ঢাকা, শুক্রবার, ১৭ কার্তিক ১৪৩১, ০১ নভেম্বর ২০২৪, ২৮ রবিউস সানি ১৪৪৬

মুক্তমত

শেখ রেহানার বাড়ি ফেরত এক ইতিবাচক নজির

সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল, অতিথি লেখক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২০৫০ ঘণ্টা, মার্চ ১১, ২০১২
শেখ রেহানার বাড়ি ফেরত এক ইতিবাচক নজির

‘কি ঘর বানাইমু আমি শূন্যেরও মাঝার’
              -হাছন রাজা
ছুটির দিন সকালে একটু আয়েস করে ঘুম থেকে উঠেই বাংলানিউজ খুলেই দেখলাম ‘সরকারি বাড়ি ফেরত দিলেন শেখ রেহানা’। নিজের অজান্তেই বললাম-‘ধন্যবাদ শেখ রেহানা’।

কারণ, এটা তাঁর একটা বিরল দৃষ্টান্ত। ধানমণ্ডিতে এক বিঘার পরিত্যক্ত একটি বাড়ি প্রতীকী মূল্যে শেখ রেহানাকে দেয়া হয়েছিলো। কিন্তু কেন দেয়া হয়েছিলো? লন্ডনে তাঁর নিজস্ব বাড়ি থাকলেও ঢাকায় নেই। তাঁদের পৈত্রিক বাড়ি ৩২ নম্বর ধানমণ্ডিস্থ ঐতিহাসিক বাড়িটি বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘরের জন্য দান করে দেন। তবে শেখ হাসিনার স্বামী ওয়াজেদ মিয়ার ‘সুধাসদন’ বাড়িটি ছিলো ধানমন্ডিতেই।

১৫ আগস্ট হত্যাকান্ডের পরও শত্রু ও ষড়যন্ত্রকারীরা থেমে নেই। এক হিসাব মোতাবেক শেখ হাসিনাকে মারার জন্য ছোট বড় ২১ বার অপচেষ্টা করা হয়েছে। তার মধ্যে ২১ আগস্টের ঘটনা সব চাইতে ভয়াবহ। এসব কারণেই নিজের জীবনের নিরাপত্তার কথা ভেবে ১৯৯৬-২০০১ মেয়াদে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় মেয়াদ শেষে প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন গণভবন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নামে ১ টাকার বিনিময়ে বরাদ্দ দেয়ার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। কিন্তু তা আনুষ্ঠানিকতা সমাপ্ত না হওয়ায় তা কার্যকর হয়নি। অনেকই এ বিষয়টি ভালো ভাবে নেন নি। অনেকই বলেছেন, বঙ্গবন্ধুরকন্যাকে দেশের ১৬ কোটি জনগণ যদি ৫০ পয়সা করেও অনুদান করে তাহলেই তাঁর বাড়ি হয়ে যায়। শুধু মাত্র দলের কর্মীরা ১ টাকা করে দিলেও তাঁর বাড়ির সমস্যা হয় না।

সেই সময় গণভবনের পাশাপাশি ২০০১ সালে ১১ জুলাই ধানমন্ডি আবাসিক এলাকার [বাড়ি নং- ২১ (নতুন), সড়ক নং-৬ (৪১/এ পুরাতন) ঠিকানায়] বাড়িটিও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছোট বোন শেখ রেহানাকে নিরাপত্তা আইন পাশ করে তা বরাদ্দ দেয়া হয়। যদিও বাড়িটি ধানমণ্ডি থানা ব্যবহার করে আসছে। হঠাৎ করে বাড়ি না নিয়ে ফেরৎ দেয়ার সিদ্ধান্ত সর্ব মহলেই প্রশংসা কুড়িয়েছে। কারণ একাধিক।

প্রথমতঃ কানাডায় এসে এক সাক্ষাৎকারে শেখ হাসিনা বলেছেন, আমরা আমাদের ছেলেমেয়েরকে লুটপাঠ, দুনীর্তি, জনগণের ধন-সম্পদ চুরির শিক্ষা দেই নি। আমাদের ছেলেমেয়ের দিয়েছি উচ্চশিক্ষা ।

দ্বিতীয়তঃ স্বজন আর সর্বহারা হয়ে লোভ-লালসা-ভোগ এখন হাসিনা-রেহানার কাছে গৌণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

তৃতীয়তঃ দেশপ্রেম আর জনগণের প্রতি তাঁদের বিশ্বাস-ভালোবাসা-আস্থা অনেক অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে।

চতুর্থতঃ এ ধরণের অতীত-ইতিহাস মোটেই সুখকর নয়। তাই বুধোদয়ের বিষয়টি এখানে অত্যন্ত গুরুত্ত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।

পঞ্চমতঃ হাসিনা-রেহানার ছেলেমেয়েরা কেউই বাংলাদেশে থাকেন না। রেহানাও না। একমাত্র শেখ হাসিনাই মাটির সাথে, মানুষের সাথে মিশে আছেন। তাঁর জন্য স্বামীর রেখে যাওয়া ‘সুধা সদন’ই যথেষ্ট।

ষষ্ঠতঃ আধুনিক বিশ্বে রাষ্ট্রপ্রধান বা নেতানেত্রীদের এভাবে এক টাকার বিনিময়ে কোটি কোটি টাকার সম্পদ ভোগ করার কোনো নজির নেই। তাই ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ গড়ার আরেক দৃষ্টান্ত।

সপ্তমতঃ শেখ রেহানার বক্তব্য থেকেই বলা যায়- (১) ‘আমি বঙ্গবন্ধুরকন্যা, এমন বাড়ি আমার কোনো প্রয়োজনে আসছে না। তাই এটি ফেরত দিলাম, (২)এমন বাড়ি আমার প্রয়োজন নেই। ..আমি কোনো পলিটিক্সে (রাজনীতি) নেই। এই নিয়ে আবার কেস (মামলা) খেতে হতে পারে। এর মধ্যে আমি নেই। (৩) তাঁর বড় বোন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘বাড়িটি হস্তান্তরের মধ্য দিয়ে আমরা ভারমুক্ত হলাম। ’

অষ্টমতঃ এই ভারমুক্ত বা দায়মুক্তিতে যেমন জাতির জনক বঙ্গন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হয়েছে, তেমনি দেশের মানুষের মনে তাঁর কন্যাদ্বয়ের ইমেজ অনেক অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে।
নবমতঃ শেখ রেহানার বক্তব্য থেকে একটি বিষয় স্পষ্ট হয় যে, তিনি রাজনীতি করবেন না। তবে ‘রাজনীতি-সংস্কৃতি’ অন্যত্র। তা দিয়েই এই বিশ্লেষণ শেষ করতে চাই।

দশমতঃ ১৯৮১ সালের ৩০ মে চট্টগ্রামে এক ব্যর্থ অভ্যুত্থানে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান নিহত হবার পর তাঁর ভাঙ্গা সুটকেস আর ছেড়া গেঞ্জির কারণে সেই বছরের ১২ জুন অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবদুস সাত্তার ঢাকা সেনানিবাসের ৬ মইনুল রোডের ১৬৮ কাঠার বিশাল বাড়িটি মাত্র এক টাকার বিনিময়ে শহীদ মইনুল সড়কের ৬নং বাড়িটি খালেদা জিয়ার নামে চিরস্থায়ীভাবে বরাদ্দ দেন।
বিরোধী দলের নেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে ১৩ নভেম্বর ২০১১ সালে ‘টেনে হিঁচড়ে বাড়ি থেকে উচ্ছেদ’ করা হয় বলে তিনি সাংবাদিক সম্মেলনে কান্নাকাটি করেন।

শেখ রেহানা এই বাড়িটি ফেরৎ দেয়ার মাধ্যমে অদূর ভবিষ্যতের জন্য এক রকম চমৎকার ‘রাজনীতি-সংস্কৃতি’র নির্মল উদাহরণ স্থাপন করে গেলেন। তাই, ধন্যবাদ বঙ্গবন্ধুর কন্যাকে।

বাড়ি নিয়ে বাড়াবাড়ি প্রসঙ্গে আরো ২/১ টি দৃষ্টান্ত তুলে ধরতে চাই।

একটি হলোঃ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পুত্র সজিব ওয়াজেদ জয়ের বাড়ি নিয়েও প্রতিপক্ষ রাজনীতি করে। মার্কিন যুক্তুরাষ্ট্রে তাঁর দু’টি বাড়ি রয়েছে (3817 Bell Manor Ct, Falls Church, Virginia 22041 এবং 4823 Martin Street, Alexandria, Virginia 22312)। এই বাড়ি নাকি তিনি দুর্নীতি করে বানিয়েছেন। এ নিয়ে চ্যানেল আইয়ে ‘আজকের সংবাদপত্র’ অনুষ্ঠানে গোলাম মোর্তুজার সাথে আলোচনা করেছিলাম যে, উত্তর আমেরিকা বা উন্নত বিশ্বে টাকা-পয়সা ছাড়াই (অর্থাৎ ০শূন্য তথা ডাউন পেমেন্ট দিয়ে ব্যাংকের মাধ্যমে) বাড়িগাড়ি কেনা কোনো ব্যাপারই না। অথচ তা না জেনেই আমাদের সংবাদপত্রগুলোও লেখালেখি করেছে।
অন্যটি হলোঃ ১ টাকার বিনিময়ে রাষ্ট্র প্রধানেরা অনেক রাষ্ট্রীয় সম্পদ অন্যায়ভাবে অপচয় করেছেন। রাষ্ট্রীয় ধন-সম্পদ নিয়ে ব্যক্তি স্বার্থ আদায় করেছেন। যেমন- মহাখালী-গুলশানের মধ্যস্থানে মাওলানা মান্নানের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত গাউসুল আজম মসজিদ। মসজিদের নামে প্রেসিডেন্ট এরশাদ ১ টাকার বিনিময়ে ৮ বিঘা জমি (যার বর্তমান মূল্য ৪০০ কোটি টাকা) দান করেন। সেখানে জমিয়াতুল মোদার্রেছীন দ্বীনের নামে প্রতিষ্ঠিত হলেও এটা আসলে মাওলানা মান্নানের ব্যক্তিগত সম্পত্তি। বরাদ্দকৃত ৮ বিঘা জমির ৫ বিঘা রেজিস্ট্রি করা হয় জমিয়াতুল মোদার্রেছীনের নামে, বাকি ৩ বিঘা রেজিস্ট্রি করা হয় মাওলানা মান্নানের নিজ নামে। জমিয়াতুল মোদার্রেছীনের টাকায় দৈনিক ইনকিলাব প্রতিষ্ঠিত হলেও তা দৈনিক ইনকিলাবের মালিক বোরখা মান্নান ও তার পরিবার।

তাছাড়া বর্তমানে দেশে যুদ্ধাপরাধের বিচার চলছে। মাওলানা মান্নান একজন যুদ্ধাপরাধী। একজন যুদ্ধাপরাধী ব্যক্তির নামে ৮ বিঘা জমিদান কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়। এটাও সরকারি আওতায় আনা একান্ত প্রয়োজন।

saifullahdulal@gmail.com

বাংলাদেশ সময় ২০৪৬ ঘণ্টা, মার্চ ১১, ২০১২

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।