আমার জানা মতে, বাংলাদেশ সরকার বেতন ভাতা প্রদান করে এমন সব চাকরিতে যোগদান করার প্রথম মাস থেকেই বেতনের টাকা হাতে পাওয়া যায় নতুবা যোগদানের তারিখ থেকে বেতন ভাতা প্রাপ্তির নিশ্চয়তা থাকে, শুধুমাত্র এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের ক্ষেত্রে এ কথা খাটে না।
এমপিও পদে যোগদানকারী শিক্ষকদের এমপিওভুক্ত হতে কত মাস সময় লাগতে পারে, এটা কেউ নির্দিষ্ট করে বলতে পারবে না।
তারপর সেই আবেদন সামান্য কোনো ভুলের কারণে সংশ্লিষ্ট শিক্ষা ডিপার্টমেন্টের কোনো স্তর থেকে এপ্রুভ না হলে, আবার পরবর্তী জোড় মাসের ৮ তারিখের মধ্যে আবার নতুন করে এমপিও আবেদন করতে হবে এবং সেই এমপিও আবেদন প্রক্রিয়া আবার প্রথম স্তর থেকে শুরু হবে। এটা কেমন সিস্টেম? একজন ব্যক্তি সরকারিভাবে নিয়োগের সুপারিশ পেয়ে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করার পরেও কেনো বেতনের সরকারি অংশ পেতে এত বেশি ভোগান্তিকর প্রক্রিয়া থাকবে?
অন্যান্য ডিপার্টমেন্টে যে কোনো মাসের শেষ দিকে যোগদান করলেও উক্ত মাস শেষেই প্রথম বেতন হাতে পাওয়া যায়। কিন্তু অনলাইন এমপিও আবেদনের এই কঠিন প্রক্রিয়ার যাঁতাকলে পড়ে একজন শিক্ষক কবে প্রথম বেতন হাতে পাবেন তার কোনো নিশ্চয়তা নাই। তাই আমি ব্যক্তিগতভাবে এমন সিস্টেম মেনে নিতে পারছি না, অন্তত এই ডিজিটাল যুগে। ডিজিটাল যুগে শিক্ষকদের বেতন পাবার প্রক্রিয়া হওয়া উচিৎ একদম সহজ ও স্বচ্ছ। কারণ ডিজিটাল প্রযুক্তির প্রধান সুবিধাই হলো মানুষের জটিল জটিল কাজকে সহজ করে তোলা। সময় সাপেক্ষ দাপ্তরিক কাজ দ্রুত সময়ে সম্পন্ন করা ডিজিটাল মাধ্যমের দ্বারা সম্ভব হচ্ছে। কিন্তু এমপিও আবেদন প্রক্রিয়াটা অনলাইনে নিয়ে আসার পরেও এটা এখনো অত্যন্ত ভোগান্তিকরই রয়ে গেলো।
শিক্ষকতা জীবনের শুরুতে এমপিওভুক্ত হয়ে বেতন পাবার বিষয়ে একজন শিক্ষককে যে কত বেশি মানসিক চাপ সহ্য করতে হয় তা শুধুমাত্র ভুক্তভোগীরাই বুঝতে পারবেন। সেই সাথে চরম আর্থিক সমস্যায় ভুগতে হয়। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উচিৎ এমপিওভুক্তির এই জটিল প্রক্রিয়া সহজ করা, যাতে শিক্ষকতা পদে যোগদানের প্রথম মাস থেকেই এমপিওভুক্ত হয়ে একজন শিক্ষক বেতনের টাকা হাতে নিতে পারে। বর্তমান এমপিওভুক্তির যে অনলাইন প্রক্রিয়া চালু আছে, তাতে শিক্ষককে আসলে এক প্রকারের অবজ্ঞা করা হচ্ছে বলে আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি এবং শিক্ষকের আর্থিক নিরাপত্তার বিষয়ে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় এর উদাসীনতা এবং কম গুরুত্ব দেওয়ার ব্যাপার স্পষ্ট বলে প্রতীয়মান হচ্ছে।
অমরা অনেকেই হয়তো বলতে পারি যে, শিক্ষকতা মহান পেশা, শিক্ষক হলো সম্মানের পেশা, তাদের টাকার দরকার কি? কিন্তু আমরা যদি উন্নত বিশ্বের দিকে তাকাই, শুধু উন্নত বিশ্ব নয় আমাদের সমপর্যায়ের অর্থনীতির দেশগুলোর দিকেও তাকাই, তাহলে দেখতে পাবো সে সব দেশে শিক্ষকতা চাকরির প্রথম মাস থেকেই শিক্ষক বেতন হাতে পাওয়া শুরু করে। এ ক্ষেত্রে আমার দেশ কেনো পিছিয়ে থাকবে? পৃথিবীর প্রতিটা রাষ্ট্রের সাথে তুলনা করলে আমাদের ডিজিটাল ক্ষেত্রে অগ্রগতি কি কম অর্জিত হয়েছে?
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ যখন ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছিলো ও ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার কাজে আত্মনিয়োগ করেছিলো, সে সময় আমাদের থেকে কিছু সংখ্যক উন্নত অর্থনীতির দেশও ডিজিটাল সিস্টেমের প্রতি এত গুরুত্ব দেওয়া শুরু করেনি। তাহলে আজকের ডিজিটাল বাংলাদেশে শিক্ষকদের অনলাইন এমপিওভুক্তির প্রক্রিয়া এত বেশি সেকেলে থাকবে কেনো?
তাছাড়াও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে বাংলাদেশের আধা-সরকারি শিক্ষকদের বেতন পাওয়ার সিস্টেমে এতো এতো ভোগান্তির কথা যদি ফলাও করে প্রচার হয়, তাহলে অন্যদেশের নাগরিকদের কাছে আমাদের দেশের প্রতি ভাবমূর্তি নষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। যার ফলে বহির্বিশ্বের কাছে বর্তমান সরকারের পর্বতসম উচ্চতার বিভিন্ন বড় বড় সাফল্যকে ম্লান করে দেয়ার সম্ভাবনা থেকে যাচ্ছে।
শিক্ষকতা চাকরিতে সম্মান আছে ঠিকই কিন্তু শুধু সম্মান দিয়ে পেট ভরে না বরং শুধুমাত্র অর্থনীতিক কারণে একজন শিক্ষককে পদে পদে আত্মসম্মান ও সামাজিক স্ট্যাটাস রক্ষা করতে গিয়ে বিব্রতকর পরিস্থিতির শিকার হতে হচ্ছে। ধরুন একজন শিক্ষক যোগদান করার সাথে সাথে এমপিওভুক্ত না হতে পারার কারণে কারো কাছ থেকে অর্থ ঋণ করলো, মুদির দোকানে বাকি খেলো। কিন্তু দেখা গেলো তার অনলাইন এমপিও আবেদন বার বার সামান্য কারণে এপ্রুভ না হওয়ার ফলে বেতন পাচ্ছে না। তাই ঋণ আরো বেড়ে গেলো, বাকির পরিমানও বেড়ে গেলো। কিন্তু ঋণ দাতা ও মুদির দোকান সহ বিভিন্ন দোকানের বাকিদাতা কত দিন শিক্ষকের কাছে টাকার জন্য চাপ না দিয়ে থাকবেন? আবার দূরে চাকরি হলে বেতন হতে দেরি হচ্ছে বলে কোনো পরিবহন কি ভাড়া মাফ করে দিবে অথবা পরে নিবে? দেখা যাচ্ছে বাংলাদেশের এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের চাকুরিপ্রাপ্তির পরে এরকম কঠিন পরিস্থিতির মধ্য থেকে দিন যাপন করতে হয়। এমপিওভুক্তিকরণের জটিল ও সময়সাপেক্ষ প্রক্রিয়ার কারণে একজন শিক্ষক যে কত রকমের সামাজিকভাকে কঠিন পরিস্থিতির মোকাবেলা করে তা বলে বোঝানো যাবে না। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়য়ের দ্বায়ীত্বশীল সকলকে শিক্ষকের এই কঠিন পরিস্থিতি উপলব্ধি করা প্রয়োজন। এবং যে কোনো মূল্যে অনলাইন এমপিওভুক্তিকরণের এই জটিল প্রক্রিয়াকে সহজ করা জরুরি দরকার।
এনটিআরসিএ এর মাধ্যমে নিয়োগ সুপারিশপ্রাপ্ত বেশিরভাগ শিক্ষকই এমপিও আবেদনের এই কঠিন ও অত্যান্ত ভোগান্তিকর প্রক্রিয়া সম্পর্কে আগে থেকে জানেন না। এই না জানার ফলে চাকরিতে যোগদানের পরে যখন এমপিও আবেদন করতে হয় তখন শিক্ষা অফিসে তদবিরের নামে কিছু অসৎ লোক (এদের ভিতরে অনেক নামধারী শিক্ষকরূপি দালাল স্বভাবের লোক থাকাও অস্বাভাবিক নয়) নতুন যোগদানকৃত শিক্ষকদের কাছ থেকে মোটা অংকের অর্থও নিয়ে থাকে এমনও শুনেছি। এমনিতেই নতুন যোগদানকৃত শিক্ষকগণ এ ক্ষেত্রে অনভিজ্ঞ এরং নতুন কর্মক্ষেত্রে কিছুটা অসহায় তার উপর সমাজের কিছু বাজে লোক এদের কাছ থেকে শিক্ষা অফিসে ঘুষ দেওয়া লাগবে বা অন্য কোনো ছলচাতুরি গ্রহণপূর্বক অর্থ আদায় করে থাকে বলে শোনা যায়। সেই সাথে শিক্ষা অফিসেরও একশ্রেণীর অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারী ঘুষ ছাড়া কাজ করেন না, এমন মৌখিক অভিযোগও শিক্ষক সমাজে প্রচলিত আছে। মানে ভোগান্তির কোনো সীমা নেই। আবার এমনও শুনি যে এনটিআরসিএ এর মাধ্যমে নিয়োগ সুপারিশ পাওয়ার পরেও কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ম্যানেজিং কমিটিও নতুন শিক্ষকের কাছে টাকা দাবি করে বসেন। বর্তমান চাকরিবাজারে সোনার হরিণ সম একটা চাকরি পাওয়ার পরে যাতে আবার ম্যানেজিং কমিটির কারণে সমস্যায় পরড়তে না হয়, এ বিষয়ে ভিতু হয়ে গোপনে কিছু লেনদেন করেন বলেও অনেকে বলেন। আমার মতে, অসৎ লোকের সাথে আপস না করে, এরকম পরিস্থতির শিকার হলে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট দপ্তরে অভিযোগ করা একান্ত কর্তব্য।
শিক্ষকরা মানুষের মতো মানুষ গড়ার কারিগর। তাই প্রতিটা অনিয়মের ক্ষেত্রে শিক্ষকদের প্রতিবাদী হওয়া উচিৎ। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, অনলাইন প্রক্রিয়ায় এমপিওভুক্তিতে বিড়ম্বনার শিকার শিক্ষকদের নিজেদের সমস্যা ও এ সমস্যা থেকে উত্তরণের উপায় সম্পর্কে গণমাধ্যমে তুলে ধরা উচিৎ। শিক্ষকদের দ্রুত এমপিওভুক্ত করে দেয়ার জন্য যেই ঘুষ চাইবে, শিক্ষকদের উচিৎ এর প্রতিবাদ করা ও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের এ বিষয়ে বিস্তারিত বর্ণনা সহকারে অভিযোগ জানানো। বর্তমান ডিজিটাল বাংলাদেশে মন্ত্রণালয়ের সর্বোচ্চ পর্যায়েও সহজে যোগাযোগ করা খুব সহজভাবে সম্ভব, ইমেইলের মাধ্যমে। তাই বর্তমানে যে কোনো ধরনের অভিযোগ ও সুন্দর আইডিয়া একদম ওপরের পর্যায়ে পৌঁছানো সহজ। অন্যরা ভয় পেলে পাক অন্তত শিক্ষকদের সহজভাবে সত্য কথা বলতে ভয় পেলে চলবে না। কারণ শিক্ষকের ব্যক্তিত্বের ছোঁয়া পড়ে বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থীর ওপর। শিক্ষক ব্যক্তিত্ববান, সাহসী ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে যোদ্ধা হলে পুরো জাতির ওপর এর ইতিবাচক প্রভাব পড়ে। একজন আদর্শ শিক্ষক বহু শিক্ষার্থীর অনুপ্রেরণা।
গণতান্ত্রিক দেশে সরকারি ব্যবস্থাপনায় কোনো ত্রুটি থাকলে সে বিষয়ে আলোচনা-সমালোচনা করতে হয়। এর মাধ্যমেই বেরিয়ে আসে কঠিন সমস্যারও সহজ সমাধান।
আশা করি যোগদানের প্রথম মাস থেকেই শিক্ষক এমপিওভুক্তি হয়ে বেতনের টাকা হাতে পাওয়ার ব্যাপারে শিক্ষা মন্ত্রণালয় দ্রুত পদক্ষেপ নেবে।
লেখক: ট্রেড ইন্সট্রাক্টর, কম্পিউটার অ্যান্ড ইনফরমেশন টেকনোলজি, ভংগা কাদিরাবাদ মাধ্যমিক বিদ্যালয়, কাজিরহাট, মেহেন্দিগঞ্জ, বরিশাল।