ঢাকা, সোমবার, ৮ পৌষ ১৪৩১, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

মুক্তমত

দুটি সমাবেশের মাঝখানে ১শ ১২টি লাশ!

সুদীপ্ত সালাম, অতিথি লেখক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২২৪৪ ঘণ্টা, মার্চ ১৪, ২০১২
দুটি সমাবেশের মাঝখানে ১শ ১২টি লাশ!

আমাকে যদি প্রশ্ন করা হয়, এই মুহূর্তে সবচেয়ে বেশি দঃুখী মানুষ কে, আমি বলব তারা- যারা ১২ মার্চ রাতে মেঘনা নদীতে তাদের স্বজনদের হারিয়েছে। অথচ এমন মর্মান্তিক একটি মানবিক ট্রাজেডির পরও নৌপরিবহন মন্ত্রী শাহজাহান খানকে এই ভয়াবহ লঞ্চ ডুবির বিষয়ে জবাবদিহি করতে হচ্ছে না।

এদিক থেকে তিনি সবচেয়ে নির্ভার ব্যক্তি।

সাধারণ বিবেচনায় লঞ্চডুবির কারণ আমরা জানি। সেই একই অভিযোগ, লঞ্চের অবস্থা ভালো ছিল না, অতিরিক্ত যাত্রী বহন করেছিল ইত্যাদি ইত্যাদি। এ অব্যবস্থাপনা রোধের দায়িত্ব তাহলে কার? অবশ্যই নৌমন্ত্রণালয়ের। কিন্তু সেই মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী গোঁফে তা দিচ্ছেন। কেননা তার দিকে কোনো প্রশ্নবাণ নেই। দুই মহাসমাবেশের ভিড়ে গণমাধ্যম ও জনগণও যেন অনেকটা দিগভ্রান্ত। সমাবেশ দুটির উচ্চৈ:স্বরের নিচে চাপা পড়ে গেছে স্বজনহারাদের আর্তনাদ, বিরিয়ানির সুবাসের কাছে গৌণ টিকতে পারছে না লাশের গন্ধ। নৌমন্ত্রীকে প্রশ্ন করেও কি লাভ হতো? ইনিই তো সেই মন্ত্রী যিনি নিজের মন্ত্রণালয়ের চেয়ে যোগাযোগ মন্ত্রণালয় বিষয়ে বেশি আগ্রহী। তিনিই তো অদক্ষ-অশিক্ষিত বাস চালকদের লাইসেন্স দেয়ার দাবি জানান। এখন তাকে প্রশ্ন করা হলে হয়তো একই ধরনের কথাই বলবেন, ‘নৌপথের বেশিরভাগই চলাচলের অযোগ্য, এখানে সেখানে ভাঙা, গর্ত। ’
 
এবার লঞ্চডুবি কি আগের দুর্ঘটনাগুলোর চেয়ে ভিন্ন নয়? এর সঙ্গে কি আওয়ামী লীগের অঘোষিত ঢাকা অবরোধ কর্মসূচির কোনো সম্পর্ক নেই? আমরা মনে করি আছে, অবশ্যই আছে। ঢাকাকে যদি অন্যান্য জেলা থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখা না হতো তাহলে হয়তো এই দুর্ঘটনা হয়তো এড়ানো সম্ভব ছিল।

দুটি রাজনৈতিক পরাশক্তির মহাসমাবেশ সফলভাবে শেষ হয়েছে। সমাবেশ শেষে যেমন আবর্জনা পড়ে রয়, মেঘনার পাড়ে তেমনি জমা হলো ১শ ১২টি লাশ। কারোরই কোনো মাথাব্যথা নেই! খালেদা জিয়ার সমাবেশের পর দুর্ঘটনাটি ঘটে। বিরোধী দল তাদের সমাবেশের সফলতা নিয়ে বেশ উৎফুল্ল। সমাবেশের সফলতা নিয়ে তারা সংবাদ সম্মেলন করে, কিন্তু এতোগুলো প্রাণনাশের ঘটনায় তারা নীরব। আর শেখ হাসিনা যখন মঞ্চে তখন মুন্সিগঞ্জে ডুবে যাওয়া লঞ্চে লাশ আর লাশ। শেখ হাসিনাসহ অন্যান্য নেতা-নেত্রী লম্বা লম্বা ভাষণ দিলেন, বিরোধী দলের পোস্টমর্টেম করে ছাড়লেন, কিন্তু এই মহা-ট্রাজেডি নিয়ে এক মিনিটও ব্যয় করলেন না। তাদের কাছে গুরুত্ব পেলো নিজেদের ও বিরোধী দলের মহাসমাবেশ। কে কার চেয়ে বেশি শক্তিপ্রদর্শন করতে পারলো এ নিয়ে বাক-বিত-া। আওয়ামীলীগের কি উচিত ছিল না এই ট্রাজেডির পরিপ্রেক্ষিতে সমাবেশ স্থগিত করা? জাতীয়তাবাদী দলের কি উচিত ছিল না এ বিষয়ে সোচ্চার হওয়া? কেনই বা তা করতে যাবেন তারা ? মেঘনায় যারা ডুবে মরেছে তারা তো কোনো দলের কর্মী নয়, নেতা নয় কিংবা প্রভাবশালী রাজনীতিকদের নিকট আত্মীয়ও নয়। তাহলে তারা কারা?

প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, বেডরুমে নিরাপত্তা দেয়া সম্ভব নয়। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আমরা কি তাই চেয়েছিলাম আপনার কাছে? আমরা নিরাপদে বাঁচতে চেয়েছিলাম। আপনার অবগতির জন্য জানাচ্ছি, বেডরুমের চেয়ে আমরা এখন বাইরেই বেশি অনিরাপদ হয়ে পড়ছি। আপনাদের বিভিন্ন কর্মসূচি সেই অনিরাপদ অবস্থাকে আরো বেশি অনিরাপদ করে তুলছে। কিন্তু সেকথা আপনাকে কেন বলছি? আপনি তো আজও বুধবারও বলেছেন, দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নাকি উন্নত হয়েছে।

রাষ্ট্রের বর্তমান ও সাবেক প্রধান যখন এতো বড় একটি ঘটনার সময় সমবেদনা প্রকাশের চেয়ে ক্ষমতা প্রদর্শনে আত্মনিয়োগ করেন তখন সাধারণ মানুষ যায় কোথায়? একজন বলছিল, এ-ই নাকি আমাদের ভাগ্য। বর্তমান রাজনীতির জাঁতাকলে পিষ্ট অধিকাংশ জনগণ তাই মনে করে বসে আছে। আমরা সবাই যদি একথার সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করতে পারতাম তাহলে আমাদের রাজনীতির বর্তমান রূপটা হয়তো অন্যরকম হতো।

সুদীপ্ত সালাম: লেখক ও ফটোসাংবাদিক
সম্পাদনা:জুয়েল মাজহার, কনসালট্যান্ট এডিটর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।