আইএসআইর টাকার বিষয়টি দেশের রাজনীতিতে নতুন উত্তাপ যোগ করেছে। ১৯৯১ নির্বাচনের আগে বিএনপিকে পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থার পাঁচ কোটি রুপি দেবার আগুনে খবর!
মার্চের শুরুতে দুবাইভিত্তিক খালিজ টাইমস এ ব্যাপারে রিপোর্ট ছাপলে উত্তাপের বিষয়টি ঢোকে বাংলাদেশের রাজনৈতিক অববাহিকায়।
বাংলানিউজের বিলাত প্রতিনিধি সৈয়দ আনাস পাশার কল্যাণে রিপোর্টের পুরোটা পাঠকের নাগালে এসেছে। এটি এখন শুধু অভিযোগ নয়, পাকিস্তানের সুপ্রিমকোর্টের ডকুমেন্ট। ভারতীয় পত্রিকার বরাতে বাসস তা নিয়ে এসেছে ঢাকার মিডিয়ায়। টাকা নেওয়া-খাওয়ার অভিযোগ বিএনপির বিরুদ্ধে। এখন বিএনপিকে নিয়ে মিডিয়ার যারা আবার নতুন স্বপ্ন দেখা শুরু করেছেন, তারা আবার রিপোর্টটিকে যার যার মেধায় ডাউন প্লে-ও করেছে! পাছে আবার বিএনপির সমস্যা হয়ে যায়, সে আশংকায় গুরুত্বপূর্ণ একটি পত্রিকায় রিপোর্টটিকে প্রথম পাতাতেও জায়গা দেওয়া হয়নি! দায়িত্বশীল ভূমিকা (!) বটে!
মজার ব্যাপার টাকা নেবার অভিযোগ যার বিরুদ্ধে, সেই খালেদা জিয়ার মুখে কিন্তু এ বিষয়ে কোনো রা নেই! ১২ মার্চের মহাসমাবেশে এক ঘণ্টার বেশি সময় ধরে তিনি বক্তব্য দেন। তত্ত্বাবধায়ক এসে কোলে তুলে বসাবে কি না, হাসিনার সে বক্তব্যসহ অনেক কিছুর জবাব দিয়েছেন। শুধু এই টাকার বিষয়টি ছাড়া! জিয়ার মৃত্যুর পর ফজলে লোহানীর টিভি ইন্টারভিউয়ে খালেদা বলেছিলেন, জিয়া বেতন পেয়ে প্রতি মাসে তাকে দুই হাজার টাকা দিতেন। সেই টাকায় অনেক কষ্টে তাকে সংসার চালাতে হতো। একই সাক্ষাৎকারে তারেক-কোকো বলেছিলেন, তাদের বাবা তাদেরকে তার পুরনো জামা-কাপড় দর্জি দিয়ে ছোট করিয়ে পরতে দিতেন। নতুন জামা-কাপড় কিনে দিতে পারতেন না। জিয়ার মৃত্যুতে এমন একটি বিপদগ্রস্ত অসচ্ছল পরিবারের ভরণপোষণের জন্য বিচারপতি সাত্তার ও পরে এরশাদ সরকার ঢাকায় দু’টি বাড়ি ও মাসিক ভাতার ব্যবস্থা করে দেন। তারেক-কোকোর পড়াশুনার খরচ হিসাবেও দেওয়া হতো আলাদা টাকা। সেই খালেদা জিয়া কিন্তু ১৯৯১ সালের নির্বাচনে জিতে ক্ষমতায় যাবার পর ঘোষণা দিয়ে প্রধানমন্ত্রী হিসাবে বেতন নিতেন না। তা কী আইএসআইর সেই টাকার গুণে ঘুচে গিয়েছিল তার অসচ্ছলতা? প্রশ্নটি এখন উঠতে পারে। তখন কেউ একজন তার কলামে লিখেছিলেন, `কারও বেতনে সংসার চলে না। কারও সংসার চালাতে বেতন লাগে না!`
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুলের একটি বিশেষ গুণ (!), কোনো একটি খবর পক্ষে না দেখলেই সঙ্গে সঙ্গে অসত্য, ভিত্তিহীন বলে দেন! কখনও এমন বলেননি যে, এ বিষয়টি আমি জানি না, আমি তখন মহাসচিব বা দলের গুরুত্বপূর্ণ কোনো পদে ছিলাম না। তাই বিষয়টি জেনে বলতে হবে। আওয়ামী লীগ-বিএনপির সাধারণ সম্পাদক-মহাসচিবের দায়িত্ব থাকলে বুঝি এ রকম তৈরি (রেডিমেড) জবাব দেওয়া লাগে! আইএসআইর টাকার খবরটি বেরুলে মির্জা ফখরুল বলার চেষ্টা করেছিলেন, সরকার টাকা দিয়ে দুবাইর পত্রিকায় এমন ছাপাতে পারে। সিঙ্গাপুরের স্ট্রেইটস টাইমস পত্রিকায় কোকোর টাকার বৃত্তান্ত ছাপা হবার পরও একই কথা বলা হয়েছিল। ভাগ্যিস বলা হয়নি, মার্কিন ফেডারেল আদালতে সরকার টাকা দিয়ে এমন একটি জবানবন্দির ব্যবস্থা করেছে!
উল্লেখ্য, মার্কিন ফেডারেল আদালতের জবানবন্দির সূত্রে সিঙ্গাপুরের ব্যাংকে জব্দ হয় কোকোর টাকা। বাংলাদেশে কাজ পেতে সিমেন্স কোম্পানির এক কর্মকর্তা টাকাগুলো ঘুষ হিসাবে কোকোকে দিয়েছিলেন। কোকোর টাকা খুঁজতে গিয়ে সিঙ্গাপুরের আরেক ব্যাংকে তারেক-মামুনের টাকার হদিস পায় এফবিআই। আইএসআইর টাকার মতো সিঙ্গাপুরের ব্যাংকের টাকার খবরও বাংলাদেশ জেনেছে ভিন্ন সূত্রে। অনেকটা ‘ধর্মের কল বাতাসে নড়ে’র মতো অবস্থা আর কী! মার্কিন ফেডারেল আদালতের আদেশে সিঙ্গাপুরের ব্যাংকের টাকা জব্দ হয়। পাকিস্তানের সুপ্রিম কোর্ট ভাগ্যিস খালেদাকে দেওয়া টাকা ফেরত আনার কোনো আদেশ দেয়নি!
আইএসআইর টাকার বিষয়ে কালের কণ্ঠে বিএনপির দু’ নেতা খন্দকার মোশাররফ আর মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের বক্তব্য ছাপা হয়েছে। টাকার অভিযোগ যেখান থেকে এসেছে সেখানকার আদালতে খোঁজখবর নেবার, দরকার হলে ‘অসত্য বক্তব্য’ দেবার জন্য আইএসআইর সাবেক চিফের বিরুদ্ধে নালিশ করার কথা তারা বলেননি। ইকোনমিস্টের রিপোর্টের উল্লেখ করে বলেছেন, গত নির্বাচনের আগে ভারত থেকে বস্তা ভর্তি টাকা এনেছিল আওয়ামী লীগ। এখন সে টাকার বদনাম ঢাকতে আইএসআইর গল্প ফেঁদেছে!
মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর শনিবার আবারও বলেছেন, ১৯৯৬ সালের নির্বাচনের আগে আইএসআইর কাছ থেকে টাকা নিয়েছে আওয়ামী লীগ! তা-ই যদি সত্যি হয়, কী বিপজ্জনক তথ্য! ১৯৯১ সালে বিএনপি, ১৯৯৬ সালে আইএসআইর কাছ থেকে টাকা নিয়ে ক্ষমতায় বসেছে আওয়ামী লীগ! আইএসআই এভাবে টাকা দিয়ে বাংলাদেশে ক্ষমতা বদলায়?
মির্জা আলমগীরকে এখন বলতে হবে আইএসআইর কাছ থেকে টাকা নিয়ে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার খবর যদি তারা জানতেন, তাহলে ২০০১ সালে ক্ষমতায় বসে তারা বিষয়টি বলেননি কেন? বা এ ব্যাপারে কোননো ব্যবস্থা নেননি কেন? না ২০০১ সালে একইভাবে টাকা পাওয়াতে বিষয়টি চেপে গেছেন? ১৯৯১ সালের নির্বাচনের আগে বিএনপির টাকা নেবার বিষয়টি পাকিস্তানের সুপ্রিম কোর্টের ডকুমেন্টে আছে। আওয়ামী লীগে টাকা নেবার ডকুমেন্টটি এখন মির্জা ফখরুলকে হাজির করতে হবে।
এরপর কী বলা হবে যে আইএসআইর সাবেক চিফ আসাদ দুররানি আসলে আওয়ামী লীগের দালাল। বিএনপিকে রাজনৈতিকভাবে বিপদে ফেলতে আওয়ামী লীগের টাকা খেয়ে এ ধরনের অভিযোগের নামে গিবত করেছে! সিঙ্গাপুরের ব্যাংকের টাকার বিষয়টি নিয়ে বিএনপির আইনজীবীরা এক পর্যায়ে বলা চেষ্টা করেছেন, ‘ওই টাকা তো বাংলাদেশ থেকে কেউ নিয়ে গিয়ে সিঙ্গাপুরে জমা করেনি! তাই ওই টাকার সঙ্গে মানি লন্ডারিং বা বিদেশে পাচারের বিষয় জড়িত না!’ আইএসআইর টাকার ব্যাপারেও কী এক পর্যায়ে বলা হবে, ‘ওই টাকাও তো দেশে এসেছে। দেশে খরচ হয়েছে। নির্বাচনের সময় দেশের লোকজন টাকাগুলো পেয়েছে, তাদের ক্রয়ক্ষমতা বেড়েছে, তাই উপকৃত হয়েছে দেশের অর্থনীতি! আমরা তো নানাভাবে বিদেশ থেকে টাকা আনি। প্রবাসীরা রেমিটেন্স পাঠান। নির্বাচনের সময়ও প্রবাসীরা টাকা পাঠান যার যার পছন্দের প্রার্থীর জন্য। আইএসআই আমাদের বন্ধু, তাই টাকা দিয়েছে, আপনাদের বন্ধু `র` (ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা) যদি টাকা দেয়, আনুন না, অসুবিধা কী! টাকা তো আসবে দেশে। ’
রাজনীতিতে এখন যেহেতু সততার বিষয়টি গৌণ, তাই এ নিয়ে এমন অনেক কথাই হতে পারে। তবে আইএসআইর এই টাকার বিষয়টি কিন্তু দেশের রাজনীতির একটি ক্ষত হিসাবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে। কারণ এ টাকাগুলো কোনো দাতব্য সংস্থার নয়, ভিন্ন একটি দেশের গোয়েন্দা সংস্থার। এটি আবার সেই দেশ, যারা মুক্তিযুদ্ধের সময় এখানে গণহত্যা (জেনোসাইড) ঘটিয়েছে। আইএসআই ও `র` দু’টি সংস্থাই যার যার দেশের স্বার্থ দেখে। বাংলাদেশের স্বার্থ না। তাই আইএসআইর টাকার অভিযোগটির ব্যাপারে খালেদা জিয়ার একটি বক্তব্য দরকার। টাকা না নিয়ে থাকলে ঢাকার পাকিস্তানি হাইকমিশনের মাধ্যমে এ ব্যাপারে সে দেশের সুপ্রিমকোর্টের কাছে এর প্রতিকার চেয়ে পাঠাতে হবে। কারণ, তিনি দেশের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। আগামীতেও হতে চান। আইএসআই বা `র`-এর টাকা-পয়সা নিয়ে আগামীতে অন্তত কেউ যাতে আর বাংলাদেশের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা হতে না পারে, সে জন্য এ ব্যাপারটির স্বচ্ছতা প্রতিষ্ঠিত হওয়া দরকার।
ফজলুল বারীঃ সিডনিপ্রবাসী সাংবাদিক
বাংলাদেশ সময় : ১৫২৩ ঘণ্টা, মার্চ ১৭, ২০১২
সম্পাদনা : রানা রায়হান, অ্যাসিস্ট্যান্ট আউটপুট এডিটর;
জুয়েল মাজহার, কনসালট্যান্ট এডিটর