সংবাদের নিচে সংবাদ চাপা পড়ে যায়, ধীরে ধীরে গুরুত্ব হারায়। চাঞ্চল্যকর, জন মনে তোলপাড় করা সংবাদও স্থায়ী হয় না।
একের পর এক খুন সংঘঠিত হচ্ছে, ঘরে-বাইরে সবখানে। এদেশে কেউ কোথাও নিরাপদ না। রাজধানীর সব থেকে সুরক্ষিত এলাকা বলে পরিচিত কূটনৈতিক পাড়া গুলশান দুই, সেখানে সৌদি দূতাবাসের কর্মকর্তা খুন হলেন। এবার কি জবাব দেবে সরকার? নিউইয়র্কের থেকে নিরাপদ ঢাকা শহরে নতুন বছরের প্রথম তিন মাসে কত গুলো খুন? কত গুলো অস্বাভাবিক মৃত্যু? কতগুলো ছিনতাই হয়েছে জানেন নিশ্চয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী? সকালে ঘর থেকে বের হয়ে কেউ ঠিকমত ঘরে পরিবারের কাছে ফিরতে পারবে কি না ঠিক নেই। এদেশে থেকে স্বাভাবিক শব্দটা হয়ত উঠে যাবে। অস্বাভাবিকতাই হবে স্বাভাবিক। যার উদাহরণ, আমাদের পুলিশ, হোক অতিরিক্ত ডিআইজি। তিনিও নিরাপদ নন তার ব্যক্তিগত বাহনে, তারা পুলিশের ছাপওলা নীল গাড়ি ও দেহরক্ষী ছাড়া নিরাপদ নন। কপালজোরে বেঁচে গেলেও ছিনতাইকারীরা অতিরিক্ত ডিআইজি’র ব্যক্তিগত বাহনটি নিয়ে গেছে। পুলিশের উচ্চ কর্মকর্তা হবার সুবাদে আশাকরি গাড়িটি ফেরত পাবেন।
আমরা জনগণ বাস, রিকশায়, সিএনজি, টেম্পুতে কখন পায়ে হেঁটে দিনে রাতে চলাফেরা করি। আমাদের নেই দেহরক্ষী, নেই নীল গাড়ি, আমাদের কি উপায়? আমাদের জীবন ছিনতাই হয়ে যায় বিচার পাবার কোনো আশা নেই, সেখানে টাকা, পয়সা, জিনিসপত্র বা গাড়ি ছিনতাই হয়ে গেলে কার কি আসে যায়? এদেশে আমাদের লেখার অধিকার খর্ব করা হয়।
রাজা আসে রাজা যায় কিন্তু আমাদের দেশ ও মানুষের ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন নেই, সেই চির অবহেলিত। ভুল বললাম, ভোটের সময় আমরা ‘মানুষ’ এই উপলব্ধি করান আমাদের ক্ষমতালিপ্সুরা। পাঁচ বছর পর পর আমাদের মনে হয় আমরাও মানুষ।
আসলে ক্ষমতালিপ্সুরা জানেন এক অর্থে আমরা নিরুপায়, আমাদের করার কিছু নেই। প্রতি পাঁচ বছর পর পর আমাদের একে না হয় ওকে ভোট দিতে হবে। মাত্র দুটি দল, যে একটু ভালো কথা বা আশার বানী দেন, আমরা নিরুপায় জনগণ এক আকাশ স্বপ্ন বুকে নিয়ে একে পাল্টে ওকে, আবার ওকে পাল্টে একে নির্বাচিত করি। তারপর হিন্দি সিরিয়ালের মতো একই গল্প একই কাহিনী দিনের পর দিন সবগুলো চ্যানেলে। হাজার চ্যানেল পাল্টিয়ে ভালো কিছু নাই সবাই একই গল্প শোনাই ভিন্ন ভিন্ন পাত্রপাত্রীর মাধ্যমে। নতুন সিরিয়ালের চটকদার বিজ্ঞাপনে মুগ্ধ দর্শক হতাশ হন বার বার। যেমন আমাদেরও পাঁচ বছর পর পর শুনতে হয় চটকদার, অনুনয়, বিনয় ও হাজারো প্রতিশ্রুতিময় বিজ্ঞাপনী ভাষণ। যার বিজ্ঞাপন যত ভালো ভোটও সে পায় তত বেশি। কিন্তু ক্ষমতায় বসল কি ভুলে গেল কারা তাকে দিল ক্ষমতা। কি আর করা, যে যায় লঙ্কায় সেই হয় রাবণ। আমরা নিরুপায়। বার বার হতাশ হই আবার আশায় বুক বাঁধি, আমাদের ধৈর্য ধরি, আমাদের আশার শেষ নেই। আমরা পাঁচটি বছর ধুঁকে ধুঁকে কাটায়, মনে করি, পরের পাঁচ বছর হয়ত ভালো যাবে, কিন্তু আসে না ভালো পাঁচটি দিন, বছর তো অনেক দুরের কথা। সরকার মনে রাখেন না আমাদের মৌলিক অধিকার আছে, সাংবিধানিক অধিকার আছে। আমাদের মুক্তমত প্রকাশের অধিকার আছে, আমাদের নিরাপদ জনপদে বাস করার অধিকার আছে। স্বাভাবিক জীবনযাপনের অধিকার আছে। আছে আমাদের মুক্ত গণমাধ্যমের অধিকার।
আমাদের চারদিকে শুধু অশুভ ছায়া। আমাদের দৈনন্দিন জীবন আধিকারহীন হয়ে উঠছি, খারাপ খবরে ভরে উঠছে আমাদের দিন। খারাপের মাঝে একটি ভালো খবর, আমাদের প্রধানমন্ত্রী ক্রিকেট নিয়ে ভাবছেন। ক্রিকেটের ভালোর জন্য আকরাম খানকে আবার বোর্ডে ফিরিয়ে আনলেন, যোগ্য ব্যক্তি হিসেবে। উনার কাছে বিনীত প্রশ্ন, জনগণের ভালোর জন্য কেন যোগ্য ব্যক্তি আনছেন না আপনার মন্ত্রিসভায়? আপনি সবার কাজ ভাগ করে দিয়েছেন। তারা কি তাদের কাজ জানেন না? আপনাকেই যদি উনাদের কাজ করতে হয় তবে এতো মন্ত্রীর কি দরকার? আপনার মন্ত্রীরা দেখি হরহামেশা তাদের কাজের ব্যর্থতার ভার আপনার কাঁধে চাপিয়ে দেন। মন্ত্রীদের কাজের তদারকি আর কাজের দায়ভার নেওয়া দুটো দু’জিনিস, অযোগ্য মন্ত্রীরা বার বার ব্যর্থ হয়, আর সেই ব্যর্থতার দায় বর্তায় আপনার উপর। আমার জানতে মন চায়, ক্রিকেট বোর্ডের মতো আপনার মন্ত্রিসভায় কেন যোগ্যলোক আনছেন না? অযোগ্যের দায়ভারে আপনি অযথাই জনগণের কাছে কেন অপ্রিয় হচ্ছেন?
সাড়ে তিন বছরে আপনার কিছু মন্ত্রী এমন কোনো কাজ করেননি যাতে মনে হয় উনারা ওই পদের যোগ্য, যেমন আপনার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আমাদের কোনো নিরাপত্তা দিতে পারেনি। বরং আরো বেশি অনিরাপদ হয়েছি আমরা। বিভিন্ন সময়ে তিনি বিভিন্ন উক্তি করে আমাদের আশাহত করেছেন, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাষ্ট্রের নিরাপত্তা দিতে পারেননি, সেখানে আমাদের নিরাপত্তা কি দেবেন?
আবারও না লিখে পারছি না যে, সাগর-রুনির হত্যাকাণ্ডের পরের দিন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে অপরাধীদের গ্রেফতারের নির্দেশ দিয়েছিলেন। ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে কোনো হত্যাকাণ্ডের জন্য দায়ী ব্যক্তিদের গ্রেফতার কঠিন, তবে তা অসম্ভব নয়। কিন্তু ৪৮ ঘণ্টা শেষ হওয়ার সময় পুলিশের আইজি জানালেন, মামলার তদন্তে প্রণিধানযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে, তবে কাউকে গ্রেফতার এখনো করা যাচ্ছে না। যা ছিল জনগণের জন্য প্রথম হোঁচট। মামলা নিয়ে পুলিশই প্রথম সন্দেহজনক বক্তব্য দেয়, যে পুলিশের শতভাগ নিশ্চিত না হয়ে কাউকে গ্রেফতার করা হবে না! যা ছিল দ্বিতীয় হোঁচট।
পৃথিবীর কোনো দেশের পুলিশ তদন্তের দায়িত্ব কখনোই শতভাগ নিশ্চিত হয়ে গ্রেফতার করা না। শত ভাগ নিশ্চিত হয়ে পুলিশ গ্রেফতার করলে গ্রেফতার ব্যক্তিরা বিচারের মাধ্যমে অনেক ক্ষেত্রে মুক্ত হয়ে আসত না। পুলিশ তাই বলে কোনোরকম সাক্ষ্যপ্রমাণ ছাড়াই গ্রেফতার করবে, এটাও আইনের নির্দেশ নয়। আমাদের অপরাধ আইন ও পুলিশি বিধি অনুসারে পুলিশ প্রাথমিক প্রমাণ পেলে কাউকে গ্রেফতার করতে পারে, এমনকি শুধু সন্দেহের কারণেও যে কাউকে গ্রেফতার করতে পারে। পুলিশ বহুক্ষেত্রে তা করে, বাংলাদেশে গ্রেফতারের শিকার হয় এমনকি জাজ্বল্যমান নিরপরাধ ব্যক্তিরাও। যে দেশে অসংখ্য নিরপরাধ ব্যক্তি গ্রেফতার হন, সেখানে শতভাগ নিশ্চিত হয়ে গ্রেফতার করতে চায় পুলিশ—এই বক্তব্য সন্দেহজনক বৈকি। নাকি আমাদের দেশের পুলিশ এখন এতই চৈকস যে শতভাগ নিশ্চিত না হয়ে কোনো গ্রেফতার করে না। তবে ১২ মার্চের বিএনপি’র মহাসমাবেশ সমর্থকদের আসা বন্ধ করতে গণগ্রেফতার করছে। কিসের উপর ভিত্তি করে বা কোন শতভাগ প্রমাণে পুলিশ গণগ্রেফতার করছে? বিএনপি সরকারও করেছিল আওয়ামী লীগ সমর্থকদের গণগ্রেফতার করেছিল, লীগের মহাসমাবেশ ঠেকাতে।
মাননীয় আদালতের কাছে জানতে চাই রুনি-সাগরের খুনের মামলার আসামিদের ব্যাপারে পুলিশ দু’সপ্তাহ পারবে শতভাগ নিশ্চিত হতে? হলে কবে নাগাদ খুনি গ্রেফতার হবে? সাংবাদিকরা কতদিন সাগর-রুনির হত্যাকাণ্ড নিয়ে না লিখলে তদন্ত প্রভাবিত হবে না? আশা করছি আপনার বেধে দেয়া সময়ের মাঝে পুলিশ জানাবে তদন্তের ফলাফল। টালবাহনা করে দিনক্ষেপণ গ্রহণযোগ্য নয়।
পুলিশ তদন্ত রিপোর্ট না দিলে কি হবে এ ব্যাপারে কিছু বলেননি আদালত। দু’সপ্তাহে তদন্ত রিপোর্ট না পেলে কি মেনে নিতে হবে সাগর-রুনি কোন ক্ষমতাধরের স্বার্থে আঘাত হেনেছিল কিংবা ওদের কাছে এমন কোন প্রমান ছিল যা অনেকের ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়? সে কারণে কি ওদের সরিয়ে দেওয়া হলো পৃথিবী থেকে? কিছু ক্ষমতাধর মানুষের দিকে ওঠা সন্দেহের তীর না লক্ষ্যভেদ করে যায়।
সাগর রুনি হত্যাকাণ্ড নিয়ে, এর তদন্ত নিয়ে মানবো না কোনো মনগড়া কাহিনী। আমাদের জান-মালের মতো আমাদের লেখার অধিকারও নিরাপদ নয়। ফিরে পেতে চাই সাগর রুনি হত্যাকাণ্ড নিয়ে লেখার অধিকার। মাননীয় আদালত আরেকটি রুল জারি করুন যাতে আমাদের বাকি প্রশ্নের উত্তর মেলে।
ফারজানা খান গোধুলী, ওয়াশিংটন প্রবাসী সাংবাদিক
বাংলাদেশ সময় ১৮০৭ ঘণ্টা, মার্চ ১০, ২০১২