ঢাকা: এমভি শরীয়তপুর-১ নামের লঞ্চটি শরীয়তপুর থেকে ঢাকায় আসার পথে সোমবার দিবাগত রাত ২টায় মুন্সীগঞ্জের গজারিয়া উপজেলার উত্তর চরমসুরা এলাকায় মেঘনা নদীতে দু’শতাধিক যাত্রী নিয়ে ডুবে যায়। মঙ্গলবার বিকেল পর্যন্ত ৩২টি লাশ উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা লঞ্চডুবির এ ঘটনায় শোক প্রকাশ করেছেন। তিনি এক শোকবার্তায় নিহতদের রুহের মাহফেরাত কামনা করেন এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারগুলোর সদস্যদের প্রতি সমবেদনা জানিয়েছেন।
শরীয়তপুরের সন্তান বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের ডেপুটি স্পিকার শওকত আলীও লঞ্চডুবিতে শোক প্রকাশ করেছেন।
এক্ষেত্রে অবশ্য আমাদের নৌ-পরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান আরেক ধাপ এগিয়ে। তিনি মঙ্গলবার দুপুরে দুর্ঘটনাস্থল পরির্দশন করে উপস্থিত সাংবাদিকদের বলেন, ‘নিহত প্রত্যেকের পরিবারকে ত্রিশ হাজার টাকা করে দেওয়া হবে। তবে কোন পরিবারে একাধিক ব্যক্তি মারা গিয়ে থাকলে ওই পরিবার পঁয়তাল্লিশ হাজার টাকা করে পাবে।
কি চমৎকার কথা! আমরা ধন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ও নৌ পরিবহনমন্ত্রীর কাছে। শোক প্রকাশ আর ত্রিশ হাজার টাকা। আবার এক পরিবারে একাধিক হলে আরো পনের হাজার। এ যেন গলির মুখের দোকানের দোকানির কথাকেই মনে করিয়ে দিল। আপা, একটা সাবান নিলে ৩০ টাকা, আর দুইটা নিলে ৪৫ টাকা। মানুষের জীবন আর একটা সাবানের দাম তাহলে একই!!! ধন্য আমরা, খান সাহেবের মতো মন্ত্রী আমরা পেয়েছি!
আমরা যতটা শুনেছি বা আঁচ করতে পারি এই খান নৌমন্ত্রীর পরোক্ষ নির্দেশেই রোববার ও সোমবার নৌপথে চলেনি কোনো বাহন। ফেরি আটকে ছিলো মাঝনদীতে।
আর সে কারণেই সোমবার রাতে অতিরিক্ত যাত্রী হয়ে কর্মস্থলে অথবা জরুরি কাজে যারা চেপেছিলেন শরিয়তপুর-১ লঞ্চটিতে তাদের ৩২ জনকে তোলা হয়েছে উপরে। বাকি শতাধিক এখনো পানির নিচেই রয়েছেন লঞ্চের ভেতরে আটকে। যেনো লঞ্চের সাথেই তাদের সব সখ্য।
শরীয়তপুরের লঞ্চগুলো খুব একটা বড় নয়। মাঝারী আকারের। লঞ্চডুবির এ দুর্ঘটনার মূল কারণ হিসেবে আপাতত অধিক যাত্রী বহনই দায়ী করা হয়েছে।
এখন তো বর্ষা মৌসুম নয়, কিংবা ঈদের আগের কিংবা পরের ভিড়ও নয়। তাহলে কেন ধারণ ক্ষমতার চেয়ে অতিরিক্ত যাত্রী নিয়ে যাত্রা শুরু করেছিল লঞ্চটি?
আমার বাড়ী শরীয়তপুরে। তাই খুব স্বাভাবিক নিয়মেই খোঁজ নিলাম হতভাগ্যদের তালিকায় নিজেদের কেউ রয়েছেন কি না। খোঁজ নিয়ে জানলাম, বেশ ক’জন আত্মীয় রয়েছেন। তাদের কারো খোঁজ এখনো পাওয়া যায় নি।
আমার মায়ের এক আত্মীয় রয়েছেন যার আগামী সপ্তাহে আমেরিকা যাওয়ার কথা। তাই সপরিবারে তারা আজ ঢাকায় আসছিলেন। সবাই নিখোঁজ।
অপরদিকে আরেক জনের আজ সকালে ঢাকায় ডাক্তারের কাছে হাজির থাকার কথা। তাই তিনিও আসছিলেন।
এখানে উল্লেখ করা দরকার যে, তাদের সবারই ঢাকায় আসার কথা ছিল সোমবার। অলিখিত লঞ্চ ধর্মঘটের কারণে তারা সোমবার ঢাকায় আসতে পারেন নি। আমার এই আত্মীয়দের মতো আরো নিশ্চয় অনেকে আছেন যাদের হয়তো, গতকাল বা গত পরশু ঢাকায় আসার কথা ছিল। কিন্তু লঞ্চ চলাচল না করায় তারা আজ আসতে গিয়ে মেঘনায় সমাহিত হয়েছেন। তাহলে এই সলিল সমাধির দায় কার?
আমি খুব স্পষ্ট ভাষায় বলতে চাই, এই লঞ্চডুবির ঘটনার দায় একমাত্র সরকারের। আরও সুনির্দিষ্ট করে বলতে গেলে নৌমন্ত্রীর। শ্রমিক নেতৃত্বের দাপুটে এই মন্ত্রী তার ক্ষমতার সবটুকু প্রয়োগ করেই লঞ্চ-বাস চলাচল বন্ধ করিয়েছিলেন।
তিন দিন পর সোমবার দিবাগত রাতে (মঙ্গলবার) লঞ্চ চালু হয়েছে। যে জনগণ এই আওয়ামী লীগকে ভোট দিয়ে ক্ষমতায় এনেছিল, সেই আওয়ামী লীগ সরকার জনগণকে বাধ্য করে এই তিন দিন আটকে রেখেছিল। যার ফল এই লঞ্চডুবি।
প্রধান বিরোধী দল বিএনপির এক মহাসমাবেশকে কেন্দ্র করে সরকার যে অবর্ণনীয় দুর্ভোগ জনগণকে দিয়েছে সে কথা গত তিন দিন ধরেই গণমাধ্যম প্রচার করে আসছে। কিন্তু এই লঞ্চডুবি বোধহয় সব কিছুকে ছাপিয়ে গেল। এর দায় কি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এড়াতে পারবেন?
ফেসবুকে এক বন্ধু লিখেছেন, গতকাল (সোমবার) বিএনপির সমাসমাবেশ পণ্ড করতে ঢাকার সঙ্গে দেশের সব জেলার সড়ক ও নৌপথ বিচ্ছিন্ন করে রেখেছিলো আওয়ামী লীগ। সমাবেশ শেষে সন্ধ্যা থেকে সেগুলো সচল হয়, ফলে যানবাহনগুলোর ওপর স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি চাপ সৃষ্টি হয়। যদি অন্যান্য জেলা থেকে ঢাকাকে বিচ্ছিন্ন করে রাখা না হতো তাহলে হয়তো এ দুর্ঘটনা এড়ানো যেতো।
ফেসবুকে তিনি আরো বলেন, ‘লঞ্চডুবির জন্য কেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রীকে দায়ী করা হবে না’ এ মর্মে আমাদের আদালত কি একটি রুল জারি করবেন?’
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আমি যদি বলি- আজকের এ লঞ্চডুবির একমাত্র কারণ, গত তিন দিন ধরে কোনও লঞ্চের ঢাকামুখী না হওয়া। যাদের ঢাকায় আসা অত্যন্ত দরকার ছিল, তারা গত তিন দিন আটকে থেকে প্রথম সুযোগেই এক সঙ্গে এই লঞ্চে উঠেছিল।
আমি যদি বলি, আজকের এই লঞ্চডুবি কোনভাবেই নিছক দুর্ঘটনা নয়- একটি হত্যাকাণ্ড এবং এই হত্যাকাণ্ডের জন্য দায়ী আপনার পীড়ন পদ্ধতি।
বাংলাদেশ সময় : ২১০২ ঘণ্টা, মার্চ ১৩ ২০১২