সাতচল্লিশ সালে দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিহীন ব্যাখ্যায় দেশভাগ হলে ১২শ মাইলের ব্যবধানে অবস্থিত পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান নিয়ে গঠিত হয় পাকিস্তান রাষ্ট্র। অখণ্ড ভারত থেকে বিভক্ত হয়ে পাকিস্তান নিজেদের স্বতন্ত্র রাষ্ট্র ও পূর্ব বাংলাকে পাকিস্তানের অংশ বলে দাবি করলেও পাকিস্তানের সকল প্রশাসনিক ক্ষমতা পশ্চিম পাকিস্তান নিয়ন্ত্রণের দ্বারা পূর্ব বাংলার সকল মৌলিক ও রাষ্ট্রীয় অধিকার খর্ব করবার মাধ্যমে বাংলার জনগণকে করে রেখেছিল পরাধীন।
উল্লেখ্য, ৫টি প্রদেশ নিয়ে গঠিত পাকিস্তানের কোন অঞ্চলের ভাষা উর্দু না হওয়া সত্ত্বেও এবং ভাষাভাষীর দিক থেকে গোটা পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালি (৪ কোটি) হওয়ার পরেও পাক সরকার মাতৃভাষা হিসেবে বাংলার পরিবর্তে উর্দুকেই রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্থাপন করতে চায়। তাদের স্পষ্ট ধারণা ছিল, যদি বাংলার মানুষকে স্থায়ীভাবে শোষণ করতে হয় তবে তাদের শিক্ষাব্যবস্থায় ধ্বস আনতে হবে এবং পরিকল্পনামাফিক শিক্ষা ব্যবস্থার প্রচলন ও শিক্ষানীতির প্রণয়ন হবে একটি উৎকৃষ্ট শোষণ পদ্ধতি। তাদের এরূপ পরিকল্পনা ও শোষণ নীতির বিরুদ্ধে পূর্ববাংলার ছাত্রসমাজের আন্দোলন হয়েছিল বুদ্ধিজীবী মহল ও বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষের কাছে স্বীকৃত যা এক পর্যায়ে গণআন্দোলনে রূপ নেয়, জন্ম দেয় ৮ ফাল্গুনের। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারির রক্তস্নাত সেই দিনের কাছে পাক শাসকেরা নতি স্বীকার করতে বাধ্য হয়ে ১৯৫৬ সালে প্রবর্তিত পাকিস্তানের প্রথম সংবিধানে বাংলা ভাষাকেও লিখিতভাবে স্বীকার করে, যদিও সেসময় সংবিধানে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ‘বাংলা ও উর্দু’ দুটোকে একসাথে স্বীকৃতি দেওয়া ছিল আইয়ুব সরকারের পিছু হটার আড়ালে একটি নতুন ষড়যন্ত্র।
প্রেসিডেন্ট আইয়ুবের ভাষ্য অনুযায়ী, বাংলা ও উর্দু যেহেতু কোনটাই এককভাবে সমগ্র পাকিস্তানের ভাষা হতে পারে না সেহেতু এদের মধ্যকার সাধারণ লিখন রীতির মাধ্যমে প্রকাশ করতে হবে। যার বাস্তবায়নে আইয়ুব খানের তোষামোদকারী পরিকল্পনাবিদেরা শরীফ কমিশন ও বাংলা একাডেমি রোমান হরফ প্রবর্তন, বাংলা বর্ণমালা সংস্কার, বিভিন্ন প্রদেশে বাধ্যতামূলক উর্দু শিক্ষা সহ সরাসরি বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ঐতিহ্যকে সংস্কারের মতন বেশকিছু পদ্ধতি অবলম্বনের মাধ্যমে বাংলার শিক্ষা ও সাহিত্যশিল্প ধ্বংসে কৌশলগত ভূমিকা পালন করেছিল। কবি কাজী নজরুল ইসলামের বিখ্যাত কবিতা- চল্ চল্ চল্ এর ‘সজীব করিব মহাশ্মশান’ চরণের সংশোধনে ‘সজীব করিব গোরস্থান’ এবং ‘সকালে উঠিয়া আমি মনে মনে বলি, সারাদিন আমি যেনো ভালো হয়ে চলি’ এর সংশোধনে ‘ফজরে উঠিয়া আমি দিলে দিলে বলি, সারাদিন যেন আমি নেক হয়ে চলি’ ছিল যার প্রমাণস্বরূপ।
শুধুই কৌশলগত পন্থায় নয়, ভাষা আন্দোলনে ন্যাক্কারজনক পুলিশি হামলাসহ ৪৭ থেকেই শিক্ষাব্যবস্থায় পশ্চিম পাকিস্তান কর্তৃক পূর্ব পাকিস্তানের ওপর চলমান বৈষম্য ও শোষণ-নিপীড়ন ছিল পৃথিবীর ইতিহাসে নজিরবিহীন। দেশভাগের পর থেকেই পূর্ব পাকিস্তানকে শিক্ষা গ্রহণের সকল সুযোগ থেকে আশংকাজনক হারে পিছিয়ে দেওয়া হচ্ছিল। পূর্বাঞ্চলের জনসংখ্যা পশ্চিমের তুলনায় বেশি হলেও এখানে শিক্ষার হার, পর্যাপ্ত শিক্ষকের পরিমাণ, পাঠদানের উপযুক্ত পরিবেশ ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা যেমন ভয়ানক গতিতে কমেছে ঠিক তার দ্বিগুণ গতিতে বেড়েছে পশ্চিমে। এছাড়া ছাত্রছাত্রীদের অনাকাঙ্খিত ড্রপআউটের পরিমাণ ছিল পূর্বাঞ্চলে অনেক বেশি। শিক্ষাখাতে সরকারি ব্যয় ও বরাদ্দের পরিমাণও পশ্চিম পাকিস্তানের তুলনায় পূর্ববঙ্গে ছিল নামমাত্র।
একটি রিপোর্টের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ১৯৪৭-৪৮ সালে পূর্ব পাকিস্তানে প্রাথমিক বিদ্যালয় ছিল ২৯ হাজার ৬৩৩টি। এর ৫ বছর পরে ১৯৫৪-৫৫ সালে এই সংখ্যাটি কমে দাঁড়ায় মাত্র ২৬ হাজারে। ঐ সময়ের সরকারি পরিসংখ্যান মোতাবেক ১৯৫০-৬২ সালে পূর্ব পাকিস্তানে মোট প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা ছিল ২৭ হাজার ১৫৪টি। অন্যদিকে যে পশ্চিম পাকিস্তানে ১৯৫০ সালে ১১ হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয় ছিল, মাত্র ১২ বছরেই সে সংখ্যা গিয়ে দাঁড়ায় ২৮ হাজারেরও বেশিতে। উক্ত প্রতিবেদনের তথ্য বিশ্লেষণে শুধুমাত্র প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও মহাবিদ্যালয় নয়, শিক্ষক নিয়োগেও সেসময় চরম বৈষম্য পরিলক্ষিত হয়েছে। ১৯৫০-৬২ সালে পূর্ব পাকিস্তানে নতুন নিয়োগপ্রাপ্ত সহ মোট শিক্ষক সংখ্যা ছিল মাত্র ১৯ হাজার, অন্যদিকে পশ্চিম পাকিস্তানে সেই সংখ্যা দ্বিগুণেরও বেশি বেড়ে দাঁড়ায় ৪০ হাজারের ঘরে [তথ্যসূত্র: বাংলাদেশের ছাত্র আন্দোলনের ইতিহাস, ড.মোহাম্মদ হান্নান]।
শিক্ষা ব্যবস্থায় সাম্প্রদায়িকীকরণ,পূর্ব ও পশ্চিম প্রদেশের মধ্যবর্তী বৈষম্য, গণবিরোধী শিক্ষানীতি প্রণয়নসহ পূর্ব বাংলার জনগণের অধিকার খর্বকারী ইস্যুগুলোর প্রতিবাদে ছাত্র আন্দোলন বাষট্টিতে আবারো প্রকট রূপ ধারণ করে।
শরীফ শিক্ষা কমিশন ও ৬২’র ছাত্র আন্দোলন
ভাষা আন্দোলনের রেশ তখনো কাটেনি। জাতীয় ভাষা ও জাতীয়তার প্রশ্নে ষড়যন্ত্রবিরোধী আন্দোলনে পূর্ববাংলা তখনো সরগরম। এমন পরিস্থিতিতে ১৯৬২ সালে প্রকাশিত শরীফ শিক্ষা কমিশন নতুন ইতিহাসেরই সূত্রপাত ঘটায়। অত্যন্ত চাটুকারিতার সাথে তৈরি করা এই কমিশনে শিক্ষাকে একটি ব্যবসায়িক ক্ষেত্র হিসেবে দেখানো হয়েছে। যেখানে বলা হয়েছে, শিক্ষা নাগরিকের জন্মগত অধিকার নয় এবং শিক্ষা এমন একটি উপাদান যা মূলত বিনিয়োগ ও লাভ লোকসানের মাধ্যম হিসেবেই পরিচালিত হবে। এখানে স্পষ্টভাবেই বলা হয়েছে ‘শিক্ষা সস্তায় পাওয়া সম্ভব নয়’। একটি রাষ্ট্র ঠিক কতটা উন্নত ও শক্তিশালী হবে তা নির্ভর করবে ঐ রাষ্ট্রের কত বেশি জনগণ শিক্ষিত সে রেশিও এর ওপর ভিত্তি করে। কাজেই একটি রাষ্ট্রের শতভাগ শিক্ষিতের হার নিশ্চিত করা রাষ্ট্রীয় স্বার্থেই সরকারের কর্তব্য। কিন্তু আইয়ুব সরকারের এস.এম. শরীফ প্রদত্ত শিক্ষা কমিশন ছিল এ নীতির সম্পূর্ণ উলটো। এই কমিশন ‘অবৈতনিক শিক্ষা’ এর ধারণাকে সম্পূর্ণ অবাস্তব ও অসম্ভব বলে আখ্যায়িত করে। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে স্নাতক (ডিগ্রী) কোর্সকে সম্প্রসারণ করে ৩ বছর মেয়াদী করবার প্রস্তাবও এখানে গৃহীত হয় যা বাস্তবায়িত হলে শিক্ষা গ্রহণের পথ হতো আরও বেশি সময়সাপেক্ষ ও ব্যয়বহুল এবং তৎকালীন সময়ে অধিকাংশ ছাত্রছাত্রীর পক্ষে তা বহন করা অসম্ভব ছিল।
শরীফ শিক্ষা কমিশন দ্বারা প্রস্তাবিত রিপোর্ট স্পষ্টতভাবেই এমন একটি পরিবেশ তৈরি করেছিল যেখানে শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ ছিল শুধুমাত্র বড়লোকেদের সন্তানের। শিক্ষাব্যবস্থাকে বাণিজ্যিকীকরণের কারণে মেধাবী হওয়ার পরও উচ্চশিক্ষা গ্রহণের অধিকার ও সুযোগ দরিদ্র ঘরের সন্তানদের ছিল না। পাকিস্তান শাসকগোষ্ঠীর এরকম বৈষম্যমূলক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বোঝা যায়, এরা পূর্ব বাংলাকে কখনোই পাকিস্তান রাষ্ট্রের অংশ হিসেবে মনে করেনি বরং রাষ্ট্র ক্ষমতার জোরে পূর্ব বাংলাকে শোষণের একটি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র বা অঞ্চল বলেই মনে করতো। সে সময় গণবিরোধী এসকল সিদ্ধান্ত বাতিলের দাবিতে বাংলার প্রগতিশীল ছাত্রসমাজের নিয়মিত আন্দোলন ও ছাত্রনেতাদের কৌশলগত অবস্থান সকল শ্রেণী-পেশার বিশেষ করে শিক্ষকমহল ও মেহনতি মানুষের মাঝে ব্যাপক সাড়া ফেলে এবং ছাত্র আন্দোলন প্রকট হয়ে গণআন্দোলনে রূপ নেয়।
বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন, ঢাকা কলেজ সংসদের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক ছাত্রনেতা কাজী ফারুক আহমেদ ১৯৬২ সালের ১০ আগস্ট একটি ছাত্রসমাবেশে বক্তব্যদানের সময় উল্লেখ করেছিলেন, “শিক্ষার আন্দোলন ও গণতন্ত্রের আন্দোলন একই সূত্রে গাঁথা”। প্রতিনিয়ত বেগবান এই আন্দোলন ও সভা সমাবেশের ধারাবাহিকতায় ১৯৬২ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর ছাত্র জনতার পক্ষ থেকে সারাদেশে একটি হরতাল কর্মসূচি আহ্বান করা হয়। সেদিনের মিছিলে বিনা উষ্কানিতে পুলিশের অতর্কিত গুলিবর্ষণে শহীদ হন বাবুল, মোস্তফা, ওয়াজিউল্লাহ এবং সারাদেশে আরো সহস্রাধিক আহত হন। এই ঘটনায় আন্দোলন, সভা ও সমাবেশ আরো বেশি অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়াতে আইয়ুব সরকার শরীফ শিক্ষা কমিশনের রিপোর্টের বাস্তবায়ন স্থগিত করতে বাধ্য হয়। অবশেষে শহীদদের প্রাণের বিনিময়ে বাষট্টির ছাত্র আন্দোলন বিজয় অর্জন করে।
কেমন হওয়া উচিত আমাদের শিক্ষা? কেমন হওয়ার কথা ছিল পূর্ব পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থা?
চারকোণার সার্টিফিকেট কিংবা ডিগ্রীধারী হলেই কাউকে পরিপূর্ণ শিক্ষিত বলা যায় না। শিক্ষা শব্দটির সাথে নৈতিকতা ও সৃজনশীল চর্চার একটি ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। বর্তমানে বাংলাদেশের প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষার্থীদের জীবনযাত্রা এমন এক ধারায় চলছে যেখানে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকেরা বিরতিহীনভাবে একপ্রকার দৌড় প্রতিযোগীতার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, টপার কিংবা গোল্ডেন এ প্লাস এর প্রতিযোগীতায় শিক্ষার্থীদের দিনের একটি বড় অংশ স্কুল কলেজে অতিবাহিত হওয়ার পরেও ঝুঁকে পড়ছে প্রতি বিষয়ের জন্য একাধিক কোচিং সেন্টার কিংবা হোম টিউটরের কাছে। যেকোনও কিছুর বিনিময়ে র্যাংকিং শীর্ষে যেতে অবলম্বন করছে মুখস্থবিদ্যা ও শর্টকাট পদ্ধতির ওপরে। ফলে শিক্ষার্থীদের মন থেকে হারিয়ে যাচ্ছে চিন্তা-চেতনার সৃজনশীলতা। বাংলাদেশে প্রতিবছর ব্যাচভিত্তিক বহু গোল্ডেন এ প্লাসধারী বের হলেও মেধা ও মননের পরিপূর্ণ বিকাশ অধিকাংশের মাঝেই হচ্ছে না।
সমাজের এই অসুস্থ পরিবেশ ও বিরামহীন চর্চায় অধিকাংশ শিক্ষার্থীই তাদের পছন্দানুযায়ী সাব্জেক্ট ও আগ্রহের জায়গা নিয়ে পড়ালেখা ও ক্যারিয়ার গঠনের সুযোগ পাচ্ছে না। ভালো মার্কস পেলেও নৈতিকতা ও মূল্যবোধ অর্জনের জায়গায় এই প্রজন্মের শিক্ষার্থীরা ভয়ংকর রকমের পিছিয়ে পড়ছে। একটা সময় ছিল যখন শিক্ষার্থীরা নির্ধারিত একাডেমিক পাঠ্যবইয়ের পাশাপাশি বাহ্যিক জ্ঞান আহরণের জন্য গল্প ও ছড়ার বই পড়তো, সাহিত্যচর্চা করতো, খেলাধূলা করতো, বিভিন্ন বিনোদনমূলক টাস্ক ও কুইজ, চিত্রাংকন প্রতিযোগীতায় অংশ নিত। কিন্তু বর্তমান সময়ে অধিকাংশ শিক্ষার্থী একাডেমিক বইয়ের বাইরে মোবাইল গেমিং, সোশ্যাল মিডিয়া ছাড়া বিকল্প কিছুই চিন্তা করতে পারে না। প্রজন্মের ছোট একটি অংশ সাংস্কৃতিক ও প্রগতিশীল কর্মকাণ্ডের সাথে যুক্ত থাকলেও বৃহৎ অংশ গ্যাং কালচারের সাথে জড়িত।
ফলশ্রুতিতে আমাদের বর্তমান প্রজন্মের সিংহভাগই বাংলাদেশের ইতিহাস ও মুক্তিযুদ্ধ, দেশের জাতীয় দিবস ও জাতীয় উৎসবগুলোর সম্পর্কে সাধারণ জ্ঞান রাখে না, বাংলাদেশি হয়েও স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস সহ জাতীয় দিবসগুলোর প্রেক্ষাপট সম্পর্কে জানে না, একজন শিক্ষার্থী হয়ে শিক্ষকের প্রতি দায়িত্ব, কর্তব্য ও আচরণ কেমন হওয়া উচিত, পরিবহন চালক, হকার কিংবা যেকোন পেশা ও স্তরের শ্রমিকদের সাথে কিরকম ব্যবহার করা জরুরি সেই নৈতিক মূল্যবোধ সম্পর্কে শেখে না।
সর্বোচ্চ সংকট পরিলক্ষিত হয় তখনই যখন দেখা যায় ভাষা আন্দোলন থেকে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে জানবার আগ্রহ বর্তমানের কাছে নেই বরং দেশের প্রেক্ষাপট অনুযায়ী ইতিহাস, অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যত পরিস্থিতি নিয়ে চর্চা ও আলোচনা রীতিমত অলাভজনক কিছু বিষয় এবং সময়ের অপচয় বলেই তাদের কাছে মনে হয়। ফলে আমাদের বর্তমানেরা রাজনৈতিকভাবে সচেতন না, সংবিধানের চারটি মূলনীতি ও নাগরিক হিসেবে সকল মৌলিক ও গণতান্ত্রিক অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে সোচ্চার না। চলমান শিক্ষা সংকট নিরসন ও শিক্ষার সুষ্ঠু অধিকার নিশ্চিত করতে ভুক্তভোগী হওয়ার পরও শিক্ষার্থীদের বড় অংশের মধ্যেই কোনপ্রকার দায়বদ্ধতা দৃষ্টিগোচর হয় না। অথচ এমন একটি বাংলাদেশের জন্য মুক্তিযুদ্ধ হয়নি। শুধুমাত্র ভাষা ও শিক্ষার অধিকার আদায় থেকে স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য বাঙালি যেসকল আন্দোলনের সাক্ষ্মী এরূপ বৃহৎ পর্যায়ের আন্দোলন এই ইস্যুতে পৃথিবীর অন্য কোনও দেশে ঘটেনি।
সেসকল আন্দোলনের ইতিহাস পড়লে জানা যায়, প্রত্যেকটি আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটেছিল স্বনামধন্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ ও মেডিক্যাল কলেজগুলো থেকে এবং সকল আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিলেন দেশের মেধাবী শিক্ষার্থীরা যাদের অনেকে শহীদ হয়েছেন আবার অনেকেই পরবর্তীতে বুদ্ধিজীবী, শিল্পী, লেখক, গবেষক, সংস্কৃতিকর্মী, শিক্ষক সহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পেশায় নিয়োজিত হয়ে বাংলাদেশকে প্রগতিশীলতার দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে দিতেও কাজ করেছেন।
১৯৬১ সালে প্রকাশিত একটি গোয়েন্দা রিপোর্টের তথ্য অনুযায়ী, পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে যেসকল ছাত্র রাজনীতির সাথে যুক্ত হতো তাদের অধিকাংশই ছিল কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবীরা। যাদের বেশিরভাগই আবার যুক্ত ছিল বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের সাথে। একথা সত্য যে, ছাত্র আন্দোলন ও ছাত্র রাজনীতির সংজ্ঞা কখনোই অপবিত্র হতে পারে না এবং তৎকালীন আন্দোলন সংগ্রাম ও রাজনীতিতে মেধাবী ছাত্রদের সম্পৃক্ততা ও ভূমিকা এটাই প্রমাণ করে, মেধাবীদের মনগড়া যুক্তি দিয়ে জনগণের অকল্যাণকর ব্যক্তিগত এবং দলীয় স্বার্থ ও উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন এবং নাগরিক অধিকার খর্ব হয় এমন কাজ করা খুব একটা সহজ কাজ না। তাঁদের আত্মত্যাগ, শ্রম ও মেধা দ্বারা সাতচল্লিশ থেকে একাত্তর পর্যন্ত বহু লড়াই সংগ্রাম পেরিয়ে আমরা পূর্ব পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ নামের একটি স্বাধীন রাষ্ট্র পেলেও কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য ও স্বপ্ন আজো পুরোপুরি বাস্তবায়িত হয়নি।
এখনো পথে-ঘাটে অনেক শিশু ও বালক দেখা যায়, যারা অভাব অনটনের কারণে পড়ালেখা ছেড়ে রোজগারের জন্য কায়িক শ্রমকে বেছে নিয়েছে। আজও শহরের ফুটপাতে কিংবা বস্তিতে জন্মানো শিশুদের দু’বেলা যেখানে খাওয়া জোটে না, পড়ালেখা সেখানে তাদের জন্য অবাস্তব কল্পনা। এখনও প্রত্যন্ত অঞ্চলের বহু কিশোর-কিশোরীর প্রাইমারির গন্ডি পেরুবার পরেই পড়ালেখা বন্ধ হয়ে যায়। অথচ বাংলাদেশে সংঘটিত ছাত্র আন্দোলনের অনেকগুলো উদ্দেশ্যের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ একটি এজেন্ডা ছিল- সকলের শিক্ষার অধিকার নিশ্চিত করা। একবার ভাবুন তো, যদি কি-না সেই সকল সুবিধা ও অধিকার বঞ্চিত শিশুদের জায়গায় আমরা থাকতাম!
যেদিন সার্টিফিকেট এর গন্ডি পেরিয়ে আমাদের চেতনা শিক্ষিত হবে, সেদিনই হবে আলোড়ন, ঘটবে বিপ্লব, দেখা মিলবে চিরস্থায়ী মুক্তির। আজকের মহান শিক্ষা দিবসে ১৯৬২ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর পুলিশের গুলিতে নিহত সকল শহীদদের জানাই বিনম্র শ্রদ্ধা।
লেখক: সভাপতি, বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন, কোতয়ালী শাখা, চট্টগ্রাম।
বাংলাদেশ সময়: ১৩১৩ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১৭, ২০২২
এসি/টিসি