একটা বদ্ধমূল ধারণা ছিল, দেশে সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা না থাকলেও, অতি ক্ষমতাধর পুলিশের বুঝি সেই ন্যূনতম নিরাপত্তাটুকু আছে। কিন্তু শুক্রবারের পত্রিকার একটি খবরে আমার ধারণা কিছুটা হলেও হোঁচট খেল।
সীমান্তে, বেডরুমে, রাজপথে সবখানে দেশি-বিদেশি সকলে যখন অনিরাপদ, সেখানে অন্ততঃ পুলিশ কিছুটা নিরাপত্তা পাচ্ছে ভেবে একটা ঠুনকো সান্ত্বনা ছিল। যতোই হোক, ওরা আমাদের দেশেরই সন্তান। কারো বাবা, কারো ছেলে, কারো স্বামী, কারো ভাই কিংবা অন্য কিছু। কাজেই তারা নিরাপদে থাকলে আনন্দ পাবারই কথা। অবশ্য পুলিশ আমাদের সেই সম্পর্কের নিরিখে দেখে কিনা সন্দেহ থাকলেও থাকতে পারে।
প্রধানমন্ত্রী বেডরুমে মানুষের নিরাপত্তা দিতে পারবেন না বলে সুস্পষ্ট করে জানিয়ে দিয়েছেন। যদিও সংবিধান অনুযায়ী নাগরিকের নিরাপত্তা দেবার দায়িত্ব সরকারের। যাকগে, বেডরুমে না পারুক, ভেবেছিলাম রাজপথে সরকার মানুষের নিরাপত্তা দেবে। আহবান জানিয়েছিলাম সবাইকে, ‘চলুন, সবাই রাস্তায় ঘুমাই’। কিন্তু রাজপথেও নিরাপত্তা কোথায়? এতোদিন রাস্তাঘাটে নিরীহ নাগরি সন্ত্রাসের লক্ষ্যবস্তু ছিল। কিন্তু এখন দেখছি সন্ত্রাসীদের লক্ষ্যবস্তু নির্ধারণে জাতীয় মাত্রা পেরিয়ে আন্তর্জাতিক মাত্রায় চলে গিয়েছে। দু’দিন আগে সৌদী দূতাবাসের দ্বিতীয় কর্তা ব্যক্তির মৃত্যুতে সেটাই মনে হচ্ছে।
কয়েকটা দিন না পেরুতেই একেবারে পুলিশকেই টার্গেট করে বসলো সন্ত্রাসীরা। এই যখন অবস্থা তখন নাগরিক সমাজ নিরাপত্তার জন্য কি কৌশল অবলম্বন করতে পারে? আমি রাস্তায় ঘুমানোর পূর্বের আবেদনটি প্রত্যাহার করে নিয়ে নতুন করে আবেদন জানাতে চাই, চলুন সবাই কম্যুনিটি বেডরুম গড়ে তুলি। একই রুমে কাতারে কাতারে শুয়ে থেকে নিজেদের জানের সুরক্ষা দেই। মাল গেলে যাক, জানটা থাকুক অন্ততঃ। এটারও অনেক ফজিলত আছে। গণরুমে ঘুমানোর কারণে জনসংখ্যা লাঘবে কিছুটা সহায়ক হবে বৈকি!
আসলে সব কিছু নিয়ে এ রকম মজা করাটা ঠিক নয়। কিন্তু নাগরিক জীবনে নিরাপত্তা প্রশ্নটি যে রকম দিনকে দিন ভঙ্গুর হতে চলেছে, তাতে হাসি-ঠাট্টা করে যদি একটু আনন্দ মেলে মন্দ কি!
ঢাকায় বিদেশি হত্যা কিংবা পুলিশের গাড়ি ছিনতাইয়ের ঘটনাই বলে দিচ্ছে দেশের অবস্থা কি রকম ভয়াবহ! কয়েকদিন বিরতিতে নিয়মিতভাবে দেশে এক একটা আলোচিত হত্যাকাণ্ড ঘটে চলেছে। নরসিংদীর লোকমান, জাহাঙ্গীরনগরের জুবায়ের থেকে শুরু করে সাগর-রুনি কিংবা সৌদী দূতাবাসের কর্মকর্তা, কোনটারই কি গোয়েন্দারা কূলকিনারা করতে পেরেছে প্রশ্নাতীতভাবে? রাস্তাঘাটে, নিজগৃহে মানুষ যখন সন্ত্রাসীদের ভয়ে তটস্থ, তখন সভ্য সমাজে পুলিশই হবার কথা নিরাপদ ভরসাস্থল। কিন্তু সত্যটা কি সেটা প্রতিটা মানুষই তার অভিজ্ঞতা থেকে ভাল করেই জানে। সন্ত্রাসীদের যেমন মানুষ ভয় পায়, একইভাবে মানুষের ভিতরে পুলিশ ভীতিও কম নয়। মানুষের মনে এখন হত্যার শিকার হবার চেয়েও পরিচিতজনের কারো অপমৃত্যু হলে ভয় বেশি কাজ করে। ইতোমধ্যে সাগর-রুনির হত্যাকারীদের ধরতে না পারলেও পুলিশ কয়েক ডজন মানুষকে সন্দেহজনকভাবে ধরে হাত-পা গুঁড়িয়ে দিয়েছে। পৃথিবীর সবখানেই কেউ হত্যার শিকার হলে মোবাইল ফোনের কললিস্ট, হত্যা হবার আগে পড়ে কে কে বাসায় এসেছিল, কারো সাথে ব্যক্তিগত বিরোধ ছিল কিনা খতিয়ে দেখে। কিন্তু এগুলোর কোনোটা থাকার মানেই যে, সে বা তারা হত্যা করেছে, সেটা বুঝায় না। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ঘটনায় পুলিশ মামুলি সন্দেহের কারণে মানুষ ধরে এনে যেভাবে নির্যাতন করে, সেটা শুধু বেআইনিই নয়, বরং মানবতা বিরোধী।
পুলিশ কেন এই অপরাধগুলো করে? এটা কি শুধুই তাদের ব্যর্থতাকে ঢাকার জন্য, নাকি তাদের সংস্কৃতিতে বিভিন্ন কারণে নাগরিক নির্যাতন করাটা ঢুকে গিয়েছে? হতে পারে এর দুটোই। তবে এর সংগে যুক্ত আছে অর্থনীতি। যেখানে সারা বিশ্বের মানুষকে জীবন ধারণের জন্য কঠোর পরিশ্রম করতে হয়, সেখানে আমাদের দেশে পুলিশের লাঠির ডগায় টাকা আটকে থাকে। যতো বেশি পিঠে ঘা দিতে পারবে, ততো বেশি লাঠির আগা থেকে আঠা খুলে রাশি রাশি টাকা পকেটে যোগ হতে থাকে। উৎকন্ণ্ঠিত পরিবার নির্যাতন থেকে বাঁচানোর জন্য সারা জীবনের গচ্ছিত টাকা পুলিশের পকেটে ঢেলে দেয়। সহজ প্রাপ্তিযোগ কে হারাতে চায়। একটু নির্দয় হলেই কাড়ি কাড়ি টাকা। তাই মানুষ মারাতেও আনন্দ!!
এই হচ্ছে জনগণের প্রতি পুলিশের গড়পড়তা আচরণ। তবে এর ব্যতিক্রমও আছে। অনেক দেশপ্রেমিক পুলিশ সদস্য আছেন যারা সত্যি সত্যি নিজেদের জীবন বাজি রেখে দেশের সেবা করে যাচ্ছেন।
বিপরীতে পুলিশের ব্যর্থতা কিংবা প্রশ্রয়ে হোক, সন্ত্রাসীরা দিনকে দিন দেশ জুড়ে বেপরোয়া হয়ে যাচ্ছে। এর বড় প্রমাণ মোহাম্মদপুরে পুলিশের বড় অফিসারের গাড়ি ছিনতাই। পাপকে রেহাই দিলে তাকেই একদিন পাপের শিকার হতে হয়। তেমনটি ঘটলো বোধহয় আবারো! ইতোমধ্যে অনেকেই বলা শুরু করেছে, ‘পাপ ছাড়ে না বাপকেও’। আমি অতোটা কঠিন, নির্দয় মন্তব্য করব না।
সরকার তাই বেডরুমের মতো সবচেয়ে নিরাপদ জায়গাকেও কথার ছলে ‘ডেঞ্জার জোন’ ঘোষণা করেছে। পথে পথে ভীতি, পদে পদে ভীতি। সেই ভীতি দূর করার দায়িত্ব যাদের, অপরাধের মাত্রার ব্যাপকতার কারণে তারাও এর শিকার।
প্রশাসন যেখানে জননিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ, সেখানে আমাদের কি করণীয় থাকতে পারে? নিচের প্রস্তাবনা ফ্যান্টাসি হলেও বাস্তবেও এটা প্রয়োগ বহুমাত্রিক নিরাপত্তা দিতে পারবে বলে বিশ্বাস।
‘নিরাপদ পরিবার’ গড়তে হলে আমাদের দেশে অন্ততঃ একটি পরিবারে পাঁচটি সন্তান থাকতে হবে। এদের মধ্যে দু’ জনকে হতে হবে দু’ প্রধান দলের রাজনীতিবিদ, একজন হবে সামরিক কর্মকর্তা, একজন সন্ত্রাসী এবং একজন পুলিশ।
কেন?
নিজের অভিজ্ঞতা থেকেই পরখ করুন। বড় দু’ দলের বড় দু’ নেতা থাকলে যে দলই ক্ষমতাই থাকুক না কেন, পরিবারটি থাকবে সরকারি দলের আশীর্বাদপুষ্ট। চাইলে খুন করে হলেও ধামাচাপা দেওয়া যাবে। কোনোভাবে ফেঁসে গেলেও ভয় নাই। রাষ্ট্রপতি হবে শেষ ভরসা। ক্ষমার চেয়ে বড় উদারতা কোথায়! দু’ দলের ক্ষমতা বদলের মাঝখানে যে সময়টুকু, কোনোভাবে সেটা রাজনীতির বলয় থেকে বেরিয়ে ১/১১ হবার সুযোগ থাকলে সামরিক কর্তা ব্যক্তি সেই সময়টুকু পরিবারের দেখভাল করবে। আর সন্ত্রাসীর তো কোনো দল নাই। যে দল ক্ষমতায় উভয় উভয়ের স্বার্থে কাছাকাছি। সন্ত্রাস যে করবে সে যদি থাকে নিজের ঘরে, তখন ভয় কিসের! পুলিশের কথা বলাই বাহুল্য! নিদেনপক্ষে একজন পুলিশ জামাই থাকলেও রক্ষে!
mahalom72@yahoo.com
বাংলাদেশ সময় : ১৬০৬ ঘণ্টা, মার্চ ০৯, ২০১২