উজান-ভাটির মিলিত ঐশ্বর্যে বৈচিত্র্যময় ভূ-প্রকৃতির এক সমৃদ্ধ জেলা কিশোরগঞ্জ। ১৮৬০ সালে কিশোরগঞ্জ বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলার একটি মহকুমা হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে।
হিমালয় থেকে উৎপন্ন অসীম জলধারা তার স্বভাবজাত ধর্ম অনুযায়ী বাংলাদেশের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে বঙ্গোপসাগরে গিয়ে মিশেছে আর এই গ্রামীণ জনপদকে সমৃদ্ধ করেছে অসংখ্য ছোট-বড় নদ-নদী, হাওর-বাঁওড়, খাল-বিল দিয়ে; উদ্ভব হয়েছে নদীমাতৃক বাংলাদেশের। অতীতে এই অঞ্চলে সহস্রাধিক নদ-নদী থাকলেও বর্তমানে বিভিন্ন গবেষকের মতে নদ-নদীর সংখ্যা কমে ২৪৬ বা ২৮০, আবার কারও কারও মতে নদী, উপনদী, শাখানদী সব মিলিয়ে ৭১০টি হলেও বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের সাম্প্রতিক সময়ের (২০১১) গবেষণায় ৪০৫টি নদ-নদীর উল্লেখ রয়েছে।
উল্লেখ্য নদ-নদীর মধ্যে পদ্মা, মেঘনা, যমুনা ও ব্রহ্মপুত্র প্রধান; এছাড়াও বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা, তিস্তা, সুরমা, কুশিয়ারা, মধুমতি, করতোয়া, কর্ণফুলী, গড়াইসহ অসংখ্য ছোট-বড় নদ-নদীও রয়েছে।
পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত হয়ে ৫৪টি নদ-নদী দিয়ে পানি প্রবেশ করে সারা বাংলাদেশে এবং এর মধ্যে ২৪টি নদ-নদী দিয়ে হাওরে প্রবেশ করে মোট পানির প্রায় শতকরা ৬৭ ভাগ। এছাড়া বর্ষাকালে পৃথিবীর সর্বাধিক বৃষ্টিপ্রবণ এলাকা ভারতের চেরাপুঞ্জিসহ মেঘালয়, মিজোরাম, মণিপুর ও ত্রিপুরার বৃষ্টির পানি পাহাড় বেয়ে ঝরনা ও নদী-নালা দিয়ে হাওরে প্রবেশ করে। বর্ষা মৌসুমে এইসব জালের মতো ছড়িয়ে থাকা অসংখ্য হাওর-বাঁওড়, খাল-বিল, ডোবা-নালা ও নদ-নদীর পানি একাকার হয়ে বিশাল একটি হাওরে পরিণত হয়ে সাগরের রূপ নেয়। প্রায় ৮ হাজার ৫শ ৯০ বর্গকিলোমিটার পরিধির বিশ্বের সর্ববৃহৎ মিঠাপানির একক ‘ওয়াটার বডি’ বাংলাদেশের এই হাওরাঞ্চল, যার যৎসামান্য অঞ্চল ভরতের আসামে। মোট ৩৭৩টি হাওরের মধ্যে কিশোরগঞ্জে রয়েছে ৯৭টি, সিলেটে ১০৫টি, মৌলভীবাজারে ০৩টি, হবিগঞ্জে ১৪টি, সুনামগঞ্জে ৯৫টি, নেত্রকোণায় ৫২টি ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ০৭টি হাওর রয়েছে।
‘ব্লু ইকোনোমি’ (Blue Economy) এর উর্বরক্ষেত্র মিঠাপানির আধার বিস্তীর্ণ এই হাওরাঞ্চলে ছোট-বড় প্রায় ৩৭৩টি হাওরে ৩ হাজারেরও অধিক জলমহাল, ১৫ হাজারের মতো পুকুর রয়েছে। বর্ষায় বিশাল জলরাশি ছাড়াই এতে বছরে আহরিত হয় প্রায় ৪ লাখ ৩২ হাজার মেট্রিক টন মাছ, যা দেশের অভ্যন্তরীণ জলাশয় থেকে আহরিত মাছের শতকরা ২৫ ভাগ। এছাড়া দেশে উৎপাদিত মোট প্রাকৃতিক গ্যাসের শতকরা ৯০ ভাগই আহরিত হয় হাওরাঞ্চল হতে।
ভরা বর্ষায় হাওরের অপার সৌন্দর্য দেখতে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ছুটে আসছে ভ্রমণপিপাসু পর্যটক। বর্ষা মৌসুমে হাওর অঞ্চলের বেশীরভাগ হাওর ও ভূমি জলমগ্ন হয়ে পরে, ফলে ছোট ছোট গ্রামগুলোকে পানিতে ভেসে থাকা একেকটা দ্বীপের মত দেখায়। দিগন্ত বিস্তৃত স্বচ্ছ জলের খেলা, ছোট ছোট জলাবন, মাছ ধরায় ব্যস্ত জেলেদের দল, আর নৌকায় ঘুরে বেড়াতে আসা পর্যটকদের উপস্থিতিতে নবনির্মিত বিনোদন কেন্দ্রগুলো প্রাণচাঞ্চল্যে মুখরিত হয়ে ওঠে। বিশেষ করে কিশোরগঞ্জ জেলার করিমগঞ্জ উপজেলার বালিখলা, চামড়াঘাট, নিকলী উপজেলার বেড়িবাঁধ, ছাতিরচর, করসবন, মিঠামইন উপজেলার দিল্লির আখড়া, আখড়া সংলগ্ন হিজল বন, হাসানপুর ব্রিজ, তাড়াইল উপজেলার হিজলজানি, ইটনা উপজেলার ব্রিটিশবিরোধী বিপ্লবী ব্যারিস্টার ভুপেশ গুপ্ত’র বাড়ি, বাংলার প্রথম র্যাংলার আনন্দমোহন বসু’র বাড়ি এবং অষ্টগ্রাম উপজেলার সুলতানি আমলে নির্মিত ঐতিহাসিক কুতুব মসজিদ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য স্থানসমূহ ইতিহাস, ঐতিহ্য ও ভ্রমণপিপাসু পর্যটকদের বিমোহিত করে। এছাড়া নিকলীর ঐতিহাসিক মেলা ও নৌকাবাইচ দেখতে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে পর্যটকেরা ছুটে আসেন।
কিশোরগঞ্জের হাওর অঞ্চলকে বাংলাদেশের সম্ভাবনাময় পর্যটন রূপকল্পে পরিণত করতে হলে সমন্বিতভাবে সরকার, স্থানীয় সরকার, আয়োজক সম্প্রদায় (Host Community), স্থানীয় জনগোষ্ঠী (Local Community), পর্যটন উদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ী, স্থানীয় উদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ী, প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত অন্যসকল অংশীদের নিয়ে বাংলাদেশ পর্যটন নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ডকে একটি বাস্তবমুখী অবকাঠামোগত কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করতে হবে। কিন্তু সরকার ও বাংলাদেশ ট্যুরিজ্ম বোর্ড কর্তৃক গৃহীত পদক্ষেপগুলোকে নিবিড়ভাবে পর্যালোচনা করলে পর্যটন সম্পর্কিত জ্ঞান, পর্যটন সচেতনতা, মাঠপর্যায়ের সমন্বয়হীনতা ও অকার্যকরী ভূমিকা পরিলক্ষিত হয়।
হাওর পর্যটন তথা পর্যটনকে বুঝতে হলে প্রথমে পর্যটন সম্পর্কিত জ্ঞান ও পর্যটন সচেতনতা নিয়ে চর্চা করতে হবে। সেই সাথে আর সবার মতো ‘পর্যটন’ এবং ‘পর্যটন ব্যবসায়’কে এক করে ফেললে চলবে না। তাই যারা হাওর পর্যটন নিয়ে ভাবছেন, কাজ করছেন, প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে যুক্ত আছেন তাদের সবাইকে অবশ্যই পর্যটন ও পর্যটন কার্যকলাপ বিষয় সম্পর্কিত মৌলিক জ্ঞান এবং আন্তর্জাতিক বিধিমালা সম্পর্কে ধারণা ও চর্চা থাকা অতিব জরুরি। পাঠকদের জ্ঞাতার্থে পর্যটন এবং পর্যটন সম্পর্কিত রাষ্ট্রীয় ও আন্তর্জাতিক বিধিমালাসমূহ নিম্নে আলোকপাত করা হল:
পর্যটন (Tourism):
পর্যটন (Tourism) এক ধরনের বিনোদন, অবসর অথবা ব্যবসায়ের উদ্দেশ্যে এক স্থান থেকে অন্য স্থান কিংবা এক দেশ থেকে অন্য দেশে ভ্রমণ করাকে বোঝায়। মানুষ অবসর কাটানোর জন্য বিনোদনমূলক যেসব স্থানে গিয়ে মনে প্রশান্তি পায়; আবার কেউ এর মাধ্যমে ব্যবসা-বাণিজ্য করে দেশের অর্থনীতির চাকা সচল করতে ভূমিকা রাখে তাকেই পর্যটন বলে। পর্যটন গুরুত্বপূর্ণ সহায়ক হিসাবে একটি অঞ্চল বা সম্প্রদায়ের আর্থ-সামাজিক কল্যাণের দিকে পরিচালিত করে এবং পাশাপাশি ভূতাত্ত্বিক, ভৌগলিক, প্রত্নতাত্ত্বিক, প্রাকৃতিক এবং সাংস্কৃতিক আকর্ষণের মিশ্রণ প্রদান করে।
অল্প কথায় বা নির্দিষ্ট কিছু মানদণ্ডের আলোকে পর্যটনকে সংজ্ঞায়িত করা কঠিন। কারণ একেকজনের দৃষ্টিতে পর্যটন একেকরকম। সহজ কথায়, পার্থিব সৌন্দর্য উপভোগ করার উদ্দেশ্যে মানুষের দর্শনীয় স্থানে অবস্থান এবং এর সাথে সম্পর্কযুক্ত কর্মকাণ্ডকে পর্যটন বলে। পর্যটনকে কেন্দ্র করে যখন অর্থনীতি আলাদা একটি গতি পায় তখন তাকে বলে পর্যটন শিল্প। আন্তর্জাতিক পর্যটন বিশেষজ্ঞ সংস্থার সংজ্ঞানুযায়ী ‘পর্যটন হলো কোনো উপার্জনমূলক কাজে যুক্ত নয় এবং স্থায়ীভাবে বসতি গড়ে না এমন ব্যক্তির ভ্রমণ এবং কোথাও থাকা থেকে উৎসারিত প্রপঞ্চ এবং সম্পর্কের সমষ্টি। ‘
বাংলাদেশের বিদ্যমান আইনে বলা আছে, কেউ নিজের ঘর থেকে ভ্রমণ বা শ্রান্তি বিনোদনের জন্য ২৪ ঘণ্টার বেশি কিন্তু এক বছরের কম সময়ে আরেক জায়গায় থাকলে তিনি পর্যটক বলে গণ্য হবেন।
হাওর পর্যটন:
হাওর অঞ্চলের মানুষের প্রকৃতিবান্ধব জীবন-জীবিকার চিত্র এখন গ্রামীণ পর্যটন উন্নয়নের এক নতুন ধাপ। প্রকৃতি ও গ্রামের সম্মিলিত সন্নিবেশ ও বিস্তীর্ণ জলরাশির সৌন্দর্য হাওর পর্যটনের মূল আকর্ষণ। মানুষ এখন প্রকৃতিমুখী এবং গ্রামমুখী। পর্যটন শিল্পের বিকাশে হাওরে রয়েছে অপার সম্ভাবনা। প্রাকৃতিক ঐতিহ্য ও জীববৈচিত্র ব্যতিরেকে অবকাঠামোগত সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধির মাধ্যমে পর্যটন শিল্পের বিকাশে সমন্বিত উদ্যোগ নিলে কর্মসংস্থান এর পাশাপাশি হাওর অঞ্চলের জীবন জীবিকায় নবদিগন্ত উন্মোচিত হবে।
টেকসই পর্যটন (Sustainable Tourism):
যে সকল পর্যটন ক্রিয়াকলাপ পরিবেশ এবং আয়োজক সম্প্রদায়ের (Host Community) বর্তমান ও ভবিষ্যত চাহিদা, অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং পরিবেশগত প্রভাব বিবেচনা করে সংঘটিত হয় তাকে টেকসই পর্যটন হিসাবে সংজ্ঞায়িত করা সম্ভব।
টেকসই পর্যটনকে পর্যটনের একটি পন্থা হিসাবে বিবেচনা করা উচিত যা সমগ্র পর্যটন খাতকে কৌশলগতভাবে পরিচালনা করবে। কারণ টেকসই পর্যটন শুধুমাত্র পরিবেশ রক্ষার জন্যই গুরুত্বপূর্ণ নয়, অন্যান্য খাতের ভবিষ্যতের জন্যও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, যা পর্যটনের পাশাপাশি পরিবেশ এবং স্থানীয় জনগোষ্ঠীর স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়সমূহের সাথে নিবিড়ভাবে জুড়ে রয়েছে। যেমন দীর্ঘমেয়াদিভাবে পরিবেশবান্ধব কার্যক্রম ও কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ, স্থানীয় জনগোষ্ঠীর আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন কার্যক্রম ও কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ, স্থানীয় জনগোষ্ঠীর পর্যটনকেন্দ্রিক অর্থনৈতিক কার্যক্রমের সাথে সম্পৃক্তকরণ এবং সর্বোপরি পর্যটকদের আত্মতৃপ্তির বিষয়টিও জড়িত।
টেকসই পর্যটনকে উন্নীত করার লক্ষ্যে জাতিসংঘ বিশ্ব পর্যটন সংস্থা (UNWTO) সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য ও নির্দেশনা প্রনয়ন করেছে তা নিম্নরূপ:
পরিবেশগত সম্পদের সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করুন, যা পর্যটন উন্নয়নের একটি মূল উপাদান। মৌলিক পরিবেশগত প্রক্রিয়া বজায় রেখে এবং প্রাকৃতিক ঐতিহ্য ও জীববৈচিত্র রক্ষায় সহায়তা করে।
আয়োজক সম্প্রদায়ের সামাজিক-সাংস্কৃতিক সত্যতাকে সম্মান করা, তাদের বসতি স্থাপন করা এবং জীবন্ত সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য এবং ঐতিহ্যগত মূল্যবোধ রক্ষা করা, আন্তঃসাংস্কৃতিক বোঝাপড়া এবং সহনশীলতায় অবদান রাখা।
টেকসই, দীর্ঘমেয়াদী অর্থনৈতিক ক্রিয়াকলাপ নিশ্চিত করতে, স্থিতিশীল কর্মসংস্থান এবং আয়-উৎপাদনের সুযোগ তৈরি করতে, আয়োজক সম্প্রদায়ের জন্য সামাজিক পরিষেবাসহ সমস্ত স্টেক হোল্ডারদের ন্যায়সঙ্গত আর্থ-সামাজিক সুবিধা প্রদান করে, দারিদ্র্যতা হ্রাসে অবদান রাখে।
এছাড়া ইউনাইটেড নেশনস এনভায়রনমেন্ট প্রোগ্রাম (UNEP) এবং জাতিসংঘ বিশ্ব পর্যটন সংস্থা (UNWTO) ২০০৫ সালে যৌথভাবে টেকসই পর্যটনের জন্য ১২টি নীতি নির্ধারণ করে একটি নির্দেশিকা প্রকাশ করে। এই নির্দেশিকায় অন্তর্ভূক্ত টেকসই পর্যটন নীতিগুলো হল:
অর্থনৈতিক ধারাবাহিকতা: পর্যটন গন্তব্য এবং এন্টারপ্রাইজগুলির অর্থনৈতিক স্থায়িত্ব এবং প্রতিযোগিতা বজায় রাখা যাতে তারা দীর্ঘমেয়াদে বিকাশ এবং উপকৃত হতে পারে।
স্থানীয় কল্যাণ: হোস্ট গন্তব্যে পর্যটনের অবদান বাড়াতে দর্শনার্থীদের স্থানীয় ব্যয়ের হার বৃদ্ধি করা।
কর্মসংস্থানের মান: জাতি, লিঙ্গ, অক্ষমতার মতো বিষয়গুলোতে বৈষম্য ছাড়াই মজুরি স্তর এবং পরিষেবার মান উন্নত করে পর্যটন খাত দ্বারা তৈরি এবং সমর্থিত স্থানীয়দের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা এবং গুণমান বৃদ্ধি করা।
সামাজিক সমতা: পর্যটন থেকে প্রাপ্ত অর্থনৈতিক ও সামাজিক সুবিধাগুলো সমাজে ব্যাপকভাবে এবং ন্যায্যভাবে বিতরণ করা এবং অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে সুবিধাবঞ্চিত লোকদের জন্য প্রদত্ত সুযোগ, আয় এবং পরিষেবার উন্নতি নিশ্চিত করা।
দর্শক সন্তুষ্টি: লিঙ্গ, জাতি, অক্ষমতা বা অন্যান্য পার্থক্য নির্বিশেষে সমস্ত দর্শকদের একটি নিরাপদ এবং সন্তোষজনক অভিজ্ঞতা প্রদান করা।
স্থানীয় নিয়ন্ত্রণ: তাদের অঞ্চলে পর্যটন ব্যবস্থাপনা ও উন্নয়নের জন্য অন্যান্য স্টেকহোল্ডারদের সাথে পরামর্শ করে পরিকল্পনা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়ায় স্থানীয় সম্প্রদায়কে নিযুক্ত করুন।
সমাজকল্যাণ: সামাজিক অবক্ষয় এবং অপব্যবহার রোধ করার সাথে সাথে সামাজিক কাঠামো এবং সম্পদ, সুযোগ এবং জীবন সহায়তা ব্যবস্থায় প্রবেশাধিকার প্রদান করে স্থানীয় সম্প্রদায়ের জীবনযাত্রার মান বজায় রাখা এবং উন্নত করা।
সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য: ঐতিহাসিক ঐতিহ্য, প্রামাণিক সংস্কৃতি, ঐতিহ্য এবং স্বাগতিক সম্প্রদায়ের বৈচিত্র্যকে সম্মান ও সমৃদ্ধ করা।
শারীরিক অখণ্ডতা: শহুরে এবং গ্রামীণ উভয় এলাকার প্রাকৃতিক ভূদৃশ্য গুণমান সংরক্ষণ এবং সমৃদ্ধ করা; পরিবেশের শারীরিক এবং চাক্ষুষ অবক্ষয় রোধ করুন।
জীববৈচিত্র্য: প্রাকৃতিক এলাকা, আবাসস্থল এবং বন্যপ্রাণীর সুরক্ষা এবং তাদের ক্ষতি কমাতে সহায়তা করা।
সম্পদ দক্ষতা: পর্যটন সুবিধা এবং পরিষেবাগুলোর বিকাশ এবং পরিচালনায় সীমিত, অ-নবায়নযোগ্য সংস্থানগুলোর ব্যবহার হ্রাস করা৷
পরিবেশগত বিশুদ্ধতা: পর্যটন প্রতিষ্ঠান এবং দর্শনার্থীদের দ্বারা সৃষ্ট বায়ু, জল এবং ভূমি দূষণ এবং বর্জ্য উৎপাদন হ্রাস করা।
পর্যটন সম্ভাবনা বাস্তবায়নে করণীয়:
বাংলাদেশে পর্যটন শিল্পের অপার সম্ভাবনা বিরাজমান থাকা সত্ত্বেও সঠিক পরিকল্পনা এবং সমন্বয়ের অভাবে আমরা পর্যটন শিল্পে অন্যন্য দেশের চেয়ে অনেক পিছিয়ে রয়েছি। তাই পর্যটন শিল্পের বিকাশে সম্পৃক্ত সকলপক্ষকে নিয়ে সমন্বিত উপায়ে একযোগে কাজ করতে হবে।
পর্যটন বিষয়ে ব্যাপক গণশিক্ষা এবং স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র-ছাত্রীদের মাঝে পর্যটন বিষয়ের উপর শিক্ষার প্রসার ঘটাতে হবে।
পর্যটন, টেকসই পর্যটন (Sustainable Tourism), পরিবেশ বান্ধব পর্যটন (Eco-Tourism) বিষয়ে গণসচতেনতা তৈরিতে ব্যপক প্রচার-প্রচারণার ওপর গুরুত্বারোপ দিতে হবে।
পর্যটন পরিকল্পনা ও পর্যটন উন্নয়ন সম্পর্কিত নীতি নির্ধারণে দেশি-বিদেশি পর্যটন বিশেষজ্ঞদের সম্পৃক্ত করতে হবে।
সরকারি বেসরকারি সকল পর্যটন কেন্দ্রের সাথে সম্পৃক্ত সকল কর্মকর্তা এবং কর্মচারীদের পর্যটন সেবা প্রদানে উন্নত এবং পর্যাপ্ত ধারাবাহিক প্রশিক্ষণ ব্যবস্থা প্রচলন করতে হবে।
হাওর অঞ্চলের ভৌত অবকাঠামো উন্নয়ন বিশেষ করে সড়ক যোগাযোগ, সড়কসেতু, কালভার্ট, অকাল বন্যারোধক বাঁধ, ও নদী খননের বিষয়ে আরো বেশি গবেষণামূলক সমীক্ষার মাধ্যমে অবাধ জলপ্রবাহ ও জলজপ্রাণীর পরিবেশ ও প্রতিবেশ রক্ষার দিকে নজর দেয়া জরুরি।
ভৌত অবকাঠামোগত উন্নয়নের পাশাপাশি হাওর অঞ্চলে তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার, নিরাপত্তা ব্যবস্থার উন্নয়ন, রাজনৈতিক ও সামাজিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে হবে।
পর্যটকদের সুরক্ষা ও নিরাপত্তা নিশ্চিতে হাওর অঞ্চলে টুরিস্ট পুলিশ ও হাওর পেট্রোল পুলিশ ব্যবস্থার প্রবর্তন করতে হবে।
স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতে মোবাইল বা ভাসমান চিকিৎসা কেন্দ্রের প্রবর্তন করা যেতে পারে।
পর্যাপ্ত পরিমাণে বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ ও পয়োনিষ্কাশন ব্যাবস্থার উন্নতি করতে হবে।
বজ্রপাত হাওর অঞ্চলের আরেক দুর্যোগের নাম। সরকারের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে সচেতনতামূলক কার্যক্রম জোরদারের পাশাপাশি হাওর অঞ্চলে লাইটেনিং সেন্সর ও বজ্রপাত নিরোধক লাইটেনিং এরেস্টার স্থাপন এবং প্রতিটি হাওরের উন্মুক্ত স্থানগুলোতে জরুরি অবস্থায় আশ্রয় নেয়ার জন্য বিদ্যুতায়িত ঘর নির্মাণ করা যেতে পারে। এছাড়াও মোবাইল টাওয়ারগুলো তে আর্থিং পদ্ধতি চালুর মাধ্যমে সুফল পাওয়া যেতে পারে।
হাওর অঞ্চলে জলাবধ্যতার কারণে প্রয়োজনের তুলনায় গাছপালার পরিমাণ অনেক কম হওয়ায় পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে। তাই মিঠা পানি সহিষ্ণু গাছ যেমন হিজল, করচ বট, কড়ি, মেড়া, আম, জাম, নলখাগরা, মটকা ইত্যাদি প্রজাতির বৃক্ষরোপণ করে প্রাকৃতিক পরিবেশের ভারসাম্য ফিরিয়ে আনা যায়, যা হাওরের জীববৈচিত্র্য রক্ষার্থে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
যথাযথ প্রশিক্ষণ ও প্রণোদনার অভাবে স্থানীয় জনগোষ্ঠীকে জৈব চাষাবাদে (Organic Farming) উদ্বুদ্ধকরণ সম্ভব হচ্ছে না। জৈব চাষাবাদকে জনপ্রিয় করতে পারলে সারা বছর এই হাওর অঞ্চল হতে মিঠা পানির মাছ, শুটকি, হাঁস-মুরগি, শাক-সবজি ফলনের মাধ্যমে আঞ্চলিক চাহিদা মেটানোর সাথে সাথে নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টির সুযোগ রয়েছে।
স্থানীয় শিক্ষিত বেকার জনগোষ্ঠীর জন্য স্থানীয়ভাবে কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও স্বনির্ভর উদ্যোক্তা তৈরিতে যথাযথ পর্যটন ও পর্যটন ব্যবসার উপর প্রশিক্ষণ ও ঋণ সহায়তা প্রবর্তন করতে হবে।
পর্যটকদের কাছে হাওর অঞ্চলের স্থানীয় জনগোষ্ঠীর জীবন, পেশা, সংস্কৃতি, হস্তশিল্প ইত্যাদি উপস্থাপন করার ব্যবস্থা করতে হবে।
পর্যটন সচেতনতা বাড়াতে বার্ষিক ‘হাওর উৎসব’ উদযাপনের আয়োজন করতে হবে।
শীতকালে হাওর অঞ্চল অথিথি পাখির (Migratory Birds) কলতানে মুখরিত হয়ে উঠে যা পাখিপ্রেমী ও পর্যটকদের আকর্ষিত করে। তাই সরকার ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এই অঞ্চলকে পাখিদের অভয়ারণ্য ঘোষণা করে যথাযত কর্মপরিকল্পনা গ্রহন করতে পারে।
কমিউনিটি ভিত্তিক পর্যটনের (CBT) প্রসার ঘটাতে হবে।
স্থানীয় জনগোষ্ঠীকে সংগে নিয়ে স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ কর্তৃপক্ষ এলাকাভিত্তিক 'নিয়ন্ত্রিত ইকো-ট্যুরিজম' (Controlled Eco-Tourism) প্রচলন করতে পারে।
হাওর অঞ্চলের ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, জীবন-সংগ্রাম ইত্যাদি সংরক্ষণে হাওর জাদুঘর স্থাপন করা যেতে পারে।
বর্ষাকালে হাওরের মুক্ত জলাশয় বেশ কয়েকটি মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্রে পরিণত হয়, যা মৎস্য গবেষণা কেন্দ্র স্থাপনের মাধ্যমে এই অঞ্চল মৎস্য চাষ ও উৎপাদনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।
হাওর অঞ্চল যেহেতু কৃষি ও মৎস্য আহরণ নির্ভর, তাই মৎস্য ও কৃষি ইনস্টিটিউট প্রণয়ন করা যেতে পারে।
হাওর অঞ্চলে পর্যটন সমস্যা এবং সম্ভাবনা নিয়ে গবেষণা ও পাঠ পরিক্রমা চালু করা যেতে পারে।
দেশীয় পর্যটন বিকাশের পাশাপাশি বিদেশি পর্যটক আকর্ষণে প্রচার-প্রচারণার ওপর গুরুত্বারোপ করতে হবে।
সাম্প্রতিককালে জনপ্রিয় হয়ে ওঠা হাওর পর্যটনের তাৎপর্য ও বিকাশ ধরে রাখতে হলে বাস্তবমুখী ও দীর্ঘমেয়াদী সুচিন্তিত পরিকল্পনার মাধ্যমে হাওর বেষ্টিত জেলাসমূহকে যোগাযোগের পাশাপাশি পরিবেশগত বিপন্নতা তথা জলবায়ুর অভিঘাত, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, বন্যা ব্যবস্থাপনা, পানি সম্পদ ব্যবহার, জীববৈচিত্র্য ও জলাশয় সংরক্ষণসহ আর্থসামাজিক, শিক্ষা, সাংস্কৃতিক ও মানবসম্পদ উন্নয়নসহ সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে প্রয়োজনীয় অবকাঠামোগত উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণ করে তা বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে। বিশেষ করে গণসচেতনতা সৃষ্টি করে পর্যটন শিল্পের সম্ভাবনাকে হাওরবাসীর কাছে তুলে ধরার পাশাপাশি তাঁদের জন্য বিকল্প আয় সৃষ্টি, হাওরের পরিবেশ উন্নয়ন ও জীববৈচিত্র সংরক্ষণে অনন্য ভূমিকা রাখতে হাওরের পর্যটন বিস্তার একান্ত প্রয়োজন।
লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, ট্যুরিজ্ম ও হসপিটালিটি অনুষদ
ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব বিজনেস এগ্রিকালচার এন্ড টেকনোলজি