খালেদা জিয়ার উচিত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ধন্যবাদ জানানো। শুধু শুকনো ধন্যবাদ নয়, মিষ্টি পাঠিয়ে ধন্যবাদ জানানো।
সমাবেশে বিএনপি সমর্থকদের আসা বন্ধ করতে প্রধানমন্ত্রী সব ধরনের তরিকা অবলম্বন করেছিলেন। যেমন, তিনদিন আগে থেকে আবাসিক হোটেল বন্ধ করে দেওয়া, খাবার হোটেল বন্ধ রাখতে বাধ্য করা, যানবাহন রিক্যুইজিশন, হামলা, গ্রেফতার, ঢাকার প্রবেশপথগুলোতে একাধিক চেকপোস্ট বসিয়ে পথে পথে পুলিশের তল্লাশি, দূরপাল্লার গাড়িগুলো ঢুকতে না দেয়া, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মাত্রাতিরিক্ত সদস্য মোতায়েন করা---- এককথায়, বিএনপির সমর্থকসহ সাধারণ মানুষের জন্য রাজধানী ঢাকার পথ দুর্গম করে দেয়াই ছিলো মুখ্য। একটা সমাবেশকে ঘিরে রীতিমতোআতঙ্ক তৈরি হয়ে গিয়েছিলো। এমনকি সমাবেশের জন্য সীমানা নির্ধারণ, মাইক ব্যবহার না করতে দেয়াসহ নানান নিয়ম জারি করা হয়। এসবকে ছাপিয়ে টেলিভিশন চ্যানেলগুলোকে দেয়া হয়নি সমাবেশ অনুষ্ঠান সরাসরি সম্প্রচারের সুযোগ। গত কিছুদিন ধরে এ বিষয়ে বিস্তর লেখালেখি চলে। প্রতিটি পত্রিকা, টিভি চ্যানেল ও অনলাইন মিডিয়ার কল্যাণে বিশ্বের মানুষের জানতে বাকি ছিলো না সমাবেশকে ঘিরে বাংলাদেশের অস্বাভাবিক এক নজিরবিহীন অবস্থার কথা।
এতো সব পদক্ষেপ বিএনপি- জামায়াত জোট নেতাদের চিন্তিত করে তোলে, কিন্তু আজ তারা আনন্দে উল্লসিত। কারণ, সরকারের নেয়া সব পদক্ষেপ হয়ে গেল ১৬ মণ ঘি, যা পুড়ল আর রাধাও নাচল-- মানে সমাবেশ সফল হল। এর ৭০ ভাগ কৃতিত্ব সরকারের। কারণ, দু’তিন দিন ধরে সরকার বিএনপি- জামায়াত জোটের সমাবেশ অসফল করতে যে পদক্ষেপ নিয়েছিলো তা বুমেরাং হয়ে ওঠে। তিন দিন সরকার মানুষের জীবনে দুর্ভোগ বয়ে আনে। দু’টা দিন মানুষের দুর্ভোগ চরমে ওঠে। কার্যত অচল করে দেওয়া হয়েছিল পুরো দেশকে। ঢাকা যেন হয়ে উঠেছিলো নিষিদ্ধ এক নগরী। আর নিষিদ্ধ জিনিসের প্রতি মানুষের টান সহজাত। আমাদের দেশের প্রধান দু’ দলের সমর্থকরা অনেকটাই অন্ধ সমর্থক, তাদের দল যা-ই করুক যেকোনো মূল্যে তা ঠিক বলে মানাতে চান। আর তাই চার দলীয় জোটের সমর্থকরা টাকার বিনিময়ে হোক, চাকরির বাধ্যবাধকতার কারণে হোক আর দলের প্রতি অন্ধ অনুকরণের কারণেই হোক সরকারের সৃষ্ট সকল বাধা পার হয়ে সমাবেশে ঠিকই জমায়েত হয়েছে।
এজন্যেই খালেদা জিয়ার উচিত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ধন্যবাদ জানানো। কারণ, খালেদা জিয়া চেয়েছেন শেখ হাসিনার থেকে নিজেকে বেশি জনপ্রিয় করতে, এ ব্যাপারে উনি সফল কিনা বলতে না পারলেও শেখ হাসিনা যে নিজেকে অপ্রিয় করে তুলেছেন তাতে কোনো সন্দেহ নেই। জনগণকে অন্ধকারে রাখা এখন বেশ কষ্টসাধ্য। আগে, একটা সময় ছিলো, মানুষ নেতাদের কথা চোখ বুজে বিশ্বাস করত। আজ জনগণ কোনো কিছু বিশ্বাস করার আগে যাচাই করে, চট করে কোনো কিছু মেনে নেয় না। মিডিয়াতে চোখ রাখে, নিজেরা নিজেদের ভালোমন্দটা ঠিকই বুঝে নেয়। সরকারের চাপিয়ে দেয়া কষ্ট ও দুর্ভোগকে হয়তো তারা নিরুপায় হয়ে মেনে নিতে বাধ্য হয়। কিন্তু তাই বলে তারা তো আর অবোধ নয়!
ছোটবেলায় পড়েছিলাম, নিজের নাক কেটে পরের যাত্রা ভঙ্গ করা। আজ সেটা জানলাম হাতে কলমে; প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেই কাজটিই গত কিছু দিন ধরে করে চলেছেন। সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনির হত্যাকাণ্ডের তদন্ত ও নিরাপত্তা নিয়ে যে উক্তি তিনি করেছেন, তাতে করে তিনি তার নিজের ভক্ত-সমর্থকসহ আমজনতার বিরাগ ভাজন হয়েছিলেন। সেই সাথে বিএনপি-জামায়াত জোটের সমাবেশকে কেন্দ্র করে যে তুঘলকি পদক্ষেপ নিয়েছিলেন এতে তার জনপ্রিয়তার মাত্রা কমেছে বৈ বাড়েনি। এই সাফল্যে খালেদা জিয়া যে বেজায় খুশি হয়েছেন তাতেও কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই, উনি প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করে খুশি ভাগাভাগি করে নিতেই পারেন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যা-ই করুন না কেন, তিনি যে নিজের ক্ষতিটাই করেছেন তাতে কোনো বিতর্কের অবকাশ নেই। আপন বুদ্ধিতে কেউ এমনটা করলে বলার কিছু নেই; কিন্তু অন্যের বুদ্ধিতে তা করলে অনেক কষ্ট পেতে হয়। প্রধানমন্ত্রীকে ঘিরে যারা আছেন তারা হয়তো দেশের মানুষ কী ভাবে কী চায়, উনাকে তা ঘুণাক্ষরেও জানতে দেয় না বা প্রধানমন্ত্রী নিজেও তা জানতে চান না। চাটুকারদের চাটুকারিতায় মজে উনি কি জনগণের কথা ভুলে গেছেন? নাকি উনি মনে করেন দেশে শুধু আওয়ামী লীগ আর বিরোধী দলই আছে—এর বাইরে আর কেউ নেই? সেজন্যেই কি উনি জনগণের চাওয়া-পাওয়ার কথা ভুলে গেছেন? চাটুকারেরাই একদিন আপনাকে খাদে ফেলে দেবে। খাদ থেকে উঠতে আপনাকে সেই জনগণেরই দ্বারস্থ হতে হবে। পারলে জনগণের সাথে নিজের সম্পৃক্ততা বাড়ান, গণতন্ত্রের মানসকন্যার উপাধির যথার্থতা প্রয়োগ করুন। জনগণের থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে দূরে সরে থাকবেন না। আপনার দূরে থাকার সুযোগে আর কেউ জনগণের কাছে চলে আসতে পারে। আপনার ক্ষমতার সঠিক ব্যবহার করুন, ভুলে যাবেন না জনগণই সকল ক্ষমতার উৎস।
সমাবেশ করা তো গণতান্ত্রিক অধিকার; নাকি এটা কেবলই সরকারের? বিরোধী দল সমাবেশ করলে জানমালের ক্ষতি হয়, জন দুর্ভোগ বাড়ে, তাহলে সরকারি দলের সমাবেশ করা কতটুকু সমীচীন? বিরোধী দলের সমাবেশের সরাসরি সম্প্রচার যে কারণে অনুমতি পায়নি, সে কারণ তো আপনার সমাবেশের উপরেও পড়ে। সমাবেশ পণ্ড করতে গিয়ে এতো যে পদক্ষেপ, তাতে ফল কী হল খতিয়ে দেখবেন কি? ১৩ তারিখে মেঘনায় লঞ্চডুবি কি প্রত্যক্ষভাবে সমাবেশ পণ্ড করার জন্য নেওয়া পদক্ষেপের কারণ নয় ? লঞ্চডুবি আগেই হয়েছে মানি; কিন্ত বিশেষ করে এই দুর্ঘটনাটা নিয়ে ভাবুন বর্ষা মৌসুম নয়, কিংবা ঈদের আগের কিংবা পরের ভিড়ও নয়। তাহলে কেন ধারণ ক্ষমতার চেয়ে অতিরিক্ত যাত্রী নিয়ে যাত্রা শুরু করেছিল লঞ্চটি? এতগুলো মানুষের প্রাণ চলে গেল, শেষ হয়ে যাবে এতোগুলো পরিবার!
আমরা চরম লজ্জিত; না বললেই না যে , আমরা ভোট দিয়ে নৌ-পরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খানের মত বিবেকবর্জিত কাউকে নির্বাচিত করেছি, যিনি কিনা দুর্ঘটনাস্থল পরির্দশন করে উপস্থিত সাংবাদিকদের বলেন, ‘নিহত প্রত্যেকের পরিবারকে ত্রিশ হাজার টাকা করে দেওয়া হবে। তবে কোনো পরিবারে একাধিক ব্যক্তি মারা গিয়ে থাকলে ওই পরিবার পঁয়তাল্লিশ হাজার টাকা পাবে। কী অবাক কাণ্ড! একজন মন্ত্রীরও নেই কোনো কাণ্ডজ্ঞান। ধন্যি আপনার মন্ত্রিসভা!
প্রধানমন্ত্রী সমীপে আবেদন, খালেদা জিয়ার জনপ্রিয়তা অনেক কমে গিয়েছে শুধু যুদ্ধাপরাধীদের সাথে তার সখ্যের কারণে। তাই আপনি খালেদা জিয়ার সমাবেশ পণ্ড করার কথা না ভেবে আমাদের কথা ভাবুন, দেশের উন্নতি ও জনগণের প্রাপ্য সুযোগ সুবিধা দেয়ার কাজ করুন। শুধু মুখে বড় বড় কথা না বলে বাস্তবতার বিচারে আমরা জনগণ কি পেলাম আর কি পাইনি তা বিচার করুন, হাতে সময় কিন্তু খুব বেশি নেই। সময়ের মূল্য দিন, নইলে হয়ত খালেদা জিয়া আপনাকে অচিরেই সহাস্যে ধন্যবাদ জানাবেন।
ফারজানা খান গোধুলি: ওয়াশিংটনপ্রবাসী বাংলাদেশি সাংবাদিক।
চূড়ান্ত সম্পাদনা ও পরিমার্জন : জুয়েল মাজহার, কনসালট্যান্ট এডিটর