২০০৮ সালে জি-৮ সম্মেলন চলছিল স্কটল্যান্ডে। পৃথিবীর শক্তিশালী দেশগুলোর রাষ্ট্রপ্রধানরা তখন পৃথিবী নিয়ে ব্যস্ত।
২. বাংলাদেশে প্রধান বিরোধীদল সমাবেশ করেছে ১২ মার্চ। এই সমাবেশটি নিয়ে তোড়জোড় ছিল অনেক। সমাবেশ নিয়ে সরকার সমালেচিত হয়েছে। সমালোচনা করতে গিয়ে অনেকেই বলেছেন, সরকারই যেন এই দিনকে অঘোষিত আইন করেই একটি হরতালের মধ্যে ঠেলে দিয়েছে। একটি সমাবেশ করলে কি এমন ক্ষতি হতো সরকারের। লোক সমাগম যা দেখানোর তাতো দেখিয়ে দিয়েছে বিরোধীদল। এক ঢাকা শহরেই মানুষ থাকে কোটির ওপর। বস্তি আছে অনেক-অসংখ্য। চাল ছিটিয়ে দিলে কাকের যেমন অভাব হয় না, ঠিক তেমনি লাখ-দু’লাখ মানুষের জমায়েত ঢাকার মানুষ দিয়েই করে ফেলতে পারে যে কেউ। বিএনপি তা করতেও পেরেছে। দীর্ঘদিনের আন্দোলন-কিংবা চাল ছিটানোর প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িতরা তো জানেনই এভাবেই জমানো যাবে সমাবেশ। অতএব সফল হবে সবকিছু। অহেতুক কেনইবা হোটেল-রেস্তোরাঁয় শ্যেন দৃষ্টি সরকারের। কোন আক্কেলে একজন মন্ত্রী ঢাকার মানুষকে বলেন, ঢাকায় অপরিচিত কাউকে দেখলেই ধরিয়ে দেবেন। একটা দেশের রাজধানীতে অপরিচিত লোকের কি কোনো অভাব থাকার কথা। পৃথিবীর কোন রাজধানী শহরেই সব মানুষ পরিচিত হবার কথা নয়। কোন ক্ষমতায় আওয়ামী লীগ-যুবলীগ কিংবা ছাত্রলীগের কর্মীরা সমাবেশে আগমনকারী মানুষদের ঠেঙায়? সমাবেশ নিয়ে সরকার যা করেছে, তাতে পরিষ্কার প্রমাণিত হয়েছে, হয় তারা বোকার স্বর্গে বাস করে এসব কথা কিংবা পদ্ধতি অবলম্বন করেছিলেন, না হয় আমাদের মন্ত্রী-নেতারা এসব করে মূলত একগুঁয়েমী কিংবা একধরনের স্বৈরাচারী মনোভাবই দেখিয়েছেন।
মহাসমাবেশ শেষে বলতে গেলে পাল্টা সমাবেশ করেছে আওয়ামী লীগ। সেই একই অবস্থা। জনগণের অভাব নেই। অতএব বক্তৃতার ভাষায় সফল সমাবেশ। দুটো সমাবেশই মিডিয়ায় পেয়েছে ব্যাপক সফলতা। কিন্তু কী সেই সফলতা? যারাই দেখেছেন, তারাই জানেন, একই কথা, বিএনপি বিরুদ্ধে বিষোদগার, তারেক জিয়ার দুর্নীতির চিত্র তুলে ধরা। একুশে আগস্টের মানুষ হত্যার বীভৎস বিবরণ, পাকিস্তান থেকে পাঁচ কোটি রুপি খাওয়া। আর বিএনপি.. সেই একই, বস্তা বস্তা টাকা এনে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী বৈতরণী পাড়ি দেওয়ার চেচামেচি। তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে আলোচনা, শেয়ার মার্কেট কেলেঙ্কারিতে আওয়ামী লীগের সংশ্লিষ্টতা কিংবা সরকারকে আন্ধা, বোবা, লুলা বলা। সরকারের বিভিন্ন দুর্নীতির কথা উচ্চকণ্ঠে বলা। সমান উচ্চারণ। এইতো আমাদের সরকারি দল কিংবা বিরোধীদল।
আওয়ামী লীগ যেদিন সভা করে সেদিন ঘটে বাংলাদেশের আরেক বীভৎস দুর্ঘটনা। লঞ্চ ডুবে গিয়ে কয়েকশ মানুষ নিখোঁজ হয়ে যায় কিংবা লাশ হয়ে যায় শতাধিক নারী-শিশু-পুরুষ। কিন্তু সভা ঠিকই চলতে থাকে। একদিকে মেঘনাপাড়ে হাজার হাজার মানুষের কান্নার হাহাকার অথচ ঢাকায় কিভাবেই চলে তখন রাজপথ কাঁপানো গর্জন। শতাধিক মানুষের মৃত্যুতে শোকের ঢেউ এসে ধাক্কা দেয় না জনারণ্যের এই রাজধানীতে। রাজনীতির এই উচ্চাকাঙ্ক্ষা আসলেই কি বানিয়ে দিয়েছে এই জননেতাদের আরণ্যক রাজনীতিবিদ? যেখান থেকে ভালোবাসা হারিয়ে গেছে, উবে গেছে শোকের সময় পাশে থাকারও ন্যূনতম মানবিক বোধটুকু। অথচ এই মৃত্যুর দায়ই বা এড়াবে কিভাবে সরকার। কারণ একদিনের বন্ধ থাকা ঢাকায় কর্মক্ষেত্রে উপস্থিত হওয়ার মানুষের হুড়োহুড়ি এ লঞ্চ ডুবিরও তো একটা কারণ হতে পারে।
কিন্তু আমাদের এই দেশ ও সংস্কৃতি অদ্ভুত। সমাবেশ-পাল্টা সমাবেশ হয়। এত বড় বিশাল সংসদ। এই সংসদে দিনের পর দিন থাকে প্রাণহীন। এখানে কোনো সমঝোতার কথা উচ্চারিত হয় না। নানা ছুতোয় বিরোধীদল আসে না সংসদে। কোনো কথাই উঠে না প্রাণের এ সংসদে। ব্রিটেনের সংসদে প্রায় প্রতি সপ্তাহেই (বুধবার) প্রধানমন্ত্রীর প্রশ্নপর্বের সময় বিরোধীদলের সংসদ নেতা উপস্থিত থেকে রাষ্ট্র নিয়ে কথা বলেন। বর্তমান বিশ্ব মন্দার সঙ্গে ব্রিটেনও যেন লেপ্টে গেছে। ১ দশমিক ৮ মিলিয়ন বেকার নিয়ে সরকারের সাথে বিরোধীদলও উদ্বিগ্ন। ন্যাশনাল হেল্থ সার্ভিস নিয়ে সরকারের নতুন পলিসি যাতে বাণিজ্যের দিকে না যায়, তা নিয়ে সংসদে তুমুল উত্তেজনা। ইরাক-আফগানিস্তানে ব্রিটেনের সৈন্যদের উপস্থিতি এবং নিহত হওয়া নিয়ে বিরোধীদলের প্রস্থাব-আলোচনা চলে নিয়মিত। ব্রিটেনের বর্তমান মন্দায় জনগণের জীবন-মান কিভাবে অটুট রাখা যায়, তা নিয়ে চলছে আলোচনা।
আর আমাদের বাংলাদেশের প্রাসাদে নেই এসব আয়োজন। বিরোধীদল সংসদে ৭৭ দিন অনুপস্থিত। টানা ৮৩ দিন অনুপস্থিত থাকেন বিরোধীদলের নেতা । আরো ৭ দিন অনুপস্থিত থাকলে তার সংসদ সদস্যপদ থাকবে না। তাইতো তাদের উপস্থিতি গত রোববার, তাও সংসদ নেতা উপস্থিত থাকেন কিছু সময়ের জন্যে। লজ্জা-শরমের মাথা খাওয়া আমাদের সংসদ সদস্য কিংবা নির্বাচিত প্রতিনিধিরা। জনগণ তাদের পাঠিয়েছে সংসদে কথা বলতে জনগণের হয়ে, অথচ জনগণের কোনো কাজ না করে সংসদে থাকেন অনুপস্থিত। কিন্তু ঠিকই বেতন-ভাতা নেন, ট্যাক্স-ফ্রি গাড়ি আনেন। লাখো-কোটি টাকা হাতিয়ে নেন জনগণের। কথায় কথায় তারা রাস্তায় আসেন। অথচ সংসদে বসে আলাপ করলেও তাদের কথা দেশের মানুষ মিডিয়ার কল্যাণে শুনতে পায়, দেখতে পায়। ১৮ মার্চের সংসদের খবরও আমরা দেখেছি ঘরে বসেই। কিভাবেই শালীনতা হারিয়ে গেছে। দুই নেত্রীর উপস্থিতিতে তাদের সোনার মহিলা সাংসদেরা উত্তেজনায় মেতে উঠেছেন। চুলোচুলি করে একেক জনের বিরোধী নেতাকর্মীদের কিভাবে কাপড়-চোপড় ছাড়া তাদের সামনে হাজির করেছেন, তা দেখেছে দেশের মানুষ। সরকারি দলের যেমন আছে তাদের তিন বছরের সার্থকতার ফিরিস্তি, ঠিকই বিরোধীদলের কাছে গত তিন বছর যেন জাহান্নাম। জনগণ নিয়ে কথা নেই। কোনো সুষ্ঠু সমাধানের পথ বাতলে দেওয়া নেই, জিয়া পরিবারই যেন বিএনপির ধ্যান এবং জপমালা।
অন্যদিকে, সরকারি দলও সেই একই, খালেদা-তারেক-কোকো-যেন ঐ পরিবারের দুর্নীতির চিত্র তুলে ধরাই তাদের কাজ। তারেক জিয়া কিংবা কোকো নির্বাসিত। এদের বিচার হচ্ছে, বিচারিক প্রক্রিয়ার মাঝে তা ছেড়ে দিলেই পারে সরকার। বার বার এসব উচ্চারণ করে বরং উসকে দেওয়া হচ্ছে নিজেদের নেতাকর্মীদের। দুটো দলেই চলছে বন্দনার সেই পুরনো চর্চা। আর পারস্পরিক প্রতিহিংসার উচ্চারণ। শুধু ভারতের গান্ধি পরিবার নয়, এই ব্রিটেনেও আছে রাজনীতিতে পারিবারিক প্রভাব। এড মিলিব্যান্ড লেবার পার্টির বর্তমান নেতা নির্বাচিত হবার সময় তিনি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন তার বড় ভাইয়ের সঙ্গে। যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট বুশও ছিলেন আরেক প্রেসিডেন্ট বুশের ছেলে। এখনকার পৃথিবীর প্রভাবশালী হিলারিও সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনের স্ত্রী। সুতরাং রাজনীতিতে পারিবারিক প্রভাব থাকাটা কোনো অস্বাভাবিকতা নয়। এটা হতেই পারে। অন্তত বাংলাদেশে তা চলতে পারে হয়ত আরো একটি প্রজন্ম-সময়। কিন্তু বাংলাদেশে এ দুটো দলের নেতাকর্মীরা যেন দুটো পরিবারকে কেন্দ্র করে সারাদেশব্যাপী একধরনের পারস্পরিক সন্ত্রাস-বিবাদ ছড়িয়ে দিচ্ছে ক্রমশ। এটাই বিস্ময়, এখানেই উদ্বেগ।
৩) আরেকটি মহাসমাবেশ হয়েছে ১৮ মার্চ। সারাদেশের অনেকানেক সাংবাদিকের উপস্থিতিতে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে এই সমাবেশ থেকে উচ্চারিত হয়েছে সাগর-রুনির হত্যার বিচারের কথা। সাগর-রুনি হত্যার বিচার চেয়ে বাংলাদেশের সাংবাদিকরা ঐক্যবদ্ধ হয়েছেন। এমনকি বাম-ডান-মধ্যম সবাই এক কাতারে দাঁড়িয়েছেন। এ যেন সাংবাদিকদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার এক সংগ্রাম। আর তাই জোট বাঁধা। সাগর-রুনির হত্যা সরকারকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। মাস অতিক্রম করেছে আজ প্রায় আট-নয় দিন আগে। কোনই ক্লু নেই সরকারের কাছে। এসব কি বিশ্বাস করা যায়?
এ পর্যন্ত অনেক সাংবাদিক নিহত হয়েছেন। মানিক সাহা, হুমায়ুন কবীর বালু, শামছুর রহমান, গৌতম দাস, দীপংকরসহ অনেক সাংবাদিকের রক্তে রঞ্জিত হয়েছে বিভিন্ন জনপদ। কখনো কোনো পত্রিকার অফিস, কখনো বা নিজ বাসস্থান, কখনো চলার পথে মোটরসাইকেলে তারা নিহত হয়েছেন। প্রত্যেকটি হত্যাকাণ্ডই ঘটেছে সংবাদ বিষয়ক কোনো কারণে। হত্যাকাণ্ড তখনই ঘটেছে, যখনই প্রবল প্রভাবশালীদের চিত্র উঠে এসেছে জনসমক্ষে ঐ সাংবাদিকদের সংবাদের মধ্য দিয়ে। সেকারণে মানুষ জানে এসব হত্যাকাণ্ড কেন হয়। কিন্তু বিচার একটা প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়েই পরিচালিত হয়। সাক্ষ্যপ্রমাণ সামনে আসে না, প্রভাবশালীদের সামনে আসার সাহস রাখে ক’জন। কারণ যুগে যুগে বাংলাদেশে একটা শক্তি যেন এদেরই ছায়া দেয়, আগলে রাখে।
সাগর-রুনির হত্যাকাণ্ড যেমন দেশে-বিদেশে সবখানে নাড়া দিয়েছে, ঠিক তেমনি যেন রাজপথে প্রতিবাদী হতে শিখিয়েছে সাংবাদিকদের। এই ঐক্যবদ্ধ প্রতিবাদের প্রতিধ্বনি ছড়িয়ে পড়ছে সারা দেশে। সারা দেশে ছড়িয়ে থাকা অন্তত পঞ্চাশ হাজার সাংবাদিক এই আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত। সাংবাদিকের জন্যে সাগর-রুনির বিচার চাওয়া মানে সাংবাদিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার আন্দোলন। অন্য অর্থে সমাজ-প্রগতিতে এ এক সামাজিক আন্দোলনও। সুতরাং দেশের সাংস্কৃতিক-সামাজিক আন্দোলনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট মানুষগুলোও এই আন্দোলনের সাথী হবে, এই আমাদের আশা। আপামর মানুষের ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টায় এই আন্দোলন সফল হতেই হবে। আমাদের বিশ্বাস, সাগর-রুনির একমাত্র সন্তান মেঘের মতো অগুনতি মেঘের জন্যে আগামী দিনের একটি নিরাপদ পৃথিবী তৈরি করার জন্যেই লড়ছে ঐক্যবদ্ধ সাংবাদিক সমাজ ভেদাভেদ ভুলে, রাজনীতির উর্ধ্বে উঠে।
ফারুক যোশী: যুক্তরাজ্যপ্রবাসী সাংবাদিক ও কলাম লেখক
faruk.joshi@gmail.com
বাংলাদেশ সময় : ১১১৮ ঘণ্টা, মার্চ ১৯, ২০১২
সম্পাদনা: আহমেদ জুয়েল ও রানা রায়হান, অ্যাসিসট্যান্ট আউটপুট এডিটর