(সদ্যপ্রয়াত আলোকচিত্রী শওকত জামিলের একমাত্র পুত্র বেহাগকে)
স্নেহভাজন বেহাগ, জানি তুমি বাবার খুব প্রিয়, কিন্তু আর কোনোদিন বাবার আদর পাবে না। বাবাকে কাছে পাবে না, করতে পারবে না অকৃত্রিম অভিমান।
প্রিয় বেহাগ, তুমি জাতীয় প্রেসক্লাবের সদস্য-সন্তানদের নিয়ে শুক্রবারের নিয়মিত শিশু কিশোর আসরের মধ্যমণি ছিলে। সঙ্গীত ও শিল্পচর্চার এই আয়োজনে তোমার অগ্রগামী ও ঈর্ষণীয় ভূমিকা সবাইকে মুগ্ধ করতো। মৌসুমি আয়োজনে যখন ক্লাব সদস্য- সন্তানদের পারফরমেন্সের প্রশ্ন আসতো, তখন প্রশিক্ষকরা তোমার ওপর নির্ভর করতেন। শিশু কিশোর প্রশিক্ষণ ক্লাসে হঠাৎ তোমার আগমন বন্ধ হলে সবাই বিস্মিত হয়েছিল। তোমার বন্ধু শিশু কিশোর ও অভিভাবকদের মনে আকুল প্রশ্ন ছিল অনেকদিন- বেহাগ কোথায় ? বেহাগ কোথায়?
তুমি জানো, আমার ছেলে তুসু সঙ্গীত ও ছবি আঁকা ক্লাসের নিয়মিত ছাত্র হিসাবে ক্লাবে শুক্রবারও আমার যাতায়াত নিয়মিত। তুসুই একদিন প্রশ্ন করল-বেহাগ ভাইয়া কোথায়? তার কথার উত্তর দিতে পারিনি। তোমার বাবা শওকত জামিলের সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব ও ভাব কম ছিল না। একদিন ক্লাবের প্রাতঃরাশের টেবিলে তাঁকে জিজ্ঞেস করে বসলাম জামিল ভাই, বেহাগের সঙ্গীত ও ছবি আঁকার ক্লাস বন্ধ করলেন কেন ? স্বভাবসুলভ নিম্নকণ্ঠে তোমার বাবা বললেন, বেহাগকে বুলবুল ললিতকলায় ভর্তি করেছি। শুদ্ধ সঙ্গীতের চর্চায় সে অনেকদূর যেতে চায়। আমার আর কোনো অনুযোগ ছিল না।
বাবা- মা হয়তো তোমার নামের মর্মার্থকে কর্মে পরিণত করতে তোমাকে বৃহত্তর সঙ্গীত পরিসরে ভর্তি করেছিলেন। তোমাকে প্রেসক্লাবে পেয়ে জিজ্ঞেস করে জেনেছিলাম, তুমি ক্ল্যাসিক্যাল সঙ্গীত চর্চায় মনোযোগ দেয়ায় প্রেসক্লাবের প্রশিক্ষণ ক্লাসে আসতে পারছো না। জানিনা, তোমার এই চর্চা এখন কোন পর্যায়ে আছে। আকস্মিক এই শোক তোমাকে বিপর্যস্ত করবে সত্য, কিন্তু জীবনে বড় হতে হলে লেখাপড়া ও অধ্যাবসায়ের কোন বিকল্প নেই। নিয়মিত চর্চা তোমাকে চালিয়ে যেতে হবে, বাবার স্বপ্ন পূরণ করতে হবে।
তোমার বাবার সঙ্গে প্রায় দেখা হতো প্রেসক্লাবের নিয়মিত আড্ডায়। তোমার বাবা শওকত জামিল-আমাদের প্রিয় জামিল ভাই পেশার পরিচয়ে একজন আলোকচিত্র সাংবাদিক। মন ও মননে ছিলেন একজন চিন্তাশীল দেশপ্রেমিক সুশীল মানুষ। সামান্য আলাপেই তার জ্ঞানচর্চার পরিধি আঁচ করা যেত। তিনি আলাপচারিতা-আড্ডায় গাম্ভীর্য ও গভীরতা বজায় রাখতেন। রাজনৈতিক ডামাডোলে তাকে কখনো গা ভাসাতে দেখিনি। দেখিনি হাল্কা আলাপ ও তর্ক- বিতর্কে লিপ্ত হতে। আড্ডার টেবিলে তাকে একজন বিনম্র, নিম্নকণ্ঠ , যুক্তিবাদী ভদ্র মানুষ হিসাবেই পেয়েছি। বংশগত পরিচয়ে তিনি খান হলেও এই পদবিটি খুব কম ব্যবহার করতেন। শওকত জামিল নামেই পরিচিত হতে তার ভাল লাগতো। বললে অত্যুক্তি হবে না, এমন নিরাভরণ, নিরহঙ্কারী মানুষ আজ পাওয়া বড় ভার।
শুক্রবারে দেখলাম, প্রেসক্লাবের বাইরের চত্বরে তোমার বাবা, কবি হেলাল হাফিজের ছবি তুলছেন। ছবি তোলার আগে নাস্তার টেবিলে পেলাম তাকে। মনে হলো, তিনি বিষণ্নচিত্ত ও চিন্তিত। তার মুখখানিও বেশ শুকনো। এর আগে তাঁকে এতোটা বিচলিত ও বিষণ্ন দেখিনি। ধর্মতাত্ত্বিকরা বলেন, মৃত্যুর চল্লিশ দিন আগে থেকেই নাকি মানুষের মনের ভিতরে চলতে থাকে নানা পরিবর্তন। হয়তো তার ভেতরেও চলছিল কোনো আলোড়ন । জিজ্ঞেস করার ইচ্ছা ছিল, কিন্তু তিনি বিব্রত হতে পারেন বলে আর জিজ্ঞেস করিনি। অন্য আলাপচারিতার মধ্য দিয়ে আমরা নাস্তা সেরে নিলাম।
বেহাগ, তোমার বাবা স্ট্রোকে ইহলোক ত্যাগ করেছেন বলে শুনেছি। কিন্তু এর কোনো লক্ষণ দেখা যায়নি। সব সময় তাকে দেখেছি স্বল্প আহার করতে। চলনে বলনে ছিলেন খুব ধীরস্থির। দৈহিক গঠন অনুসারে যতোটা ওজন থাকার কথা তার, তার তাই আছে বলে মনে হয়েছে। স্ট্রোকের পূর্বলক্ষণ বলতে যা বোঝায়, তা তো তার মধ্যে দেখতে পাইনি। তাহলে কেন এই অজানা ঘাতকের হাতে অপ্রত্যাশিত মৃত্যু। তাহলে কি তিনি সকলের অজান্তেই বহন করে বেড়াচ্ছিলেন গোপন ঘাতক? তা কেবল আল্লাহ জানেন।
বেহাগ! জানিনা, এই খোলা চিঠি তোমার কাছে আদৌ পৌঁছাবে কিনা। পৌঁছাক বা না পৌঁছাক, আমার একান্ত প্রার্থনা থাকবে, তুমি এই শোক বিহ্বলতা থেকে মুক্ত হও, অধ্যায়ন ও চর্চার চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করো, পূরণ করো তোমার মা ও বাবার স্বপ্ন।
বাংলাদেশ সময় : ১৮২৮ ঘণ্টা, মার্চ ১৩, ২০১২