রহমান, নুরুল ইসলাম, আব্দুর রউফ, মতিয়ার রহমান, কংগ্রেসের শৈলেশ চন্দ্র ঘোষ সহ অন্যান্য ছাত্রনেতারা উপস্থিত ছিলেন। এই আন্দোলনের সহযোগী ছিলেন- আবু মোহাম্মদ ফেরদৌস, আফিল উদ্দিন আহমেদ, এ কে চাঁন মিয়া, মোমিন উদ্দিন আহমেদ, আমজাদ হোসেন, মুনসুর আলি, জগদীশ বসু প্রমুখ নেতৃবৃন্দ।
ছাত্রদের একটি দল দৌলতপুর থেকে খুলনা হাদিস পার্কে (তৎকালীন গান্ধী পার্ক) এসে বাংলা ভাষার দাবিতে সভা করেন। সভায় আনোয়ার হোসেন লিখিত দাবি নামা পেশ করেন। সভা শেষে কয়েকজন ছাত্রকে গ্রেফতার করা হয়। পরে বিভিন্ন সময়ে অন্যান্যরা ছাড়া পেলেও আনোয়ার হোসেন ছাড়া পাননি। ১৯৫০ খ্রিঃ রাজশাহী জেলের খাপড়া ওয়ার্ডে আন্দোলনরত আনোয়ার হোসেনসহ সাত জন কারাবন্দিকে নির্মমভাবে গুলি করে হত্যা করা হয়। বি এল কলেজের ছাত্রনেতা আনোয়ার হোসেনই প্রথম ভাষা শহীদ। ভাষা আন্দোলনের শুরুর দিকে অধ্যাপক মুনির চৌধুরী বিএল কলেজে অধ্যাপনা করতেন। সেসময় তিনি নানাভাবে ছাত্রদের উৎসাহ ও অনুপ্রাণিত করেছেন।
একটি মানসম্মত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পুরো এলাকাকে জ্ঞানের আলোয় আলোকিত করে তুলতে পারে। ঐতিহ্যবাহী বিএল কলেজ শতাব্দীর অজস্র প্রাণের স্পন্দন।
বাংলাদেশ সময়: ১২০৩ ঘণ্টা, জুলাই ২৬, ২০২২
এসআইএস