বর্তমান বাজারে সবচেয়ে সস্তার প্রাণিজ আমিষের অন্যতম পোল্ট্রি মুরগি ও ডিম। দেশে পোল্ট্রি ব্যাপক কর্মসংস্থানমুখী একটি সমৃদ্ধ শিল্প।
এক দশক আগেও দেশের জনগণ বছরে গড়ে ৫০টির বেশি ডিম খেতে পারত না। এখন বছরে গড়ে ১৩৬টি করে ডিম খাচ্ছে। আর ব্রয়লার মুরগির মাংস খাদ্য তালিকায় অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে উঠেছে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, একজন মানুষের ন্যূনতম পুষ্টি চাহিদা পূরণে খাদ্য তালিকায় বছরে ১০৪টি ডিম থাকা দরকার।
প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের লাইভ স্টক ইকোনমির তথ্য অনুসারে, ২০২১-২২ অর্থবছরে দেশে ডিম উৎপাদিত হয়েছে ২৩ কোটি ৩৫ লাখ ৩৫ হাজার বা মাথাপিছু ১৩৬টি। ২০১২-১৩ বছর ছিল ৭ কোটি ৬১ লাখ ৭৪ হাজার। সে হিসাবে এক দশকে বছরে ডিমের উৎপাদন বেড়েছে ১৫ কোটি ৭৩ লাখ ০৬ হাজার। যা এক দশকে ডিমের উৎপাদন বেড়েছে তিন গুণ। একই সঙ্গে ভোক্তার ডিম খাওয়ার পরিমাণও বেড়েছে।
তবে খামারিদের দাবি, অন্যান্য পণ্যের দাম যেভাবে বাড়ছে সে তুলনায় ডিমের দাম না বাড়ায় নানামুখী চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে পোল্ট্রিশিল্প।
এই মুহূর্তে বাজারে প্রায় প্রতিটি নিত্যপণ্যের দাম বাড়তি। জীবনযাত্রার ব্যয় মেটাতে হিমশিম খাচ্ছে মানুষ। এরমধ্যে ডিমের মূল্য বৃদ্ধি নিয়ে বেশ সরগরম সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ সর্বত্র। অথচ আমার কখনো ভেবে দেখেছি, প্রান্তিক কৃষক পর্যায়ে একটি ডিম উৎপাদন খরচ কত? প্রতিটা খামারে প্রতিদিন কত কেজি মুরগির খাবার লাগে? আর সেই মুরগির খাবারের দাম কতটা বেড়েছে? সেগুলো নিয়ে কোনো চিন্তা নেই! আছে শুধু কৃষকের পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি নিয়ে। অথচ দেশের সব মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানি নিরবে জনগণের পকেট কাটছে!
ট্যারিফ কমিশনের তথ্য অনুযায়ী, আধা লিটার ধারণ ক্ষমতার পেট বোতল তৈরি করতে খরচ হয় ৩ টাকা ৬৭ পয়সা। এর সঙ্গে লেভেলিংয়ে ১ টাকা ও অন্যান্য ব্যয় হয় আরো ৩৭ পয়সা। আধা লিটার পানি পরিশোধনে খরচ হয় ১ টাকা। এ হিসাবে আধা লিটার পানি উৎপাদনে ভ্যাটসহ খরচ হচ্ছে ৬ টাকা ৯৫ পয়সা। পরিবেশকদের কাছে তা বিক্রি হচ্ছে ৮ টাকা। তবে আধা লিটার পানির জন্য ভোক্তাকে গুনতে হচ্ছে ১৫ টাকা।
বাংলাদেশ পোল্ট্রি ইন্ডাস্ট্রিজ সেন্ট্রাল কাউন্সিলের (বিপিআইসিসি) তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে ব্রয়লার মুরগির একটি ডিমের উৎপাদন খরচ ৯ টাকা ৫০ পয়সা এবং প্রতি কেজি ব্রয়লার মুরগির উৎপাদন খরচ ১৪৫ টাকার বেশি। এতো কয়েকদিন আগেও খুচরা বাজারে আমরা একটা ডিম কিনেছি ১০ টাকা। কিন্তু বতর্মানে একটা ডিম কিনতে হচ্ছে ১২ টাকায়।
এই যে হঠাৎ হঠাৎ ব্রয়লার মুরগি ও ডিমের দাম বাড়ছে এটা সত্যি। কিন্তু খামারিরা বাড়তি দাম পাচ্ছে না বলে দাবি করছে। এ জন্য এই খাতের বড় করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোকে দায়ী করেছে প্রান্তিক খামারিদের সংগঠন বাংলাদেশ পোল্ট্রি অ্যাসোসিয়েশন।
এ দুটো উদাহরণ থেকে খুবই সহজেই বোঝা যাচ্ছে পোল্ট্রিশিল্পে বর্তমান অবস্থার। যেখানে আধা লিটার পানি বিক্রি করে একজন বিক্রেতা সহজে দ্বিগুন লাভ করছে সেখানে একজন ডিম কিংবা মুরগি বিক্রেতার টিকে থাকাই দুষ্কর। পানি বিক্রি করে একজন বিক্রেতা যে দ্বিগুন লাভ করছে সেটা নিয়ে আমাদের কারো মাথাব্যথা নেই, অথচ ডিম কিংবা কৃষিপণ্যের একটু দাম বাড়লে চারদিকে হইচই পড়ে যায়। পোল্ট্রিশিল্পের সঙ্গে জড়িত খামারি লাভজনক মূল্য না পেয়ে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, সে দিকে কারো নজর নেই।
আসলে, এ শিল্পের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জগুলোর মধ্যে খাদ্যের উপাদানের অস্বাভাবিক মূল্য বৃদ্ধি এবং উৎপাদিত পণ্য যেমন- ডিম ও ব্রয়লার মুরগির ন্যায্য মূল্য না পাওয়া অন্যতম। এ চ্যালেঞ্জ দুটি মোকাবেলা করতে খামারিরা দিন-দিন হিমশিম খাচ্ছে। পোল্ট্রিশিল্পের সঙ্গে জড়িত কেউ ক্ষতিগ্রস্ত হোক সেটা চাই না। খামারিরা ক্ষতিগ্রস্ত হলে পোল্ট্রি ফিড বা হ্যাচারির ব্যবসা টিকতে পারবে না। আবার ব্যবসায়ীদের বাদ দিয়ে খামারিদের উৎপাদন চালিয়ে যাওয়াও সম্ভব নয়। উভয় পক্ষকে বিষয়টি বুঝতে হবে।
সম্প্রতি বাংলাদেশ পোল্ট্রি অ্যাসোসিয়েশনের নেতারা ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে সংবাদ সম্মেলন করে বলেছে, দফায় দফায় মুরগির খাবারের দাম বাড়ছে। কিন্তু খামারিরা যখন পণ্য বিক্রি করতে যাচ্ছে, তখন ন্যায্যমূল্য পাচ্ছে না। তাই প্রান্তিক খামারিদের টিকে থাকা কষ্টকর হয়ে গেছে। ইতোমধ্যে অনেক ছোট খামারি ব্যবসা গুটিয়ে নিয়েছে। সংবাদ সম্মেলনে আরও জানানো হয়, ২০০৯ সালে দেশে মুরগি ও ডিম উৎপাদন করে। এমন খামার বা ফার্মের সংখ্যা ছিল ১ লাখ ৬০ হাজার। ২০২১-২২ অর্থবছরে তা কমে অর্ধেকে নেমে এসেছে।
অ্যাসোসিয়েশনের নেতারা বলছে, কোম্পানিগুলো একটি ব্রয়লার মুরগির বাচ্চা ২৫ থেকে ৩০ টাকায় উৎপাদন করে। আর বিক্রি করে ৪০ টাকায়। এতে খামারিরা মুরগি পালন করে পোষাতে পারছে না। সংবাদ সম্মেলনে পোল্ট্রিশিল্পের চলমান সংকট নিরসনে পোল্ট্রি বোর্ড গঠনের প্রস্তাবের পাশাপাশি আরও কিছু দাবি উত্থাপন করা হয়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য, প্রান্তিক খামারিদের জন্য প্রাণিসম্পদের লাইসেন্স, ট্রেড লাইসেন্স বা ব্যবসার সনদসহ অন্যান্য সনদ প্রাপ্তি সহজ করা, খামারিদের জন্য সহজ শর্তে ব্যাংকঋণের ব্যবস্থা করা, খামার বন্ধ হয়ে যাওয়ার কারণ অনুসন্ধান, খামারিদের বিমার আওতায় আনা এবং ডিম সংরক্ষণের জন্য হিমাগার স্থাপনের দাবি জানানো হয়।
তাদের এ দাবি যুক্তিগ্রাহ্য বলে আমি মনে করি। কারণ খামারিরা বিনিয়োগ করে, শ্রম দেয়, সময় ব্যয় করে। এত কিছুর পর তারা যদি লাভের মুখ না দেখে তাহলে নিরুৎসাহিত হয়ে পড়বে। এমনিতেই করোনা মহামারির বিরূপ প্রভাব পড়েছে এ শিল্পের ওপর। খামারিরা বিভিন্ন সময়ে মানববন্ধন ও বিক্ষোভ করেছে। তারা স্মারকলিপি দিয়েছে। এগুলো আমলে নিয়ে ধৈর্য ও সহানুভূতির সঙ্গে পোল্ট্রিশিল্পের সমস্যাগুলো সমাধানে ইতিবাচক পদক্ষেপ নেওয়া উচিত। সংকট সবসময় থাকবে, তবে এ শিল্পে সম্ভাবনাও রয়েছে ব্যাপক।
সবচেয়ে হতাশার বিষয় হলো- এখনো দেশে কোনো পোল্ট্রি ডেভেলপমেন্ট বোর্ড বা কর্পোরেশন গড়ে ওঠেনি। অথচ তুলা উন্নয়ন বোর্ড আছে, পাট, পানি কিংবা চা উন্নয়ন বোর্ড আছে। মসলা গবেষণা কেন্দ্র, আখ গবেষণা কেন্দ্র, ডাল গবেষণা কেন্দ্রের মতো অসংখ্য গবেষণা এবং বোর্ড রয়েছে। ফলে পোল্ট্রিশিল্পে যথাযথ নীতিনির্ধারণ যেমন বিঘ্নিত হচ্ছে তেমনি দেশের খামারিবান্ধব প্রকল্প প্রণয়নে বিঘ্নিত হচ্ছে!
আমাদের মনে রাখতে হবে সম্ভাবনাময় পোল্ট্রিশিল্প ধ্বংস হলে ৫০ লাখ মানুষ বেকার ও পরোক্ষভাবে এক থেকে দেড় কোটি মানুষ পথে বসার উপক্রম হবে। ইতোমধ্যে পোল্ট্রিশিল্পের ৪০ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ করছে বিদেশী ১০টি কোম্পানি, যা অত্যন্ত উদ্বেগের বিষয়। ফলে ভবিষ্যতে বিদেশী কোম্পানিগুলোর কাছে ক্ষুদ্র ও মাঝারি দেশি কোম্পানিগুলো জিম্মি হয়ে পড়ার শঙ্কা তৈরি হয়েছে।
গত কয়েক মাসে সয়াবিন মিল ও ভুট্টার দাম যথাক্রমে ৩০ ও ৪০ শতাংশ বেড়েছে। সঙ্গে যোগ হয়েছে জ্বালানি ও পরিবহনের খরচ বাড়ার সমস্যা। সব মিলিয়ে দেশের মানুষের প্রোটিনের অন্যতম উৎস ডিমের দাম বেড়েছে। অবশ্য পোল্ট্রি খাবারে কত ভাগ দাম বাড়লো আর কত টাকা লোকসান হলো সেটা সাধারণ ভোক্তাদের জানার বা বিবেচনারও বিষয় নয়। তাদের কাছে কম মূল্যে মুরগি ও ডিম খেতে পারাই বড় কথা। তবে পোল্ট্রি সেক্টরের পুরো সিস্টেমে যে খারাপ প্রভাব পড়েছে তা সহজেই সবার গোচরে এসেছে। এছাড়া খামারে রোগবালাই, চিকিৎসা ও ভাইরাস জনিত রোগে পুরো খামারের মুরগি মরে যাওয়া ঘটনাও রয়েছে।
তাই এ শিল্পকে রক্ষা সরকার ও সংশ্লিষ্ট সবাইকে আরও এগিয়ে আসতে হবে। পোল্ট্রিশিল্পের জন্য আলাদা ডেভেলপমেন্ট বোর্ড বা কর্পোরেশন গড়ে তুলতে হবে। অ্যাসোসিয়শনের দাবিগুলো বাস্তবায়নের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় উদ্যোগী হতে হবে। ব্রয়লার মুরগি ও ডিমের উৎপাদন খরচ, ক্রয় মূল্য, পরিবহন খরচ, অন্যান্য খরচ এবং বিক্রেতার লভ্যাংশসহ ভোক্তা পর্যায়ে পণ্যের দাম নির্ধারণ করা সময়ের দাবি।
লেখক: উপ-পরিচালক, শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়