ঢাকা : ‘সরকারই অচল করে দিলো ঢাকা’ উদ্বেগের নগরে অন্তহীন দুর্ভোগ, রাজধানীতে নেমেছে বিজিবি, ঢাকা যেনো নিষিদ্ধ নগরী, তল্লাশির নামে হয়রানি, দেশজুড়ে অঘোষিত হরতাল-আতঙ্ক, বিচ্ছিন্ন ঢাকা, চলছে না বাস, ট্রাক, লঞ্চ-স্টিমার, চলছে না ট্রেনও।
উপরের শিরোনামগুলো আজ ১২ মার্চ প্রকাশিত কয়েকটি জাতীয় পত্রিকার।
বিশেষ করে আমরা যারা সংবাদ মাধ্যমে কাজ করি তাদের কাছে সর্বশেষ খবর তারা যেমন বেশি জানতে চান। পাশাপাশি আমরা যেন সতর্ক থাকি সে ব্যাপারে পরামর্শ দেন।
বিশেষ করে সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনিকে নিজেদের বাসায় হত্যার ঘটনার পরে আমাদের নিয়ে আশঙ্কা যেন আরো বেড়েছে।
সাধারণ মানুষ সাংবাদিকদের অনেক শক্তিশালী মনে করে। কিন্তু সেই সাংবাদিক হত্যাকাণ্ডের যখন মাস পেরিয়ে যায়, অগ্রগতি থাকে না। প্রধানমন্ত্রী নিজে তদারকির পর, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ৪৮ ঘণ্টার হম্বি-তম্বির পরও যখন কোনো খবর বের হয় না। এমনকি কোনো নাটক সাজাতেও ব্যর্থ হয় পুলিশ তখন নিরাপত্তার যে প্রকট অভাব আমরা বোধ করি তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
একটি সভ্য সমাজে গণতন্ত্র বলে যে রাষ্ট্র ব্যবস্থার কথা আমরা জেনে আসছি তা বাংলাদেশের ক্ষেত্রে হয়তো ওভাবে যায় না। আমরা জাতি হিসেবে হয়তো অতোটা সহনশীল নই। কিন্তু তাই বলে বিএনপির ‘চলো চলো ঢাকা চলো’ কর্মসূচি নিয়ে সরকার যে ন্যক্কারজনক মনোভাবের পরিচয় দিলো তা বাংলাদেশের চলমান ও পূর্ববর্তী ইতিহাসের সঙ্গেও তুলনা চলে না।
অনলাইন সংবাদমাধ্যম হিসেবে বাংলানিউজ বিএনপি-আওয়ামী লীগের বড় কোনো কর্মসূচিসহ জাতীয় ঘটনায় পত্রিকার আদলে অনলাইনেই বিশেষ আয়োজন করে থাকে। যা দেশ-বিদেশের কোটি পাঠককে তরতাজা খবর দেয়। এটার কারণে বার্তাকক্ষেও নানা তৎপরতা।
সে হিসেবে বিএনপির আজকের সমাবেশের আগেরদিন রোববার আমার অফিস করার কথা ছিল ১২টার মধ্যেই। প্রতিদিন সকাল না হতেই গাড়ির শব্দে ভেঙে যায় ঘুম, কিন্তু রোববার সে শব্দ নেই। যথারীতি ১০টায় বের হলাম। কিন্তু বিধিবাম। পুরো মিরপুর অতিরিক্ত ভাড়ায় রিকশা করে ঘুরলাম, দেখলাম হাজার হাজার কাজমুখী মানুষের বিষণ্ন মুখ। কারণ, তারা কোনোভাবেই কর্মস্থলে যেতে পারছেন না। রাস্তায় কোনো গাড়ি নেই, নেই কোনো লেগুনা-অটোরিকশা। কিছু রিকশা আছে তা কাছাকাছি জায়গায় পৌঁছানো সম্ভব হলেও দূরের কোথাও যাওয়া অসম্ভব।
শেষ পর্যন্ত কমস্থলে যেতে না পারা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের এক কর্মকর্তা বলছিলেন, শনিবার বিকেলেও বাসায় এসেছি পায়ে হেঁটে। আজ যেতেও পারলাম না। বিএনপির সমাবেশতো কাল। আল্লাহই জানে আমাদের কপালে কি আছে। সরকারই আমাদেরকে বিপদে রাখছে, বিএনপি নয়।
একটি সিগারেট ব্র্যান্ডের এক বিক্রয়কর্মী বলছিলেন, আমরা পারিবারিকভাবে আওয়ামী লীগ করি। কিন্তু আজকে আমাকেও গজারির লাঠির বাড়ি খেতে হয়েছে। যখন সদরঘাটে আজ সকালে নামছিলাম, তখন আমাকে বাইরে আসতেই দিতে চায়নি পুলিশ। অনেক তল্লাশির পর আইডি কার্ড দেখার পরই আমাকে ছাড়লো। সোমবারও একই অবস্থা। সেই সঙ্গে বিজিবি সদস্যরাও মাঠে।
এ দু’টি কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, আমরা সরেজমিন দেখলাম বিএনপির এ কর্মসূচি নিয়ে সরকারের আগ্রাসী ভূমিকা। ৩ দিন ধরে রাজধানীর হোটেলগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। সরকার থেকে যাই বলা হোক না কেন, গাড়ি বের করলে রুট পারমিট বাতিল করা হবে এমন ভয়েই রাস্তায় গাড়ি নেই।
এমনকি বিআরটিসির যেসব গাড়ি নিত্যদিন চলাফেরা করতো তার ১৫ ভাগের ১ ভাগও রাস্তায় নেই। ঢাকার প্রবেশ মুখে পুরোদমে তল্লাশি চলছে। দূরপাল্লার তেমন কোনো বাস ঢাকায় ঢুকছে না এটা কোনোভাবেই অস্বীকার করার সুযোগ নেই। গণগ্রেফতার চলছেই। এ সংখ্যা আমার মনে হয় বিএনপি-জামায়াত যে দাবি করছে তার চেয়েও বেশি হবে। কারণ, নিরীহ অনেক মানুষই অযথাই বিপদে পড়ছেন। কার্যত অচল করে দেওয়া হয়েছে পুরো দেশকে।
বিএনপির এ কর্মসূচি অনেক আগের দেওয়া। আমরা দেখলাম আওয়ামী লীগ-১৪ দল পাল্টা কর্মসূচি দেওয়ার ঘোষণা দিলো। এমনকি মন্ত্রী-এমপিরা ঘোষণা দিতে থাকলেন বিএনপিকে ঢাকায় ঢুকতেই দেওয়া হবে না। তারা তাদের কথা রেখেছেন।
তারা সবকিছু বন্ধ করে, গণগ্রেফতার করে, হাসপাতাল-অ্যাম্বুলেন্স থেকেও আটক করার নজির সৃষ্টি করে, সারাদেশে অঘোষিত ২ দিনের হরতাল দিয়ে সরকার নিজেই এক অরাজক পরিস্থিতির সৃষ্টি করে চলছে। এ যেন নিজের নাক কেটে পরের যাত্রা ভঙ্গের মতো অবস্থা।
আমার খুব জানতে ইচ্ছে করে, যারা হরতালের বিপক্ষে কথা বলেন তারা আজ কোথায়। সরকারের নিজের দেওয়া অঘোষিত এ হরতালের বিরুদ্ধে, কার্যত অচল ঢাকা নিয়ে এফবিসিসিআই সভাপতি, বিকেএমই, বিজিএমই, ডিডিসসিআইর পক্ষে আজতো কোনো বিবৃতি পেলাম না। কেনো পেলাম না তা খুবই জানার ইচ্ছা।
মহাসমাবেশের অনুমতি না দিলে দেবেন না। এটা পরিষ্কার করে ২/৩ দিন আগে জানিয়ে দিলেই হতো। বিএনপিকে মহাসমাবেশের মৌখিক অনুমতির আশ্বাস দিয়ে কার্যত তাদের সাইজ (গ্রেফতার) করার জন্যই কি কি এই বিলম্বনীতি অবলম্বন। আবার অনুমতি দিলেন, তা আবার ১১ শর্তে। যা ভঙ্গ করলে অনুমতি বাতিল করবেন।
সীমানা উল্লেখ করে দিলেন এর বাইরে হবে না। কি আজব তুঘলকি কাণ্ড। পুলিশ কর্মকর্তারা কি ভবিষ্যৎ ভাবেন না। আসলে খারাপ লাগে এ বাহিনীটির জন্য। যাদেরকে ইচ্ছেমতো সব সরকারই ব্যবহার করে। যার কারণে এদের গ্রহণযোগ্যতা সবসময়েই সর্বনিম্নস্তরে অবস্থান করে।
আমার কাছে সবচেয়ে অবাক বিষয়, সরকার কি বিরোধীদলকে বেশি ভয় পায়। তারা অনেক বেশি সংখ্যাগরিষ্ঠতার মাধ্যমে ক্ষমতায়। তারা কেনো ভয় পাবে। বিএনপি একটি সমাবেশ করবে। ৩ ঘণ্টার এ সমাবেশের জন্য তারা কিইবা করবে। আর সরকারের তো গোয়েন্দাবাহিনীসহ র্যাব পুলিশ আছেই। বিজিবিকেই মাঠে নামাবেনই বা কেন। তাদের সীমান্তেই থাকতে দিন না।
বিএনপি জোটের ৩ ঘণ্টার জন্য সরকার ৩ দিনের দুর্যোগ অবস্থা কেন তৈরি করলেন তা বুঝলাম না।
তবে এটা বুঝি, সরকারের মধ্যে এই পরিস্থিতি মোকাবিলা করার জন্য করণীয় নির্ধারণে অনেক বেশি ঘাটতি আছে। আমরা যতই উপদেষ্টা দেখি, তারা যতই কথাবার্তা বলেন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীকে সুপরামর্শ দেওয়ার কাজটি তারা কতটা করেন তাতেই আমার খটকা লাগে।
শুধু তাই নয়, মন্ত্রীদের কথাবার্তা এমনকি সরকারি দলের এমপিরাই যেভাবে বলেন তাতে এটি আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
সরকারের সবার আগে এটি মনে রাখা উচিত, হয়তো আগামী দিন তাদের জন্য সুখকর নাও হতে পারে। তারা যে পথটি দেখাল বিএনপি জোটকে, তা থেকেও তারা শিক্ষা নিতেও পারে। তবে এটি হবে দুভার্গা এ জাতির জন্য আরেকটি বেদনার-আতঙ্কের বিষয়।
তবে সরকারি দলের উসকানিমূলক আচরণের মাঝেও শেষ পর্যন্ত কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়া বিএনপি তাদের কর্মসূচি সফলভাবে পালন করতে পারলে আমরা জনসাধারণ আশাবাদী হয়ে উঠবো।
সামনের দিনগুলোতে সরকার অনেক সহনশীল আচরণ করবে, বিএনপি জোট গণতান্ত্রিক পথে হাঁটবে, প্রয়োজনে সংসদকেই দাবি আদায়ের জন্য বেছে নিবে এ প্রত্যাশা করি।
নূরনবী সিদ্দিক সুইন, সাংবাদিক
nsiddik91@gmail.com